ভারতের যুদ্ধনীতি: নিজের শক্তি নাকি বিপক্ষের দূর্বলতা?

মোতেরা টেস্টের পরে এখন পিচ বিতর্ক তুঙ্গে। সেই বিতর্কে ঢুকছি না। কিন্তু এই বিতর্কে অংশগ্রহনকারী একপক্ষ সমানে বলে চলেছে দেশের মাঠে পছন্দের পিচ বানিয়ে টেস্ট জেতার মধ্যে অন্যায় কোথায়? ঠিক। একবার নয় একশবার ঠিক। কোনো অন্যায় নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই পছন্দের মাপকাঠিটা কি? কিসের উপর এই পছন্দটা নির্ভর করে? নিজের শক্তি নাকি বিপক্ষের দূর্বলতা?

অমর সিং অবধি যাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তাই ভারতবর্ষের প্রথম প্ৰকৃত ফাস্ট বোলার হিসেবে মনে করি কপিল দেবকেই। প্রথম টেস্টে নতুন বলে কপিলের সঙ্গী মহিন্দার অমরনাথ! অবশ্যই হাতে প্রয়োজনীয় স্যুইং ছিল, যথেষ্ট কার্যকরী বোলার ছিলেন, কিন্তু কোনোভাবেই আক্ষরিক অর্থে ফাস্ট বোলার নন। পরবর্তীতে টেস্টে মূলত তিনজন কপিলের সঙ্গে নতুন বল ভাগ করে নিয়েছেন।

কারসন ঘাউড়ি, মদনলাল এবং প্রভাকর (আশ্চর্য জনক ভাবে তিনজনেই ঠিক ৩৯টা করে টেস্ট খেলেছেন)। তিনজনেই কার্যকরী কিন্তু সেই অর্থে কপিলের যথার্থ পরিপূরক ছিলেন না। এরপরে শ্রীনাথের যখন আগমন ঘটল, কপিল প্রায় শেষের দিকে। অর্থাৎ কপিল খেলাকালীন সেভাবে ভারতের প্ৰকৃত ফাস্ট বোলিং জুটি তৈরি হয়নি। এরপর শ্রীনাথ টানলেন প্রায় এক দশক, যার মধ্যে পাঁচ বছর সঙ্গী প্রসাদ।

ভারতের প্রথম প্ৰকৃত ফাস্ট বোলিং কম্বিনেশন তৈরি হল যখন শ্রীনাথ-জাহির-নেহেরা একসঙ্গে মাঠে নামলেন। কিন্তু নেহেরার চোট প্রবণতা এবং শ্রীনাথের অবসর এই কম্বিনেশনেরও আয়ু দীর্ঘ হতে দেয়নি। আগারকার এবং পাঠান মধ্যবর্তী পর্যায়ে তাদের সার্ভিস দিলেও সেই অর্থে পেস জুটি তৈরি হলো না। এইরকম পরিস্থিতিতে ২০০৮ এ উদয় হলো ইশান্ত শর্মার। এইখানে এবার একটু থামা যাক।

কপিল দেবের অভিষেক থেকে ইশান্তের অভিষেক। এই মধ্যবর্তী ৩০ বছরের ভারতীয় ফাস্ট বোলিংয়ের যে ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরলাম তার মধ্যে আরও একটা দিক আছে। ১৯৭৮, অর্থাৎ কপিলের যখন অভিষেক হচ্ছে সেই সময় বেদি-চন্দ্র-প্রসন্ন যুগ প্রায় শেষের দিকে, যদিও ভেঙ্কট তারপরেও কয়েক বছর খেলেন। অর্থাৎ ভারতের একটা স্পিন নির্ভরতা তৈরি হয়ে গেছে যেহেতু স্পিনের স্বর্ণযুগ ভারতীয় ক্রিকেট দেখে নিয়েছে।

পরবর্তী এক দশকে সেই স্পিনের ভেল্কিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন মনিন্দার সিং, দিলীপ দোশি, শিবলাল যাদব, রবি শাস্ত্রীরা। এরপরে প্রবল গতিতে উত্থান হলো কুম্বলের, সঙ্গী রাজু-চৌহান এবং সর্বোপরি নব্বইয়ের দশকের শেষে এলেন হরভজনও। স্পিন নির্ভরতা আরো বেড়ে গেলো। একদিকে প্ৰকৃত ফাস্ট বোলিংয়ের জুটি তৈরি হওয়ার অভাব অন্যদিকে ঝুড়ি ঝুড়ি স্পিনারের আগমন। ফলে কপিল তো সারা জীবন ভারতের প্রাণহীন, স্পিনার সহায়ক পিচে বল করেই গেলেন এবং তার নিকট উত্তরসূরীরাও তাই করলেন। এই অবধি এহেন পিচ তৈরি করে দেশের মাটির সুবিধে নেওয়ার যথেষ্ট যুক্তি সঙ্গত কারণ আছে।

আবার ফিরে আসা যাক ওই ২০০৮ সালে। জহির-ইশান্ত (সেই সময়ের ইশান্ত) যথেষ্ট সমীহ জাগানো জুটি। এরপর একদিকে জাহিরের ধীরে ধীরে প্রস্থান এবং অন্যদিকে সামি-উমেশ-ভুবনেশ্বরদের আগমন। যার সর্বশেষ অবস্থান আজকের ফাস্ট বোলিং লাইন। রীতিমত ঈর্ষণীয়। আর ওদিকে স্পিন সাম্রাজ্য কুম্বলে-হরভজন নিজেদের যুগ শেষ করে অশ্বিন-জাদেজার হাতে ব্যাটন সঁপে দিয়েছেন।

এবার আবার ফিরে আসা যাক চলতি টেস্ট সিরিজে। অস্ট্রেলিয়ার মাঠে প্রায় অর্ধেক দল নিয়ে প্রায় অসম্ভব সিরিজ জয় করে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে যাওয়ার লড়াইতে ভারত মুখোমুখি হলো ইংল্যান্ডের। আত্মবিশ্বাসে ফুটতে থাকা একটা দল যার হাতে এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলিং লাইনআপ, তর্কহীন ভাবে অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলিং এর রিজার্ভ বেঞ্চ; তারা হঠাৎ করে তারা নিজেদের আক্রমনকে  স্পিন বোলিং নির্ভর করে দিলো।

কুলদীপ, সুন্দর, অক্ষর প্যাটেলদের উপর সম্পূর্ন আস্থা রেখেই বলছি, হাতে এত ভাল ফাস্ট বোলিং সেট থাকার পরেও যদি তাদের উপর ভরসা না রাখা যায় তাহলে তাদের আত্মবিশ্বাস ধরে রাখা যাবে তো? শততম টেস্ট খেলতে নামা বোলারকে পুরো টেস্টে পরিস্থিতির দাবিতে মাত্র পাঁচ ওভার বল করিয়ে সম্পূর্ণ ফাস্ট বোলিং ইউনিটকে এই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো না তো যে তোমরা ততক্ষনই ভাল এবং প্রয়োজনীয় যতক্ষণ আমরা দেশের বাইরে।

আর এখানেই উঠে আসছে ওই ‘পছন্দ’ এর বিষয়। যখন তোমার হাতে স্বর্ণ যুগের চার স্পিনার ছিল, কুম্বলে-হরভজন ছিল, তুলনায় দুর্বল ফাস্ট বোলিং ইউনিট ছিল তখন তুমি ‘পছন্দের’ স্পিনিং ট্র্যাক বানিয়ে ম্যাচ জিতেছ ঠিক আছে কিন্তু আজ তোমার স্ট্রং পয়েন্ট যখন পাল্টেছে তোমার যুদ্ধ নীতি কেন পাল্টাবে না? পছন্দ কেন পাল্টাবে না? সবাইকে মাথায় রেখেই বলছি এক অশ্বিনকে সরিয়ে নিলে স্পিন বোলিং আক্রমন কি এতটাই শক্তিধর যে এত ভাল ফাস্ট বোলিং ইউনিটকে ব্যবহার করা হবে না?

আর অশ্বিন তো যে কোনো ধরনের পিচেই উইকেট নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে যখন একদম শেষ মুহূর্তে সূচি নির্ধারন হলো তখন খানিক রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এই ভেন্যু বা চেন্নাইতে তে ম্যাচ না দিয়ে পেস সহায়ক কলকাতা বা এই ফেব্রুয়ারিতে ধর্মশালা বা উত্তর ভারতের ভারী আবহাওয়াতে যেখানে বল নড়াচড়া করবে এমন মাঠে ম্যাচ ফেলে নূন্যতম তিন ফাস্ট বোলার লেলিয়ে এই ব্রিটিশদের পেড়ে ফেলা যেত না? চতুর্থ বা পঞ্চম দিনের জন্য শেষ পাতে দই এর মত অশ্বিন অ্যান্ড কোম্পানি তো ছিলই। নাকি পেস সহায়ক উইকেটে ব্রড-অ্যান্ডারসনকে খেলার ঝুঁকি নেওয়া হলো না।

ঐতিহাসিক ব্রিসবেন টেস্টের পরে বোরিয়া মজুমদার এক জায়গায় বলেছিলেন যে হয়তো ভবিষ্যতে আর কোনোদিন সিরাজ-নটরাজন-শার্দূল একসঙ্গে টেস্ট খেলবেন না। বাস্তবতার দিক থেকে দেখলে অকাট্য যুক্তি। কিন্তু ভবিষ্যতে সত্যি যদি এদের থেকে অন্তত: দুজনকে একসঙ্গে দলে না দেখা যায়, ভারতের এই ফাস্ট বোলিং ট্রেন্ড যেটা অনেকাংশেই বর্তমান টিম ম্যানেজমেন্টের হাত ধরে তৈরি হয়েছে সেটায় কোনোরকম ভাঁটা আসে; বর্তমান ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট এবং বোর্ডকেই হয়তো ভবিষ্যৎ সময় দায়ী করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link