ইমতিয়াজ আহমেদ নট আউট!

ব্র্যাবোর্ন স্টেডিয়াম, ১৯৫১।

লেস অ্যামিসের কমনওয়েলথ একাদশ পাঁচ মাসের লম্বা সফরে ভারতীয় উপমহাদেশে যাচ্ছে। সেই সফরের একেবারে শেষ ম্যাচটা ছিল তাঁরায় তাঁরায় রটিয়ে দেওয়ার মত। অ্যামিস তো ছিলেনই, সাথে আরও ছিলেন ফ্রাঙ্ক ওরেল, সনি রামাদিন, ডেরেক শ্যাকলটন, হ্যারল্ড গিম্বলেট, লরি ফিশলক, ব্রুস ডুল্যান্ডের মত রথী মহারথীরা।

কমনওয়েলথ একাদশের এই ম্যাচটা ছিল মূলত ‘ইন্ডিয়ান প্রাইম মিনিস্টার একাদশ’ এর বিপক্ষে। ভারতীয় এই দলটাতেও অবশ্য বড় নামের অভাব ছিল না। বিশেষ করে বলতে হয় দলটার বোলিং আক্রমণের কথা। ফজল মাহমুদ, খান মোহাম্মদ, শুটে ব্যানার্জি, সিকে নাইডুর ভাই সিএস নাইডুর বোম্বের ঐ তীব্র ভ্যাপসা গরমের মাঝেও একের পর এক গোলা বল ছুঁড়ে যাচ্ছিলেন। তা ভারতীয় উপমহাদেশের এই বোলিং লাইনআপের বিপক্ষেও কমনওয়েলথ একাদশের ব্যাটসম্যানেরাও ছিলেন সাবলীল, অন্তত ফিশলক, অ্যামিসের সেঞ্চুরি আর একই দলেরই গোটা তিনেক হাফ-সেঞ্চুরি আমাদেরকে সেরকমই একটা বার্তা দেয়।

অ্যামিস অবশ্য নিজেদের এই ব্যাটিং রথকে খুব বেশি দূর টেনে নিয়ে যাননি। ম্যাচের মাত্র দ্বিতীয় দিন সকালেই যখন দলের রান ৫ উইকেটের বিনিময়ে ৫০৫, তখনই তিনি কমনওয়েলথ একাদশের ইনিংস ঘোষণা করে দেন।

এখান থেকেই শুরু ইমতিয়াজ আহমেদের গল্প।

কমনওয়েলথ একাদশের বিপক্ষে ইমতিয়াজ আহমেদ যখন খেলতে নামছেন, বয়স তখন তাঁর সবে তেইশ। অ্যামিস যখন দলের ইনিংস ঘোষণা করে দেন, তখন অধিনায়ক বিজয় মার্চেন্টের সাথে ব্যাট হাতে নামছেন তিনি। তবে এই গল্পের নায়ক ঠিক নায়কোচিত ইনিংস খেলেছেন এমনটা কিন্তু নয়।

ইমতিয়াজের স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এই ম্যাচ খেলার কথা নয়। যদিও তিনি রঞ্জি হিরো ছিলেন। কিন্তু ততোদিনে পাকিস্তান আলাদা হয়ে গিয়েছে; লাহোরে জন্মানো এই ক্রিকেটারের তাই ভারতের হয়ে খেলার কথা না। কিন্তু ভারত সরকার পাকিস্তানের তিন জন ক্রিকেটারকে এই ‘প্রাইমিনিস্টার একাদশ’-এর হয়ে খেলতে আমন্ত্রন জানায়। তারই একজন ছিলেন ইমতিয়াজ।

দলের স্কোরবোর্ডে মাত্র ২৮ রানের ক্ষুদ্র একটা অবদান রেখে দলের রান ৫৩ এর সময় তিনি ফিরে যান প্যাভিলিয়নে। তবে এ দায়ের ভার একা ইমতিয়াজের ঘাড়ে দিলে কিন্তু মোটামুটি একটা পাপ হয়ে যাবে। কারণ কমনওয়েলথ একাদশের ঐ দলটার বিপক্ষে আসলে দলের কেউই খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি, যে কারণে ভারতীয় উপমহাদেশের দলটার রান থেমে যায় মাত্র ১৭৩ রানেই!

‘ইন্ডিয়ান প্রাইম মিনিস্টার’ একাদশের এই নাজেহাল দশার পর কমনওয়েলথ একাদশের অধিনায়ক অ্যামিস দলটাকে আবারও ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান। তবে এবার ওপেনিংয়ে ইমতিয়াজ থাকলেও ইমতিয়াজের সাথে নামা ওপেনিং পার্টনার পরিবর্তন হয়ে যায়। অবশ্য এই পরিবর্তন দরকারিও ছিল। বিজয় মার্চেন্ট প্রথম ইনিংসেই ইনজুরিতে পড়েছিলেন, তাঁর পক্ষে আর দ্বিতীয় ইনিংসে ওপেন করতে নামা সম্ভব ছিল না । অগত্যা তাই ইমতিয়াজের সাথে নামতে দেখা গেল শুটে ব্যানার্জীকে।

ওপেনিং সঙ্গী পরিবর্তনটা অন্যদিকে ইমতিয়াজের জন্য পয়া হয়ে দেখা দেয়। তিনি নিজের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন আর ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ব্যাট করতে থাকেন। তবে অন্যদিকের ব্যাটসম্যানেরা কিন্তু ইমতিয়াজের মত অসীম ধৈর্য্যের পরিচয় দিতে পারেনি। ব্যানার্জী যেমন ৬০ রানের মাথায় ফিরে যান, রুসি মোদি , ইনজুরিগ্রস্ত মার্চেন্ট আর ভারতীয় ক্রিকেটের কিংবদন্তীতুল্য বিজয় হাজারেও দলে অবদান রেখে ফিরে যান প্যাভিলিয়নে। মাঝে মুশতাক আলীও ইমতিয়াজের সাথে ৬১ রানের পার্টনারশিপ তৈরি করে আউট হয়ে যান। শেষদিকে শ্রীলঙ্কান রথী স্ট্যানলি জয়সিংহও ছোটখাট একটা ক্যামিও খেলেন আর বাকিদের মতই ফিরে যান প্যাভিলিয়নে।

কিন্তু ইমতিয়াজ? তিনি যেন পণ করে নেমেছেন! অসীম ধৈর্য্য লাগুক, যুদ্ধের একাগ্রতা লাগুক তিনি কোনভাবেই ক্রিজ ছেড়ে উঠবেন না! আর এভাবেই গোটা একটা দিন তিনি মাটি কামড়ে পড়ে রইলেন ক্রিজে। কমনওয়েলথ একাদশের বাঘা বাঘা বোলারেরা তাকে আউট করতে পারল না।

প্রাইম মিনিস্টার একাদশের তরুণ এক খেলোয়াড় ছিলেন বিজয় মাঞ্জেরকার। ইমতিয়াজের একাগ্রতার সেই ম্যাচে ইমতিয়াজের সাথে সবচাইতে বেশি বনিবনা হয়েছিল এই মাঞ্জেরকারের সাথেই। তবে এই পার্টনারশিপও ভাঙার উপক্রম হয়েছিল অনাকাঙ্খিত এক কারণে। নাহ, অন্য সবার মত মাঞ্জেরকার ইমতিয়াজকে ছেড়ে চলে যাননি। এবারের পার্টনারশিপ ভাঙনের উপক্রমের কারণ অন্য, কমনওয়েলথ একাদশের বোলার রে ডোভি।

ইমতিয়াজের রান তখন ২৬৩! কেন্টের এই বোলারের এক ডেলিভারি সোজা গিয়ে লাগে ইমতিয়াজের মুখে। সাথে সাথেই ক্রিজে বসে পড়েন ইমতিয়াজ, আঘাতের মাত্রা বেশ গুরুতর হলেও পরে দ্রুতই ক্রিজে নিজের কাজে ফিরে আসেন ইমতিয়াজ।

তবে এই ঘটনার পর আর খুব বেশিক্ষণ তাদের পার্টনারশিপ চালু থাকেনি, বলতে গেলে মাঞ্জেরকার আর বেশিক্ষণ ক্রিজে থাকেননি। রে ডোভিরই করা এক ডেলিভারিতে বোল্ড আউট হয়ে তিনি ফিরে যান প্যাভিলিয়নেই। তবে অন্যদিকে ইমতিয়াজ কিন্তু তখনও ‘নট আউট’ হয়ে আছেন!

উইকেটের চারপাশে শটের ফুলঝুরি ছুটিয়ে ইমতিয়াজ ক্রিজে ছিলেন পাক্কা আট ঘন্টা। এতে যেটা হয়েছিল, ভারতীয় একাদশ ইনিংস ব্যাবধানে হারার লজ্জা তো এড়িয়েছিলই, কমনওয়েলথ একাদশের রান টপকে বড়সড় একটা লিডও নেওয়ার পথে ছিল। তবে ভারতীয় একাদশের অধিনায়ক বিজয় মার্চেন্ট ইনিংস  ঘোষণার পায়তারা খুঁজছিলেন, কিন্তু ইমতিয়াজ তিনশো রানের ল্যান্ডমার্ক ছোঁয়ার পথে থাকায় সেটা তিনি করতে পারছিলেন না। তবে, ইমতিয়াজ যখন তিনশো রানের কীর্তি ছুঁয়ে ফেলেন ভারতীয় প্রাইম মিনিস্টার একাদশের ইনিংস ঘোষণা হয়ে যায় ওখানেই!

ইমতিয়াজকে তখনও কেউ আউট করতে পারেনি!

প্রাইম মিনিস্টার একাদশের এই দু:সাহসী কাণ্ডের পর কমনওয়েলথ একাদশের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ২১৩ রানের। সে ম্যাচ অবশ্য শেষ অব্দি ড্র হয়েছিল। কিন্তু ম্যাচের ফলাফল নিয়ে মোটেও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার কিছু নেই। ম্যাচের আসল ম্যাজিক তো তখন ঘটে গিয়েছে অন্যখানে!

কমনওয়েলথ একাদশের অধিনায়ক ছিলেন যে লেস অ্যামিস, তাকে ঐ সময়ে বলা হত উইকেটকিপারদের মধ্যে সবচাইতে সেরা ব্যাটসম্যান। ইংলিশ এই কালজয়ী উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান সেদিন মাঠে দাঁড়িয়েই দেখেছিলেন আরেক কাল অতিক্রম করে সময়ের আগে থাকা আরেক উইকেট কিপার ব্যাটসম্যানের উত্থান। নামটা আর কেউ নয়- ইমতিয়াজ আহমেদ!

লাহোরে জন্ম নেওয়া ইমতিয়াজ দেশ ভাগের পর পাকিস্তানের হয়ে টেস্ট খেলেছেন। ৪১ টেস্টে ২০৭৯ রান করেছেন। পাকিস্তানের অভিষেক টেস্টে হানিফ মোহাম্মদ নিজেই উইকেট কিপিং করেছিলেন। এরপর থেকে এই দায়িত্বটা নেন ইমতিয়াজ। ১৯৬৬ সালে ইমতিয়াজ পাকিস্তান সরকারের ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ পুরষ্কার পান। ২০১৬ সালে বুকে ইনফেকশন নিয়ে মারা যান তিনি।

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link