ছোটবেলার কথা মনে আছে?
যার ব্যাট সে দুইবার ব্যাটিং করবে। কিংবা আউট হলে আবার ব্যাটিং করবে? এগুলো যে শুধু পাড়ার ক্রিকেটে হয় তা কিন্তু না! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও এমন সব মজার আর অদ্ভুত কান্ড জন্ম দেওয়ার ঘটনা আছে এক রগচটা বুড়োর!
মোটা তাজা শরীর, লম্বা গোঁফ, ভুড়ির ওপর কোনোরকমে বেল্ট আটকে আছে! লম্বা দাড়িতে পাক ধরেছে প্রায়। এমন একজন ‘বুড়ো’ ২২ গজে ব্যাট হাতে ক্রিকেট খেলছেন ব্যাপারটা শুনতে অদ্ভুত আর হাস্যকর হলেও সত্যি!
ডব্লিউ জি গ্রেস – পুরো নাম উইলিয়াম গিলবার্ট গ্রেস।
যিনি পেশায় একজন ডাক্তার, আবার একজন অ্যাথলেটও! ক্রিকেট পাগল কথাটা হয়তো তাকে দেখেই আবিষ্কার হয়েছিলো। এমনো হয়েছে যে রুগী তার জন্য বসে আছে, আর তিনি মাঠে ক্রিকেট খেলছেন! তাকে ক্রিকেটের ‘অমর বুড়ো’ বলা হয়! আধুনিক ক্রিকেটের জনক আখ্যা পাওয়া সেই ডব্লিউ জি গ্রেস ক্রিকেট মাঠে জন্ম দিয়েছেন অনেক অনেক অদ্ভুত আর মজার কান্ডের। এমনকি আছে আধুনিক ক্রিকেটের বেশ কিছু শটও নাকি তারই জন্ম দেওয়া!
তিনি আউট হবার পরও মাঠ ছাড়েননি, এমন ঘটনাও কিন্তু আছে! কথিত আছে একবার বোল্ড হবার পরও তিনি আবার ব্যাট করতে দাঁড়িয়ে যান! বোলারকে আবার বল করতে বলে বলেন, ‘লোকজন পয়সা খরচ করে আমার ব্যাটিং দেখতে এসেছে, তোমার বোলিং নয়।’
পরের বার তিনি কাঠের ব্যাট পালটে আবার অ্যালুমিনিয়ামের ব্যাট হাতে ব্যাট করতে শুরু করেন! তারপরই কিছুদিনের জন্য ‘ট্রায়াল বল’ নিয়ম চালু হয়। ক্রিকেটের বাধা-ধরা সব নিয়ম অন্যান্য খেলোয়াড়দের জন্য হলেও গ্রেস চলতেন শুধু নিজের বানানো নিয়মে।
একবার পর পর দুই বলই পায়ে লাগায় বোলার লেগ বিফোরের আবেদন জানান, গ্রেস আম্পায়ারকে এমনভাবে ভয় দেখান যে আম্পায়ার আউটই দেননি! অবশ্য তার পরের বলেই চার্লস কোর্টারাইটের বলে বোল্ড হন গ্রেস। ফেরত যাবার সময় চার্লস তখন মজার ছলে গ্রেসকে বলেন নিশ্চয়ই তুমি ফেরত যাচ্ছো না? প্রতিউত্তরে গ্রেস বলেন, ‘এখনো একটি স্টাম্প দাঁড়িয়ে আছে’।
ক্রিকেট মাঠে এমন অনেক মজার মজার অদ্ভুত উদ্ভট রকমের কান্ডের জন্ম দিয়েছেন গ্রেস! ছোটবেলার ক্রিকেট খেলার সময় আপনি যা করতেন কিংবা যা দেখেছেন সেটা গ্রেস আরো প্রায় দেড়শো বছর আগেই করে গেছেন।
গ্রেস যে শুধু ক্রিকেটই খেলতেন এমন নয়! তিনি একজন অসাধারণ প্রতিভাবান অ্যাথলেটিকস ছিলেন। ৪৪০ মিটার হার্ডলসের তিনি ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হন। এছাড়াও তিনি ফুটবল ও গলফেও ছিলেন সমান পারদর্শী। সে সময়কার সেরা অ্যাথলেটদের একজন ছিলেন তিনি।
একটা মানুষ এতোকিছু একসাথে করতে পারে? ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত না? কিন্তু গ্রেস সবকিছুই করে দেখিয়েছিলেন। ১৮৪৮ সালের জুলাই মাসে ব্রিস্টলে জন্ম নেওয়া গ্রেস ক্রিকেটার ছাড়াও পেশায় একজন ডাক্তার ছিলেন। অবশ্য ডাক্তার হিসেবে কেমন ছিলেন সেটা অজানা; কারণ তিনি প্রায় এগারো বছর সময় নিয়েছিলেন ডাক্তারি পড়া শেষ করতে! আর যখন তিনি ডাক্তারি পড়া শেষ করেন, ততদিনে তিনি তিন সন্তানের বাবা।
ডব্লিউ জি গ্রেসের পুরো জীবনটায় আপনি যত ঘাটবেন ততই অদ্ভুত আর মজার সব ঘটনা জানতে পারবেন। হয়তো বয়সের সাথে তার কাজের হিসেবে-নিকেশ মেলাতে মেলাতে কয়েক প্রহর কেটে যাবে, তবুও হিসেব মেলাতে পারবেন না!
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তিনি রান করেছেন ৫০ হাজারেরও বেশি! সেই সাথে তার ঝুলিতে আছে ২৮০৯ উইকেট! সেঞ্চুরী ১২৪ টি আর হাফ সেঞ্চুরী আছে ২৫১টি!! আট ক্যালেন্ডারে হাজার রান আর শত উইকেট প্রাপ্তির রেকর্ড আছে। এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি করেছেন দুই দুইটা ট্রিপল সেঞ্চুরি! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টেস্ট খেলেছেন ২২টি। ২ সেঞ্চুরি আর ৫ হাফ সেঞ্চুরিতে করেছেন ১০৯৮ রান। তার ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান দেখেই নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন তাকে কেনো ক্রিকেটের আদিপিতা বলা হয়!
গ্রেসকে নিয়ে বেশ কিছু মজার ঘটনাও আছে:
* কথিত আছে একবার পাড়ার ক্রিকেটে গ্রেস ঝাড়ুর হ্যান্ডেল দিয়ে ব্যাট করেছিলো! আর সেই ম্যাচেও তার দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান (৩৫) সংগ্রাহক ছিলেন।
*গ্রেস নাকি ব্যাট করবার সময় ক্যাচ উঠলেই উদ্ভট শব্দ করতেন যাতে করে ফিল্ডাররা তার ক্যাচ ফেলে দেয়!
* ক্রিকেটে ডেড বলের নিয়ম চালু হয়েছে কিভাবে জানেন? একবার নাকি ব্যাটিংয়ের সময় বল তার জার্সিতে ঢুকে যায়। আর সেই অবস্থায় গ্রেস দৌড়ে সাত রান নেন! শেষে প্রতিপক্ষের ফিল্ডাররা তাকে ধরে বল বের করে!
* একবার গ্রেস ইচ্ছে করেই ব্যক্তিগত ৯৩ রানে আউট হয়েছিলেন। কারণ জীবনে তিনি ৯৩ বাদে ০-১০০ পর্যন্ত সব রানই করেছিলেন!
* একবার এক টেস্টে গ্রেসের দল ফিল্ডিং করছিলো। দিনের শেষ বলে একদম পরিষ্কার এলবিডব্লিউ হলেও ফিল্ডাররা আবেদন করেনি! খেলা শেষে ব্যাটসম্যান তখন মজার ছলে গ্রেসকে বলছিলো – আবেদন করলেন না কেনো? আমি তো আউট ছিলাম।
গ্রেস তখন চুপ করেই ছিলেন! পরদিন বোলার বল করার আগেই গ্রেস আম্পায়ারের সামনে আগের দিনের এলবিডব্লিউর আবেদন জানান ‘হাউ’জ দ্যাট। আম্পায়ার সহ মাঠের সবাই প্রায় হতভম্ব! আউট হবার পরে আর কোনো বল না হওয়ায় সেবার আম্পারকে বাধ্য হয়েই আঙুল উচুঁ করতে হয়েছিলো!
ক্রিকেট মাঠে এমন অনেক মজার মজার ঘটনার জন্ম দিয়েছেন গ্রেস৷ তবে তার ক্রিকেট জ্ঞান কিংবা ক্রিকেট ক্যারিয়ার, প্রতিভা এসব নিয়ে কেউই প্রশ্ন তোলার সাহস পায়নি কখনো। রান করার আলাদা ক্ষুদা কাজ করতো গ্রেসে মধ্যে! তিনি বেশ জনপ্রিয় একজন ছিলেন। ইংল্যান্ডের রানীর পর সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন এই গ্রেস! তাকে নিয়ে কত বই লিখা হয়েছে কত সম্মাননা দেওয়া হয়েছে তার হিসেব নেই।
তখনকার সময়ে ক্রিকেটে ফিজিও ছিলো না! গ্রেস যেহেতু ক্রিকেটারের পাশাপাশি ডাক্তার ছিলেন তাই সবসময় তিনি তার ডাক্তারি ব্যাগ সাথেই রাখতেন। নিজের কিংবা প্রতিপক্ষ দলের কারো ইনজুরি কিংবা চোট পেলে তিনি চিকিৎসা করতেন। মানবিক দিক থেকেও গ্রেস ছিলেন অনন্য।
ব্যাটিং সম্পর্কে গ্রেসের একটা অমর বাণী হলোঃ
‘ব্যাটিং উইকেট বা ভালো উইকেটে আমি যখন টসে জিতি তখন ব্যাটিং নিই। আবার আমি যখন একটা সংশয়ে ঘেরা পিচে (ব্যাটিং না বোলিং উইকেট না বুঝতে পারা) টস জিতি তখন আমি এটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবি এবং ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেই। আবার যখন খুব খারাপ পিচে টসে জিতি, তখন আমি এটা নিয়ে আরো কিছু সময় ভাবি এবং ভাবার পর আমি ব্যাটিং নিই।’
ফ্রন্ট ফুট, ব্যাক ফুটে খেলার আবিষ্কারটাও এই গ্রেসের হাত ধরেই। অনায়াসেই তিনি ফ্রন্ট ফুট, ব্যাক ফুটে শট খেলতেন। তিনি ছিলেন অনন্য প্রতিভার অধিকারি। তিনি নিজের ক্রিকেটের একটি ব্রান্ড। তিনি ক্রিকেটের প্রথম মহানায়ক।
১৮৯৯ সালে গ্রেস আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়। তখন তার বয়স কত ছিলো জানেন? মাত্র ৫০ বছর! অবাক হবার শেষটা এখানেই নয় সবধরনের ক্রিকেট থেকে তিনি অবসর নেয় ১৯১৪ সালে, যখন তার বয়স ছিলো ৬৬ বছর!! অবশ্য যিনি ক্রিকেটের জন্যই জন্মেছিলেন, ক্রিকেট ছাড়ার পর বেশিদিন দুনিয়ার আলো আর দেখেননি। ১৯১৫ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী ছাড়েন তিনি!
তার মৃত্যুর ১০৬ বছর পরেও তাকে ক্রিকেট বিশ্ব মনে রেখেছে! ক্রিকেটের সত্যিকার ঈশ্বর তিনি! তার রেখে যাওয়া মজার ঘটনা, স্মৃতি আর অদ্ভুতুরে সব কান্ডের হলফনামা ক্রিকেট বিশ্বে সোনার ফলকে মোড়ানো থাকবে আজীবন। ক্রিকেট বিশ্বে তার মতো এন্টারটেইনার না কখনো ছিলো, না আছে আর না কখনো আসবে। ক্রিকেট বিশ্বে চির অমর হয়ে থাকবে রগচটা বুড়োটা!