দুনিয়ায় সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা কোনটি, প্রশ্নের জবাব দিতে এক সেকেন্ডও লাগবে না কারো – ফুটবল! হাসি, আনন্দ, আবেগ, আলোর রোশনাই, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা মিলিয়ে বিনোদনের পারফেক্ট প্যাকেজ। মুদ্রার অপরপিঠে অন্ধকারও আছে। সেই অন্ধকারের একটি অধ্যায় ফিফার ঘুষ কেলেঙ্কারি, যা রীতিমতো কাঁপিয়ে তুলেছিল ফুটবল দুুনিয়াকে।
২০২২ কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে ফুটবলাঙ্গনে জল কম ঘোলা হয়নি। ভোট জালিয়াতি, ঘুষ নিয়ে কাতারকে দায়িত্ব পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠে ফিফার বিরুদ্ধে। অস্বীকার করতে চাইলেও অস্বীকার করার জো থাকে না সবক্ষেত্রে। ফিফার কর্মকর্তারা শেষ রক্ষা পাননি। নির্বাচনের আগে ভোট বিক্রির অপচেষ্টার দায়ে বহিষ্কৃত হন ফিফার নির্বাহী কমিটির ছয় সদস্য। ঘুষ, দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে ফিফার অবস্থান এখানেই শেষ নয়। এর আগেও নানান সময়ে প্রশ্ন উঠেছে ফিফার স্বচ্ছতা নিয়ে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে কাতার বিশ্বকাপ কেলেঙ্কারি।
- কোথা থেকে সূত্রপাত?
দুই ডিসেম্বর, ২০১০। ২০১৮ এবং ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক হবার দৌঁড়ে প্রতীদ্বন্দ্বী দেশগুলোকে পেছনে ফেলে দায়িত্ব পায় রাশিয়া এবং কাতার। রাশিয়ায় ২০১৮ আসর, পরেরটা কাতারে। গোলযোগ বাঁধে মধ্যপ্রাচ্যের কাতারকে নিয়ে। কাতারের আবহাওয়া এমনিতে উত্তপ্ত। কী কাকতাল, বছর না ঘুরতে তাদের নিয়ে উত্তাপ বাড়ে বাস্তবিক অর্থে। অভিযোগ- ভোট কিনে দায়িত্ব নিয়েছে তারা! প্রায় ছ’মাস ধরে চলতে থাকে ঘটনা খুঁটিয়ে দেখা।
জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় কাতার ফুটবলের প্রধান, ফিফার সহসভাপতি ‘মোহাম্মদ বিন হাম্মাম’-কে। অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তার সাথে যুক্ত হয় আরেকটি অভিযোগ। অসদাচার। হাম্মাককে সকল প্রকার ফুটবলীয় কার্যক্রম থেকে আজীবন নিষিদ্ধ করতে দ্বিতীয়বার ভাবেনি ফিফার গভর্নিং বোর্ড। তাতে ভেস্তে যায় হাম্মামের ফিফা সভাপতি হবার লালিত স্বপ্ন।
- হাম্মামেই সমাপ্তি?
হাম্মাম কেবল নাটকের আবহ সঙ্গীত বাজিয়েছেন। সেই সঙ্গীতের জের ধরে বছর দুয়েক পর ২০১৩ সালের ৩০শে এপ্রিল অভিযোগ ওঠে ফিফার সাবেক সভাপতি জোয়াও হ্যাভেলাঞ্জ, নির্বাহী কমিটির সদস্য নিকোলাস লিয়োজ ও রিকার্ডো টিসেরার বিরুদ্ধে। অভিযোগের বিষয়, অবৈধ অর্থ গ্রহণ। তার পরের সপ্তাহে কনক্যাকাফ অঞ্চলের সাবেক মহাসচিব চাক ব্লেজারকে বহিষ্কার করে ফিফার এথিক্স কমিটি।
- কনক্যাকাফের পথ ধরে
কনক্যাকাফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক যিনি একই সঙ্গে পালন করেছিলেন উত্তর ও মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান ফুটবলের বড়কর্তার, তিনি ভেঙেছেন হাঁড়ির আরেকটি খবর। দুর্নীতি এমনকি হতে পারত ২০১৪ বিশ্বকাপেও। মাত্রই আগের আসর আয়োজন করা দক্ষিণ আফ্রিকা চাইছিল ২০১৪-তে ফের আয়োজক হতে। তিনি আরো বলেন, ১৯৯৮-র আসর বসার কথা ছিল মরক্কোয় যেটা পরে অনুষ্ঠিত হয় ফ্রান্সে। তার ভাষ্যে স্পষ্ট হয় টেলিভিশন ব্রডকাস্টিং নিয়ে ফিফার অনৈতিক কাণ্ড।
- কলঙ্কিত চরিত্ররা
ফিফার কাতার কেলেঙ্কারির গল্পে চরিত্রের অভাব নেই। পদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে চ্যালা, সকলের গল্পে সরব উপস্থিতি। এফবিআইয়ের একেকবারের অভিযানে ধরা পড়তে থাকে নতুন নতুন মুখ, বেরিয়ে আসে নতুন অভিযোগ, গল্প মোড় নেয় নতুন বাঁকে। অভিযোগের শেষ নেই ফিফার বিরুদ্ধে। মার্কিন ব্যাংকে অবৈধ অর্থের লেনদেন, প্রায় ১৪ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এইসব চক্রের হোতা হিসেবে। তবে ২০১৮ সালে সুইস পুলিশের জুরিখের এক হোটেল অভিযানে পাল্টে যায় পাশার দান। ফিফা এবং উয়েফা সভাপতির ক্যারিয়ারে পড়ে যায় যতিচিহ্ন।
- ওদের কী হল?
সেপ ব্ল্যাটার। মিশেল প্লাতিনি। দুজনকে মুখোশ মানুষ বলা চলে। ওরা আবার দুটি দেহ একটি প্রাণ। একাত্না যাকে বলে। ১৯৯৯-২০০২। দুইজনের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক আর্থিক সমঝোতা। সমঝোতার অর্থ পাবেন প্লাতিনি, দেবেন ব্ল্যাটার। ২০১১ সালে প্লাতিনি সে টাকা বুঝে পান। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫, আর্থিক অনিয়ম ও বিধি ভঙ্গ করে উয়েফা সভাপতি মিশেল প্লাতিনিকে অর্থ প্রদানের অভিযোগে ব্ল্যাটারের বিরুদ্ধে সুইজারল্যান্ডে শুরু হয় ফৌজদারি তদন্ত। প্রথমে দুজনে অস্বীকার করেন। পরে আবার স্বীকার করেন ব্ল্যাটার। দু’জন একাত্ম বলেই হয়ত স্বীকার করেন প্লাতিনিও।
দু’জনেই সমর্থন করেছেন আত্মপক্ষ। দিয়েছেন নানান যুক্তি। সেসব ধোপে টেকেনি। ৮ই অক্টোবর প্রথম দফায় ব্ল্যাটার এবং প্লাতিনিকে নিষিদ্ধ করা হয় সাময়িকভাবে। সাথে ফিফার মহাসচিব জেরোম ভালকেকে দেয়া হয় তিনমাসের বহিষ্কারাদেশ। এর মধ্যে পঞ্চম দফায় ফিফার সভাপতি নির্বাচিত হন ব্ল্যাটার। ভেবেছিলেন উড়ে যাবে শঙ্কার কালো মেঘ, রাত শেষে ভোর আসবে। কিন্তু না! সব রাত শেষ হয় না। সব ভোরে আলো ফোটে না। ব্ল্যাটার প্লাতিনি তাই তিনমাস থেকে আটবছরের নিষেধাজ্ঞা পান, জারি হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
২০১৫ সালের ২৭শ মে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের ভিত্তিতে জুরিখের হোটেলে যে অভিযান চালায় সুইজারল্যান্ড পুলিশ তার সর্বশেষ পরিণতি ফিফা-উয়েফার দুই সভাপতির কারাবাস। সেদিন অবশ্য আটক হয়েছিলেন ফিফার সাত কর্মকর্তা যাতে ছিলেন দুই সহসভাপতিও। ছয় বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সভাপতি পদের প্রার্থী দক্ষিণ কোরিয়ার চুং মং-জুংকে। কিন্তু বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচাইতে ঘৃণ্য কেলেঙ্কারির দ্রষ্টা তো জেলে থাকা ওই দুই মুখোশধারী ভদ্রলোক যারা আসীন ছিলেন ফুটবলের সর্বোচ্চ চূড়ায়।