নেক্সট টেস্ট প্লেয়িং নেশন! ইউ নেভার নো!

১৯৯৭ সালের ১৩ এপ্রিল।

রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনাময় সময় কেটেছে রংপুর ক্যাডেট কলেজের ওমর ফারুক হাউজের জুনিয়র ব্লকের টয়লেটে!

হ্যাঁ, আপনি যা ভাবছেন, সেটাও ঠিক। টয়লেটে আমাদের বেশ ‘উত্তেজনাময়’ সময় কাটে বটে। তবে ২১ বছর আগের সেই দিনটি ছিল ভিন্ন কিছু। সেই উত্তেজনা, রোমাঞ্চ, বিচিত্র সব অনুভূতির সেই দোলাচল, তেমনটির তুলনীয় কিছু তখনও ছিল না, পরেও আসেনি। বৃষ্টি বাধায় দ্বিতীয় দিনে গড়ানো আইসিসি ট্রফির ফাইনালে সেদিন ছিল বাংলাদেশের রান তাড়া!

আমরা কয়েকজন টয়লেটে ছিলাম, কারণ আমাদের কাছে ছিল রেডিও। ক্যাডেট কলেজে এসব নিষিদ্ধ ছিল। তবে অনেকেই লুকিয়ে ওয়াকম্যান রাখত। আমি লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম রেডিও। ক্রিকেটের পোকা ছিলাম। রেডিওতে অনেক ম্যাচের ধারা বিবরণী শোনাত। তাছাড়া সম্ভবত রাত ৮ টা ৫ মিনিটে খেলার খবর হতো ৫ মিনিটের। নিয়মিত শুনতাম সেটা!

আইসিসি ট্রফি চলার সময় সেই রেডিও ছিল আমাদের প্রিয়তম সঙ্গী। স্যার কিংবা সিনিয়র ভাইদের হাতে ধরা খাওয়ার ভয় ছিল। পানিশমেন্ট কোনো ব্যাপার ছিল না, নিয়মিতই তো খেতাম। কিন্তু রেডিওটা নিয়ে যেত, সেই ভয় ছিল। এজন্যই টয়লেটে গিয়ে শুনছিলাম খেলা।

২৫ ওভারে ১৬৬ রান সেই সময়ে ভীষণ দু:সাধ্য। পিঞ্চ হিটার দূর্জয় ভাইয়ের পাঞ্চের অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। তিনি বোল্ড হলেন মার্টিন সুজির প্রথম বলেই। আমাদের মুখ কালো। সেই মুখগুলোই উজ্জ্বল হয়ে উঠল রফিক ভাইয়ের ইনসাইড আউট ছক্কা আর নান্নু ভাইয়ের কাভার ড্রাইভের বাউন্ডারিতে।

মনে আছে, আসিফ করিমের বলে বুলবুল ভাই ছক্কা মারার পর খুশিতে বন্ধু মাঈনের পেটে ঘুসি মেরে বসলাম! খুশিতে আটখানা মাঈন খেয়ালই করেনি। পরের বলেই সুইপ করতে গিয়ে বুলবুল ভাই বোল্ড। এবার মাঈনের সম্বিত ফিরল, ‘তুই আমারে ঘুসি মারলি ক্যান?’

আকরাম ভাই বল উড়িয়ে পাঠালেন মাঠেরই বাইরে। এমন লাফ দিয়েছিলাম যে রেডিও হাত থেকে ফসকে কমোডে পড়ে যায় যায় অবস্থা!

ভয়ানক ঘটনা ঘটল শেষ ওভারের আগে। দরকার ১১ রান। মাঈন হঠাৎ আঙুল উঁচিয়ে আমাকে শাসাল, ‘আজকে বাংলাদেশ না জিতলে তোর খবর আছে।’ আমি প্রথমে ভেবেছি ফাজলামো। কিন্তু তাকিয়ে দেখি, মাঈনের রক্তচক্ষু। সে সিরিয়াস। বললাম, ‘আমি কি করছি?’ মাঈন আবার আঙুল তুলে বলে, ‘আমি ক্রিকেট বুঝতাম না। তোর রেডিও শুনে শুনে পাগল হইছি। এখন আমরা না জিতলে তুই মজা বুঝবি।’ পাইলট-শান্তরা না পারলে আমার দায় কি, সেটা বোঝানোর ঝামেলায় গেলাম না। টেনশন-উত্তেজনায় এমনিতেই জান তেজপাতা!

শেষ ওভারের প্রথম বলে পাইলট ভাইয়ের ছক্কায় সম্ভবত গোটা বাংলাদেশ কেঁপে উঠেছিল। আমরাও চিৎকার করছিলাম, তবে আওয়াজ ছাড়া! চিৎকার করলে ধরা খাওয়ার ভয়। কিন্তু অঙ্গভঙ্গিতে ফাটিয়ে দিচ্ছিলাম!

২ বলে যখন চাই ৩ রান, শান্ত ভাই পুল করলেন। রেডিওর ধারাভাষ্যকারের চিৎকার, ‘বল চলে গেল বাউন্ডারিতে।’ এরপর আমাদের আর হিতাহিত জ্ঞান নেই। ছিটকে বের হলাম টয়লেট থেকে। ধরা খাওয়ার ভয়-য় কোথায় পালাল, ভাবারও সময় নেই। চিৎকার করে লাফিয়ে করিডোর ধরে ছুটে চোখের পলকে নেমে গেলাম তিন তলা থেকে। নিচে নেমে লাফাব। কিন্তু নিচে নেমেই চক্ষু চড়কগাছ!

নিচতলায় শহীদ জাহাঙ্গীর হাউজে ঢোকার মুখে একপাশে ওয়ার্কশপ। তার সামনে বেশ বড় জমায়েত। রেডিওতে সাউন্ডবক্স থেকে খেলা শোনানো হচ্ছে, সবাই একসঙ্গে শুনছেন! আমরা কয়েকজন টয়লেটে লুকিয়ে শুনছিলাম, সাউন্ডবক্সে খেলা শোনানোর কথা জানতামই না!

তার চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার, খেলা আসলে তখনও শেষ হয়নি! আমরা আকাশ থেকে পড়লাম। ঘটনা হলো, বল বাউন্ডারির দিকেই যাচ্ছিল, ফিল্ডারও ছিল না। সেটা দেখেই ধারাভাষ্যকার বাউন্ডারি বলে ফেলেছিলেন। আমরাও অতি উচ্ছ্বাসে শেষটুকু শোনার অপেক্ষা করিনি। কিন্তু বৃষ্টি ভেজা মাঠ, শেষ দিকে বলের গতি কমে যায়। ততক্ষণে ফিল্ডার ছুটে এসে বল থামায়। বাউন্ডারি হয়নি, হয়েছিল দুই রান!

ভুল থেকেই পরে উপহার মিলল ফুল। ১ বলে ১ রানের সেই থমকে যাওয়া মুহুর্তটায় সবার সঙ্গেই দম বন্ধ অপেক্ষা, খানিকপর সবার সঙ্গেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ার সুযোগ মিলল। গগণবিদারী চিৎকারে শুরু হলো বিজয় মিছিল। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত চারপাশ। ক্যাডেট কলেজের শৃঙ্খলার জাল ছিঁড়ে ক্রিকেট নিয়ে বিজয় মিছিল করার যে অভাবনীয় আনন্দ ও রোমাঞ্চ, সেই সময় আর সেই পরিস্থিতিতে না থাকা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না!

মাহেন্দ্রক্ষণ কথাটি আমরা কত সময়ই ব্যবহার করি। সেটা ছিল সত্যিকারের মাহেন্দ্রক্ষণ। ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণ। পালাবদলের সূচনা। সেই যে টয়লেটে মাঈন আমাকে হুমকি দিয়ে বলল, ‘আগে ক্রিকেট বুঝতাম না…’, অনেক পরে পেছন ফিরে তাকিয়ে সেটিকে আমার মনে হয়েছে প্রতীকী। এরকম কোটি কোটি মাঈনের হৃদয়ে ক্রিকেট জায়গা করে নিয়েছিল সেই আইসিসি ট্রফি থেকেই। ইতিহাসের মোড় বদলে দেওয়া সময়। ক্রিকেটের দুকূলপ্লাবী জোয়ার আসার সময়।

সারাদেশে টানা কতদিন যে ছিল উচ্ছ্বাসের প্রবল বন্যা! মানিক মিয়া এভিনিউতে গণসংর্বনা কিংবা সরকারী বিভিন্ন ঘোষণার কথা বাদই দিলাম। প্রতিদিনই আমরা পত্রিকায় পড়তাম, ‘অমুক হোটেল মালিক ক্রিকেটারদের জন্য ১ বছর খাওয়া ফ্রি করে দিয়েছেন’, ‘তমুক বাসে ৬ মাস ক্রিকেটাররে টিকিট লাগবে না’, ‘অমুক সেলুনে আজীবন ক্রিকেটাররে চুল কাটা ফ্রি’, ‘৬ মাস ক্রিকোরদের ভাড়া নেবেন না তমুক স্কুটারওয়ালা’ – আবেগ-ভালোবাসার এরকম বিচিত্র সব প্রকাশ। হাসি পেতে পারে, অবাক লাগবে পারে, রূপকথা মনে হতে পারে। সবই সত্যি। সময়টাই ছিল অমন ঘোরলাগা।

রেডিওর ধারাভাষ্যকার বাউন্ডারি নিয়ে যে ভুল করে ফেলেছিলেন, অনেক পরে ভিডিওতে দেখেছি, একই ভুল করেছিলেন টিভি ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলেও। শান্ত ভাইয়ের শটটি বাউন্ডারি ধরে নিয়েই বলে ফেলেছিলেন, ‘হি ইজ দা হিরো’, কিন্তু ফিল্ডার বল ধরে ফেলেন।

পরে যখন ইন্টারনেট নাগালে এলো ভার্সিটিতে পড়ার সময়, ইউটিউবে ফাইনালের ভিডিও পেলাম, কত হাজার বার যে দেখেছি! শেষের প্রতিটি মুহূর্তে সেই দিনের নিজেকে মিলিয়েছি। ভিডিওতে জয়ের পর হার্শার কথা বারবার শুনতাম আর গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যেত প্রতিবার, ‘হোয়াট আ ডে ইন দ্য হিস্টরি নট অনলি অফ বাংলাদেশ ক্রিকেট, বাট অফ আ নেশন দ্যাট এক্স্যাক্টলি টুয়েন্টি ফাইভ ইয়ারস ওল্ড।’ গ্যালারিতে একটি ব্যানার, ‘নেক্সট টেস্ট প্লেয়িং নেশন’, সেটা দেখে হার্শা বললেন, ‘ইউ নেভার নো…’

আমাদের ক্রিকেট সাফল্যের পথচলায় নতুন সোপানে পা রাখার দিনগুলি… আহা, স্মৃতি তুমি সুন্দর!

– ফেসবুক থেকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link