‘ফুটবল ম্যাচ ছোট করার কথাও ভাবতে পারি’

ইতোমধ্যে যা তোলপাড় হওয়ার হয়ে দিয়েছে। ১২ ক্লাবের একাত্রতা প্রকাশের মাধ্যমে কাগজে কলমে ১২ বছর আগের স্বপ্ন এখন সত্যি। ৩ দিন আগেও যাকে ভাবা হচ্ছিল অসম্ভব, মিথ সেটিকেই সম্ভব করেছেন ইউরোপের এলিট ক্লাবেরা। ঘোষণার একদিন পরই মিডিয়ার সামনে সম্পূর্ণ ব্যাপার নিয়ে মুখ খুলেছেন রিয়াল মাদ্রিদ ও দ্য সুপার ক্লাব প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। এল চিরিংগুইতোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পুরো সুপার লিগ খোলাসা করেছেন তিনি।

  • সুপার লিগের সূচনা

ইংল্যান্ড, স্পেন আর ইতালির মেজর ক্লাবগুলো খুবই বাজে একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। শুধু ক্লাবগুলো নয়, ফুটবলও ধুঁকছে। ফলে আমাদের বিকল্প কিছু একটা ভাবতে হতো। সেই বিকল্প কিছু হল সুপার লিগ। আমরা সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্তে দাড়িয়েছি যে যদি আমাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, তবে সেটার সমাধান হলো সুপার লিগ, চ্যাম্পিয়নস লিগ নয়। আমাদের ম্যাচপ্রতি আয় বাড়াতে হবে, আর সেই আয়ের মুখ দেখাবে কম্পিটেটিভ ম্যাচ। বাজে একটা সময়ের পর সুপার লিগ প্রতিটি দলকে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।

এই যেমন আমার ক্লাবের কথাই বলি, রিয়াল মাদ্রিদ। রিয়াল মাদ্রিদে আমরা বিশাল পরিমাণ টাকা হারিয়েছি এবং আমাদের অবস্থাটাও খুব একটা ভালো না। ম্যাচের পর ম্যাচ লাভের মুখ দেখা যাচ্ছে না। আর দর্শকহীন সময়ে লাভের মুখ দেখতে হলে সর্বপ্রথম আপনাকে ম্যাচের ইন্টেনসিটি বাড়াতে হবে। আর সেজন্য মিড উইকেও কম্পিটেটিভ ম্যাচ খেলা অত্যন্ত জরুরি। আর সেটাই করার চেষ্টা করছি আমরা।

যত উত্তেজনায় ঠাঁসা ম্যাচ হবে, তত বেশি আয় হবে ক্লাবদের। আর সেটাই এখন বাঁচার একমাত্র উপায়। ম্যানচেস্টার-বার্সা ম্যাচের উত্তেজনা আর রেভিনিউর সাথে ম্যানচেস্টার আর একটা মিড-টেবিল ক্লাবের উত্তেজনা আর আয় মেলানো সম্ভব হবে না। কারণ দিনশেষে টাকার প্রয়োজনীয়তা সব জায়গাতেই। মহামারির কারণে ৪০০ মিলিয়ন ইউয়ো হারিয়েছি, কেউ তো আসেনি সাহায্য করতে। নিজেদের বেঁচে থাকতে হয়েছে নিজেদের জন্য। এখনকার সময়ে টিভি রাইটস থেকে পাওয়া টাকাই পারে আমাদের বাঁচাতে। আর বেশি টিভি রাইটসের জন্য দরকার বেশি বেশি হাই-ভোল্টেজ ম্যাচ।

সত্যি বলতে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী লোকজনদের মধ্যে আমি ফুটবল নিয়ে আগ্রহ খুব কম দেখি। এই বয়সী কিশোর-কিশোরীদের আগ্রহের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো ভিডিও গেমস, সেখানে তাদের ফুটবলের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে হবে। যুগের সাথে সাথে সব ইন্ডাস্ট্রিতে পরিবর্তন আসে, ফুটবলেও আনতে হবে। নইলে আপনি টিকতে পারবেন না। ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কিশোর-কিশোরীর আগ্রহ ফুটবলে আনতে হবে। এবং সেটার জন্য সুপার লিগের আয়োজন। বেশিরভাগই দিনে দিনে ঝুকে পড়ছে অন্যান্য দিকে।

১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীরা অন্যান্য দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে, ফুটবলের বদলে। এই অডিয়েন্সটা আমাদের টানতে হবে। সুপার লিগের পরেও যদি তাদের কাছে খেলাটা বিরক্তিকর মনে হয়, তবে ফুটবল ম্যাচ ছোট করার কথাও ভাবতে পারি।

  • সুপার লিগের ফরম্যাট

সুপার লিগ হবে চ্যাম্পিয়নস লিগের মতন। ১৫ টি দল নির্দিষ্ট থাকবে আর তার সাথে ৫ টি দল যুক্ত হবে। এটা কোনো ক্লোজড লিগ নয়, বরং ৫ দলকে নিজেদের জায়গা অর্জন করে নিতে হবে এখানে খেলার জন্য। কিন্তু পার্থক্য হলো এখানে আপনার জন্য টাকার পরিমান বেশি। চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতলে উয়েফা থেকে ১২০-১৩০ মিলিয়ন ইউরো পান। এখানে আরো বেশি পাবেন। আমরা ফুটবলে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করতে এসেছি। সুপার লিগ সেটাই করবে। সেভিয়া, পোর্তো; যারা আসতে চায় সবার জন্য এই সুপার লিগ উন্মুক্ত।

  • উয়েফার কড়াকড়ি:

উয়েফা একটা মনোপোলি, এটা আমরা সবাই জানি। তারা নিজেদের মর্জি মতন ইউরোপিয়ান ফুটবল চালাচ্ছে, এই জিনিস একদিন না একদিন থামাতেই হতো। এটা আমাদেরই এখন করতে হচ্ছে কারণ আর দেরি হলে ফুটবল সত্যিই ধ্বংস হয়ে যাবে। আমরা সকলেই লেব্রন জেমসের বেতন জানি। কিন্তু ইউইয়েফা প্রেসিডেন্ট কিংবা লা লিগা প্রেসিডেন্ট? তাদের বেতনের ধারণাও আমাদের কাছে নেই।

আমি আমারটা বলে দিচ্ছি, রিয়াল মাদ্রিদ থেকে একটা টাকাও নেই না। একটা জার্সি কিনতে হলেও আমি স্টোর থেকে গিয়ে পতসা দিয়ে কিনবো। কারণ আমি ক্লাবকে ভালোবাসি। ২০০০ সালে আমি প্রথম রিয়াল মাদ্রিদে এসেছি, দেখুন আমি কী করেছি? রিয়াল মাদ্রিদ দেনায় জর্জরিত ছিল, আমি ক্লাবটাকে বাঁচিয়েছি। আমি এটাকে আরো ভালো জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। গতকাল উয়েফা প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে অ্যাগনেল্লিকে (জুভেন্টাস প্রেসিডেন্ট) অপমান করলেন। এটাতেই তার আসল রূপ বেরিয়ে গিয়েছে। আপনি কখনোই এমন প্রেসিডেন্ট চাইবেন না, যিনি অন্য প্রেসিডেন্টকে অপমান করছেন।

ইউয়েফা খেলোয়াড়দের ব্যান দিবে, চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বের করে দিবে? কোনোটাই হবে না। কোনো খেলোয়াড় জাতীয় দল থেকে নিষিদ্ধ হবে না, কোনো দলই এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বাদ পরবে না। রিয়াল, চেলসি, সিটি; তিনদলই খেলবে। কারণ? আক্রণ লিগ্যালি এটা করা সম্ভব না।

আমরা নিজেদের প্রমাণ করে সেমিতে উঠেছি, আমাদের বের করে দেওয়ার সুযোগ নেই তাদের কাছে। লা লিগা, প্রিমিয়ার লিগ কোনোটাই নিজেদের স্বতন্ত্র হারাবে না। দু’টো একসাথে চলতে পারবে। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বললেন, এটা নাকি তার লিগ নষ্ট করে দিবে। কোনো ভাবেই না, প্রিমিয়ার লিগ তাঁর স্বাতন্ত্রতা বজায় রাখবে।

ইউয়েফা আর ফিফার সাথে কথা বলবো, সেটা কোনো সমস্যা না। তারা চাইলে যেকোনো কিছুই হতে পারে। তারা যদি আমাদের চ্যাম্পিয়নস লিগে চায়, সে ব্যাপারেও ভেবে দেখবো। তাঁদের মধ্যে স্বচ্ছতার অভাব দূর করতে হবে। ইউয়েফাকে বুঝতে হবে, পৃথিবী পরিবর্তন হয়েছে, এখানে আগের নিয়ম খাটছে না।

এখনও আমরা সবাইকে সুপার লিগ আইডিয়া বুঝানোর চেষ্টা করছি। সেটা সকলে বুঝতে পারলে আশা করি সবার মধ্যে কনফিউশন থাকবে না। সুপার লিগ আগষ্টেই শুরু হচ্ছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন।

  • পিএসজি ও বায়ার্নের রিজেকশন

আমরা কোনো জার্মান ক্লাবদের সাথে এখনও কথা বলিনি। আর পিএসজিকে এখানে খেলার জন্য আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। তারা যদি রিফিউজও করে তবে সুপার লিগ থেমে যাবে? কখনোই না। বরং সুপার লিগ তার সেরাটা দিয়েই চলতে থাকবে।

  • চ্যাম্পিয়নস লিগের সাথে পার্থক্য

চ্যাম্পিয়নস লিগের থেকে আমরা এটাকে আরো ভালো করার চেষ্টা করবো। প্রথমত রেফারি থাকবে পুরাতন ও এক্সপেরিয়ান্সড, যারা রিটায়ার করেছে কিংবা এখন আর ইউয়েফা আর ফিফাতে চুক্তিবদ্ধ নেই। তাদেরকে দিয়ে প্রথমে রেফারিং করানো হবে। এরপর তাদের অধীনে আরো কিছু ইয়াং রেফারি ট্রেইনড হবে যাদের আমরা পরবর্তীতে মাঠে নিয়ে আসবো।

‘ভিএআর’ সিস্টেমকে আরো উন্নত করা হবে, এখনও অনেক ডিসিশন ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়, সেটি আর হবে না। প্রতিটি রেফারির গায়ে মাইক থাকবে, যা দিয়ে পুরো মাঠে কী কথা হচ্ছেম কিভাবে ডিসিশন মেইক করছেন তারা, সব টিভি পর্দায় সকলে শুনতে পাবে। ফাইনাসিয়াল ফেয়ার প্লে রুলসও থাকবে। কোনো দল তাঁর লভ্যাংশের ৫৫% এর বেশি খরচ করতে পারবে না স্যালারির পেছনে। ফলে অহেতুক খেলোয়াড় কিনে অস্থিরতা তৈরি করার বিষয়টা আসবেই না। উয়েফা এতোদিনেও যা পারেনি, তাই করে দেখাবো আমরা।

গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বাজে অবস্থানে আছি আমরা। আমরা বলতে প্রতিটি ক্লাবই। আমাদের এমন খেলোয়াড়ও বিক্রি করতে হয়েছে যাদের বিক্রি করতে চাইনি। এটাই আমাদের উত্তরণের সেরা উপায়। প্রত্যেক ক্লাব চুক্তি সাক্ষর করে দিয়েছে, এখন কারো পক্ষেই পেছনে হাঁটা সম্ভব নয়। ১৭ তারিখ আমরা সকলে নিজ নিজ জায়গা থেকে চুক্তিপক্ষ সাক্ষর করেছি। আমি প্রেসিডেন্ট হয়েছি কারণ ১২ দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে প্রেসিডেন্সি করার অভিজ্ঞতা আমার আছে, সে জন্য।

বার্সেলোনা সমর্থকেরা আমাকে চেয়ারপার্সন হিসেবে দেখতে চায় না? অসুবিধা নেই, কালকে লাপোর্তা চাইলে আমি নিজে তাঁকে পদ ছেড়ে দেব।

  • র‍্যাপিড ফায়ার রাউন্ড

  • কিলিয়ান এমবাপ্পে: সত্যি বলতে এমবাপ্পের সাথে এখনও আমার কোনো কথাই হয়নি। সে অনেক ভালো খেলোয়াড়, রিয়াল মাদ্রিদ লেভেলেরও। দেখা যাক ভবিষ্যতে কী হয়।
  • ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো: সে এখন জুভেন্টাসের খেলোয়াড়। তার রিয়ালে ফেরার উপায় নেই। ক্রিশ্চিয়ানো আমার খুব পছন্দের মানুষ, কিন্তু এটা এখন সম্ভব না।
  • সার্জিও রামোস: সার্জিও রামোস কি দল ছাড়বে? জুনের ৩০ তারিখের আগ পর্যন্ত যেকোনো কিছু হতে পারে। দলের সামগ্রিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। ক্লাবের এই মুহূর্তে কোনো আয় নেই, সব আসবে মৌসুম শেষে। আমাদের সব খেলোয়াড়কেই সামান্য ছাড় দিতে হয়েছে। রামোসও গত বছর দিয়েছে। আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে।
  • ভিনিসিয়াস: নট ফর সেল
  • জিনেদিন জিদান: জিদান ইতিহাসের সেরা ম্যানেজার। তাঁর ভবিষ্যৎ? সেটা জিদানের উপর নির্ভর করছে। তাঁর কন্ট্রাক্ট এখনও ক্লাবের সাথে আছে এবং সে অনুযায়ী সে থাকবেও আশা করি।
  • লিওনেল মেসি: আশা করি সে বার্সা ছাড়বে না। এল ক্লাসিকোর যে আনন্দ মেসি চলে গেলে তাতে কিছুটা হলেও ভাটা পরবে।
  • আর্লিং হাল্যান্ড: তার বাবা আমাদের ক্লাব, ট্রেনিং গ্রাউন্ড দেখে গিয়েছে। দেখে গিয়ে একটা কথাই বলেছে, এমন জিনিস আমরা আগে কখনও দেখিনি। এমবাপ্পে আর হাল্যান্ডের ফুটবলের মেসি-রোনালদো হওয়ার অনেক বড় সুযোগ আছে এবং আশা করি তারা সেটা কাজেও লাগাতে পারবে।    

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link