ধীর পায়ে এগিয়ে চললেন দেবতা

রাত্রিবেলায় ম্যাচ শেষে দাদা অজিতের ফোনে ফোন এল। ফোনের ওপারে তখন তার ভাই। ফোন করে ভাই জানতে চাইল একটাই কথা – ‘সেই দিনের ৭৪ রানের ইনিংসটায় কি কি টেকনিক্যাল ভুল ছিল যেগুলি তিনি শুধরাবার চেষ্টা করবেন।’ অবাক অজিত। অবাক সব্বাই।

আগের ম্যাচে ছোটেবাবুর ‘বাবুমশাই’ অর্থাৎ সৌরভ গাঙ্গুলি ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণীর পর আস্তে আস্তে এগিয়ে এলেন তার ছোটেবাবুর কাছে। আলিঙ্গন করলেন তাঁর আদরের ছোটেবাবুকে। খুব গভীর ছিল সেই আলিঙ্গনটা।

যেন বলতে চাইলেন – ‘আজ তবে এখানেই শেষ বন্ধু। আবার দুই জনে একসাথে ওপেনিংয়ে নামব অন্য পৃথিবীতে, অন্য কোনো জন্মে।’ ওপরের হেলিকপ্টার থেকে বর্ষিত হল ১৯৯ কেজির গোলাপ ফুল তার ১৯৯ তম টেস্ট ম্যাচে।

তারপর দেখতে দেখতে এসে পড়ল সেই দিনটা। ক্রিকেট দেবতার শেষ ম্যাচ। শচীন রমেশ টেন্ডুলকার খেললেন তার গত তিন বছরের সেরা ইনিংস। নরসিংহ ডিওনারিনের বল আর স্যামির ক্যাচ থামিয়ে দিল শচীনের ৭৪ রানের ইনিংস। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। হেলমেটটা খুলে ব্যাটটা উঁচু করে তুলে ধরলেন আকাশের দিকে।

যেন আকাশের মধ্যে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন তার বাবাকে, ঠিক যেমন করে ৯৯’এর বিশ্বকাপে বাবাকে সৎকার করে এসে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে আকাশের দিকে ব্যাট উঁচিয়ে বাবাকে খুঁজতে থেকেছিলেন। শেষ দিনে অধিনায়ক তার হাতে বল তুলে দিলেন, ঠিক যেভাবে হিরো কাপ ফাইনালের শেষ ওভারটায় তার প্রতি আস্থা রেখেছিলেন স্বয়ং মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন।

উইকেট পেলেন না, মিলল কিছু বাউন্ডারি, কিন্তু প্রত্যেকবারেই শোনা গেল দর্শকের হাততালি আর অভিজাত সেই গর্জন – ‘সা… চি… ন… সা… চি… ন।’ যেন বোঝাতে চাইলেন, সৃষ্টিকর্তা তুমি যা দিয়েছো, দু-একটা বাউন্ডারি খাওয়া তার কাছে নগণ্য। ম্যাচ শেষে ভারতীয় খেলোয়াড়েরা তার পথ চলার সাথে সাথে তাঁকে ঘিরে যেতে থাকল। যেন দেবতার যাত্রায় চলমান পুষ্পবর্ষণ।

গার্ড অভ অনার শেষে আস্তে আস্তে এগিয়ে এলেন পিচটার দিকে,দুই হাত দিয়ে স্পর্শ করে প্রণাম করলেন পিচটায়, শেষবারের মতো। অস্ফুটস্বরে হয়তো বলে গেলেন- ‘এই পথে আর যাওয়া হবে না, আমার সময় ফুরোলো।’ জায়ান্টস্ক্রিনে একটাই লেখা ফুটে উঠল-‘লিজেন্ডস নেভার রিটায়ার’!

তারপর রাত দশটা নাগাদ দাদাকে ফোন। জানতে চাইলেন সেই দিনের ইনিংসের ভুল ত্রুটিগুলো, আর কোনোদিনও মাঠে নামবেননা জেনেও। হয়তো ২৪ বছর ধরে ক্রিকেটের ধর্মগ্রন্থ পাঠ করতে করতে ভুলেই গেছিলেন ধর্মগ্রন্থের শেষ পাতাটা কবেই শেষ হয়ে গেছে। এটাই তার একাগ্রতা, এটাই তার নিষ্ঠা, এজন্যই শচীন টেন্ডুলকার তিনি।

এক পা দু পা করে আসতে আসতে সরে পড়ল সেই ক্রিকেট নামক পুস্তকের শ্রেষ্ঠ পাঠকটা। পরেরদিন আনন্দবাজার তাঁর কান্নার ছবিটা ছাপিয়ে হেডলাইন করল – ‘ভগবানের চোখেও জল!’ সত্যিই তো, যথার্থ হেডলাইন। তিনি একজনই, তিনি অভিন্ন। তাঁর মত কেউ কখনো আসেননি, আর হয়তো আসবেনও না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link