২০০৪ সালে তিনি যখন প্রথম নীল জার্সিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করলেন, তার আগ পর্যন্ত বেশ কয়েকজনই বিবেচিত হচ্ছিলেন উইকেটের পেছনে ভারতের ভরসার জায়গা হিসেবে। কিন্তু একবার তিনি আবির্ভূত হওয়ার পর থেকে, পরের ১৫টা বছর ওই জায়গাটা পাকাপাকিভাবে নিজের করে নেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মার্ক বাউচার (৯৯৮) ও অ্যাডাম গিলক্রিস্টের (৯০৫) পর সর্বোচ্চ ৮২৯টি ডিসমিসালের মালিক তিনিই।
তবে তিনি এমনই একজন, যার নামের অনেকটা পরে গিয়ে উইকেটরক্ষক শব্দটি উচ্চারিত হবে। ব্যাট-বলের এই খেলায় ১৫ বছরে অন্যান্য অর্জনও যে নেহাত কম নেই তার।
ধোনি ফিনিশেস অফ ইন স্টাইল। আ ম্যাগনিফিসেন্ট স্ট্রাইক ইনটু দ্য ক্রাউড! ইন্ডিয়া লিফট দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ আফটার ২৮ ইয়ার্স!
২০১১ সালের ২ এপ্রিল মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের কমেন্ট্রি বক্সে বসে রবি শাস্ত্রীর এই কথাগুলো জায়গা করে নিয়েছে ক্রিকেটের চিরন্তন রূপকথায়। আর সেই রূপকথার নায়ক যে তিনিই, মহেন্দ্র সিং ধোনি!
কিন্তু এতেও আসলে ঠিকভাবে ফুটে ওঠে না তার মাহাত্ম্যের পুরোটা। ভারতসহ গোটা ক্রিকেট বিশ্বের ইতিহাসে তিনি এমনই অভূতপূর্ব এক ব্যক্তিত্ব যে, তাকে নিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে কোথা থেকে শুরু করতে হবে আর কোথায় গিয়ে শেষ হবে, তা ভাবতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়ে যায় তাবৎ ক্রিকেট পণ্ডিতদেরও।
৩৯ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার নিঃসন্দেহে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক। তিনটি মেজর আইসিসি ট্রফি ভারত ঘরে তুলেছে তারই কল্যাণে – ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ২০১১ বিশ্বকাপ, এবং ২০১৩ আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি।
ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত ফরম্যাট টেস্টেও তার কৃতিত্ব কম নয়। ২০০৯ সালে ভারতকে প্রথমবারের মতো আইসিসি টেস্ট র্যাংকিংয়ের এক নম্বরে তোলেন তিনিই। ২০১৩ সালে ভারত যে ৪০ বছরেরও বেশি সময় পর প্রথম দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়াকে টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করল, সেটিও সম্ভব হয়েছিল তারই নেতৃত্বে। সব মিলিয়ে অধিনায়ক হিসেবে ভারতকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৭টি টেস্ট জিতিয়েছেন তিনি।
একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫০ ওভারের ফরম্যাটে নিজের সামর্থ্যের সবচেয়ে বেশি বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পেরেছেন তিনি। ৩৫০ ম্যাচে ১০,৭৩৩ রান করে তিনি এ ফরম্যাটে ভারতের সর্বকালের সর্বাধিক রানসংগ্রাহকদের তালিকায় পাঁচ নম্বরে; স্রেফ শচিন টেন্ডুলকার, বিরাট কোহলি, সৌরভ গাঙ্গুলী ও রাহুল দ্রাবিড়ের চেয়ে পিছিয়ে।
টেস্ট ক্রিকেটকে একটু আগেভাগেই বিদায় জানান তিনি। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে সাদা পোশাকের ক্রিকেটে আর দেখা যায়নি তাকে। কিন্তু এর আগ পর্যন্ত ৯০ টেস্ট থেকে তার সংগ্রহ প্রায় পাঁচ হাজার রান। ২০১৩ সালে চেন্নাইয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২২৪ রানের সেই অসাধারণ ইনিংসের মাধ্যমে তিনি গড়েন ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের রেকর্ড।
এছাড়া ওই ইনিংসেই তিনি যখন ১৯৩ রানে, তখনই বুধি কুন্দেরানকে (১৯২) পেছনে ফেলে বনে গিয়েছিলেন উইকেটরক্ষক হিসেবে ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের মালিক। সামগ্রিকভাবেও একজন উইকেটরক্ষক-অধিনায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের রেকর্ডটি তার; যা এর আগে ছিল ইংলিশম্যান অ্যালেক স্টুয়ার্টের দখলে।
ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি ছিলেন বরাবরই হার্ড-হিটিং ঘরানার। তার পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৪৮ কিংবা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৮৩ রানের ইনিংসগুলো দেখে অনেকেই বাধ্য হয়েছিল তাকে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের সাথে তুলনা করতে। কিন্তু গিলক্রিস্টের চেয়েও এক জায়গায় তার ছিল বিশেষত্ব, তা হলো ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে ব্যাট করা। লোয়ার-মিডল অর্ডারে ভারতীয় ব্যাটিং স্তম্ভে পরিণত হয়েছিলেন তিনি।
সময়ের সাথে সাথে নিজের ক্রিকেটীয় মস্তিষ্ক আরো পরিপক্ব হতে থাকে তাঁর, এবং এক পর্যায়ে একজন ফিনিশার হিসেবে স্বয়ং মাইকেল বেভানের সাথেও তুলনা শুরু হয়। তিনি বেভানের চেয়ে এগিয়ে কি না, তা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু তিনি যে আধুনিক ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ ফিনিশার, এ ব্যাপারে হয়তো সন্দেহের জায়গা খুব কমই আছে।
অধিনায়ক হিসেবে যখন তিনি ভারতের দায়িত্ব পান, সেটা কারো জন্যই ঠিক সুবিধাজনক পরিস্থিতি বলা যাবে না। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ২০০৭ বিশ্বকাপে নাস্তানাবুদ হয়ে প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়েছে ভারত। এমন একটা সময়ে লম্বা চুলের তরুণ ধোনির কাঁধে তুলে দেয়া হয় ভারতের সীমিত ওভারের দলগুলোর দায়ভার। কিন্তু শুরু থেকেই স্থিরচিত্তের, সদা সাহসিকতার প্রতিমূর্তি ধোনি প্রমাণ করতে থাকেন যে তাকে অধিনায়ক বানানো মোটেই ভুল সিদ্ধান্ত ছিল না।
প্রথমে ভারতকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতিয়ে, এরপর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অজিদের বিপক্ষে দাপট দেখিয়ে, তিনি চুপ করিয়ে দেন সকল সংশয়বাদীকে। অনিল কুম্বলে সরে দাঁড়ানোর পর টেস্ট ক্রিকেটের নতুন অধিনায়কও হন তিনি, এবং সেখানেও নিজের প্রভাবে গোটা ভারতীয় দলকে পাল্টে দিতে ভুল করেননি।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে অধিনায়কত্ব ছেড়ে সাধারণ ক্রিকেটার হিসেবে খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, কিন্তু তার ব্যাটিংয়ের ধার যেন অনেকটাই কমে গিয়েছিল। ফিনিশিংয়েও আগের মতো শক্তিশালী ছিলেন না তিনি, বরং জরুরি মুহূর্তে তার ধীরগতির ব্যাটিং ভারতকে বিপদেও ফেলেছে একাধিকবার।
বিশেষ করে ২০১৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে বাদ পড়ার পর অনেকেই অভিযোগের আঙুল তোলে তার দিকে। তিনি নিজেও এরপর থেকে এক বছরের বেশি সময় ভারতের হয়ে আর কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেননি। তাই গণমাধ্যম থেকে শুরু করে ভারতীয় ক্রিকেটবোদ্ধা, সকলের মুখেই শোনা যেতে থাকে এক ও অভিন্ন প্রশ্ন : এবার কি তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলছেন ধোনি?
শেষ পর্যন্ত সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটালেন ধোনি নিজেই। ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট। সেদিন সন্ধ্যায় ইনস্টাগ্রামে এক পোস্টের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারতের হয়ে তার পথচলার এখানেই ইতি। আর এভাবেই ঘটল একটি যুগের সমাপ্তি। ভারতীয় ক্রিকেটে এখনো হয়তো বিরাট কোহলি কিংবা রোহিত শর্মারা আছেন। কিন্তু মহেন্দ্র সিং ধোনিরা এত সহজে আসে না। আরেকজন ধোনির জন্য হয়তো আরো দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে যেতে হবে ভারত ও বিশ্ব ক্রিকেটকে।
তবে সৌভাগ্যের বিষয়, ক্রিকেটার ধোনির ক্রীড়ানৈপুণ্য আরো কিছুদিন দেখার সুযোগ মিলবে আমাদের। সামনেই আসছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)-এর ত্রয়োদশ আসর। সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিতব্য সেই টুর্নামেন্টে চেন্নাই সুপার কিংসের নেতৃত্ব দেবেন ধোনি। তার নেতৃত্বেই চেন্নাই আইপিএলের ২০১০, ২০১১ ও ২০১৮ আসরে জিতেছে। এছাড়াও তাদের শো-কেসে রয়েছে ২০১০ ও ২০১৪ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা।