লা লিগা, অনেকে এটাকে দুই ঘোড়ার দৌড় বলেই জানে। অন্তত জানতো, সিমিওনে আসার আগ পর্যন্ত, ডিয়েগো সিমিওনে এসে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে নিয়ে বিপ্লপ করার আগ পর্যন্ত বার্সা-রিয়ালের কব্জাতেই থাকতো লা লিগা।
কালেভদ্রে অন্যদলের জয়কে লড়াইয়ে না ধরলে লা লিগা সবসময় ওই দুই ঘোড়ার দৌড় ছিল। কিন্তু কোভিড পরবর্তী এই মৌসুমে বদলে গিয়েছে লা লিগার অবস্থা, দুই ঘোড়া থেকে তিন ঘোড়া এখন চার ঘোড়ার রেইসে পরিণত হয়েছে স্প্যানিশ লিগ। নতুন ঘোড়া হিসেবে দৌড়ে জুটেছে সেভিয়া!
একদম শুরু থেকেই শুরু করা যাক, গত মৌসুমের মাঝামাঝি শুরু হয়েছিল কোভিড-১৯ এর থাবা। তাতে করে বন্ধ হয়ে যাক সকল খেলা। আর তা থেকে ফিরেই কামব্যাক দেয় জিনেদিন জিদানের রিয়াল মাদ্রিদ। এক কামব্যাকে বার্সার সাথে পয়েন্ট গ্যাপ ঘুচিয়ে শিরোপা নিজেদের করে নেয় জিনেদিন জিদানের শিষ্যরা।
তবে এবারের মৌসুমটা কঠিন ছিল সকল দলের জন্যই। টাইট শিডিউল, নিয়মিত ম্যাচ, কম রেস্ট; সবমিলিয়ে হযবরল অবস্থার মধ্যে খেলতে হয়েছে দলগুলোকে। আর সে কারণেই লা লিগা এসে থেমেছে ৪ ঘোড়ার দৌড়ে। কে জিতবে দেখার আগে দেখে নেওয়া যাক কীভাবে এই জায়গায় এসে পৌছাল চার দল।
- অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ
খালি চোখে লা লিগার মাঝপথে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকেই লা লিগার চ্যাম্পিয়ন বলে মনে হচ্ছিল। কেনই বা হবে না, রিয়াল-বার্সার থেকে ১২ পয়েন্ট এগিয়ে, সিমিওনের ডিফেন্সিভ ট্যাকটিসে কেউ আচড়ও কাটতে পারছিল না। ৬-১ গোলের জয় দিয়ে লা লিগা যাত্রা শুরু, ২০ ম্যাচে ১৭ জয়, ১ হার, ২ ডঃ সিমিওনের ট্যাকটিস ভাঙতে পারা একমাত্র কোচ ছিলেন শুধু জিনেদিন জিদান। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে এসেই খেই হারাতে শুরু করে অ্যাটলেটিকো।
ফেব্রুয়ারির পর থেকে অ্যাটলেটিকো শেষ ১৪ ম্যাচে হারিয়েছে ১৯ পয়েন্ট। বলতে গেলে এক কথায় নিজেদের হাতের কাছ থাকা লিগ এখন পরিণত করেছে চার ঘোড়ার দৌড়ে। অথচ নিজেদের স্বাভাবিক খেলাটা দিতে পারলেই আজ ভালোভাবেই শীর্ষে থাকত তারা। যদিও ৭৩ পয়েন্ট নিয়ে লিগ লিডার তারা, তবে এই ২ পয়েন্টের ব্যবধান ছাড়িয়ে যেতে কতক্ষণ?
- রিয়াল মাদ্রিদ
রিয়াল মাদ্রিদের এই মৌসুম নিয়ে কথা বলতে গেলে একটা জিনিসই বারবার ঘুরে ফিরে আসবে। সেটা হলো ইঞ্জুরি। কার্ভাহালের ইঞ্জুরি নিয়ে ৫৮ তম ইনজুরির মুখোমুখি হলো রিয়াল মাদ্রিদ। এরপরেও যে লিগে টিকে রয়েছে সেটা রিয়ালের সৌভাগ্য বটে! তবে জিনেদিন জিদান তা মানতে রাজি নন, তার মতে রিয়াল টিকে আছে তাদের হার্ডওয়ার্ক আর যোগ্যতা দিয়েই।
কথাটা অবশ্য ভুল নয়। রিয়ালের মৌসুমটা শুরু হয়েছিল ড্র দিয়ে। মাঝে কার্দিজ, আলাভেস, লেভেন্তের মতন দলের কাছে পয়েন্ট খুঁইয়ে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মেরেছে তারা। চার হার বাদ দিলেও আট ম্যাচ মাঠ ছেড়েছে ড্র নিয়ে। ছোট দলের বিপক্ষে হারগুলোই পিছিয়ে দিয়েছে রিয়ালকে।
বার্সা, অ্যাটলেটিকো, সেভিয়ার মাটি থেকে ঠিকই পয়েন্ট বের করে এনেছে রিয়াল, কিন্তু ছোট দলের বিপক্ষে খেই হারিয়ে বারবার লিগে শীর্ষে যাওয়ার সুযোগ হারিয়েছে তারা। এখন ৭১ পয়েন্ট নিয়ে হেড-টু-হেড ব্যবধানে এগিয়ে দ্বিতীয়তে রিয়াল।
- বার্সেলোনা
এই মৌসুমে বার্সেলোনার শুরুটা ছিল সবচেয়ে বাজে। ১০ রায়ন্ড শেষেও তাদের খুঁজে পেতে লিগ টেবিলের নিচের দিকে তাকাতে হতো। অস্বাভাবিক কিছু নয় অবশ্য, কোচের বদল, নতুন ট্যাক্টিস, সবমিলিয়ে নিজেদের হারিয়ে খুঁজছিল তারা। আর সেটা ফেরত পেতে পেতেই বেশ দেরি হয়ে যায় বার্সার।
শেষমেশ ১৮ তম রাউন্ড এসে নিজেদের চ্যাম্পিয়নস লিগ স্পটে খুঁজে পায় বার্সা। এর আগ পর্যন্ত মিড টেবিলে ঘুরতে থাকা বার্সার ট্রাম্পকার্ড ছিলেন বরাবরের মতই লিওনেল মেসি। টানা ২২ ম্যাচ অপরাজিত থাকার পরেও তারা পয়েন্ট হারিয়েছে বড় বড় দলের বিপক্ষে, বার্সা, অ্যাটলেটিকো, সেভিয়ার কাছে।
এমনকি শেষে রাউন্ডে লিগ টপার হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও হেলায় হারিয়েছে তা গেতাফের কাছে হেরে। শুধু তাই নয়, পরের দুই রাউন্ডের জন্য হারিয়েছে নিজেদের কোচ রোনাল্ড কোম্যানকেও। তাই ৭১ পয়েন্ট নিয়ে হেড-টু-হেড ব্যবধানে পিছিয়ে তৃতীয়তে থাকা বার্সেলোনার মাথায় চিন্তার ভাঁজ।
- সেভিয়া
গত দশকে সেভিয়া ইউরোপের বড়সর থ্রেট হয়ে উঠেছে বলাই যায়। নিয়মিত ইউরোপা লিগ জিতে চলেছে, চ্যাম্পিয়নস লিগেও আনাগোনা আছে বৈকি। কিন্তু এই মৌসুমে বেশ ফর্মেই ছিল তারা। কন্সিস্টেন্টও। মাঝে দুই ম্যাচ গেরে ১৬ তম তে নেমে গেলেও খুব সহজেই উঠে এসেছে লোপেতেগির অধীনে।
স্পেনের দায়িত্ব থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল রিয়ালের দায়িত্ব নিবেন বলে। সেখানেও ব্যর্থ হয়ে দায়িত্ব নিয়েছেন সেভিয়ার। আর সেখান থেকেই সেভিয়াকে ঘুরে দাড়াতে সক্ষম করেছেন লোপেতেগি। তার অধীনে ১১ রাউন্ড থেকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ স্পটের আশেপাশেই আছে সেভিয়া। কিন্তু পয়েন্ট বুবধান এত কমাতে পারেনি কখনও। ৩৩ রাউন্ড শেষে ৪ নম্বরে থাকলেও তাদের ঝুলিয়ে পয়েন্ট ৭০।
- ফাইনাল শোডাউন
মৌসুমের এখন বাকি আর পাঁচ রাউন্ড। পাঁচ রাউন্ডে চার দলের শিডিউলও কম শোক্ত নয়।
অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ: এলচে*, বার্সেলোনা*, রিয়াল সোসিয়াদাদ, ওসাসুনা, রিয়াল ভ্যায়াদোলিড*
রিয়াল মাদ্রিদ: ওসাসুনা, সেভিয়া, গ্রানাডা*, অ্যাথলেটিক বিলবাও*, ভিয়ারিয়াল
বার্সেলোনা: ভ্যালেন্সিয়া*, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, লেভান্তে*, সেল্টা ভিগো, এইবার*
সেভিয়া: অ্যাথলেটিক বিলবাও, রিয়াল মাদ্রিদ*, ভ্যালেন্সিয়া, ভিয়ারিয়াল*, আলাভেস*
(*অ্যাওয়ে ম্যাচ)
চার দলের মধ্যে শুধুমাত্র রিয়াল মাদ্রিদেরই এক্সট্রা একটি ম্যাচ খেলতে হবে, তাও সেটি ইংল্যান্ডে গিয়ে চেলসির বিপক্ষে। চ্যাম্পিয়নস লিগে তাদের যাত্রা যে এখনও শেষ হয়নি। ফলে রিয়ালের জন্য অন্য সব দলের থেকে যাত্রাটা একটু বেশি কঠিন। তবে শীর্ষ চার দলের সবারই এখনও কারো না কারো সাথে মুখোমুখি হওয়া বাকি।
সেই দুই ম্যাচই হবে লা লিগা নির্ধারণী ম্যাচ। রিয়াল মাদ্রিদ বনাম সেভিয়া আর বার্সেলোনা বনাম অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। ৩৫ তম রাউন্ডের এই ম্যাচ ডিসাইড করে দিবে কার হাতে আসতে চলেছে এই শিরোপা।
সাদা চোখে এগিয়ে আছে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, যদি না মৌসুমের দ্বিতীয় ভাগের মতন স্লিপ না কাটে তবে সব ম্যাচ জিতলে তাদের হাতেই শিরোপা উঠবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ডিয়েগো সিমিওনেকে নিয়ে। তার ট্যাক্টিসে জেতার থেকে ম্যাচ ড্রয়ে নজর বেশি, যে কারণে মৌসুমের দ্বিতীয় ভাগে এসে পয়েন্ট হারাচ্ছেন তিনি।
অন্যদিকে বার্সেলোনা হারিয়েছে তাদের কোচকে। গেটাফের বিপক্ষে রেফারিকে কটু কথা বলায় তাকে লাল কার্ড দেখিয়ে বের করে দেন রেফারি। ফলে ২ ম্যাচ মাঠের বাইরে থাকতে হবে তাকে। ফলে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের মত বড় ম্যাচ টিভিতেই দেখতে হবে তাকে।
অন্যদিকে রিয়ালের চোটজর্জরিত মৌসুমের মাঝে বাকি চেলসির সাথে চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমির দ্বিতীয় লেগ। সে ম্যাচে জেতা ছাড়া উপায় নেই তাদের। তার সাথে আরো ৫ ম্যাচ, সবচেয়ে বেশি লোড যাবে জিদানের দলের উপর দিয়েই। আর এই তিনদলের সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে সেভিয়ার সামনে ভালো সুযোগ লিগ নিজেদের করার। তাদের শুধু জিততে হবে রিয়ালের বিপক্ষে ম্যাচটা, বাকি দলগুলো পয়েন্ট হারালে এমনিতেই উপরে উঠে যাবে তারা।
বলা বাহুল্য লা লিগা হেড-টু-হেড রেজাল্টের উপর নির্ভর করে। ফলে রিয়াল-বার্সা-অ্যাটলেটিকোর পয়েন্ট সমান হলে রিয়ালই শিরোপা ঘরে তুলবে। ফলে বাকি দুই দলের সেই সুযোগ নেই। ফলে শেষ পাঁচ রাউন্ড হতে চলেছে স্পেনের আরেক মহাযুদ্ধ!