বিশ্বের ইতিহাসের সেরা লেগ স্পিনার কে? অবশ্যই শেন ওয়ার্নের নাম আসবে সবার আগে আসবে। যদিও, শেন ওয়ার্ন আদর্শ মানতেন পাকিস্তানের আব্দুল কাদিরকে। সেই কাদিরের পতাকা পাকিস্তান ক্রিকেটে একালে বহন করে চলেছেন ইয়াসির শাহ।
পুরো ক্রিকেট দুনিয়া তাকে বর্তমান সময়ে সাদা পোশাকের সেরা লেগ স্পিনার হিসেবেই চিনেন। মাত্র কিছুদিন আগে রেকর্ড গড়ে টেস্টে দ্রুততম দুইশো উইকেট শিকারের কীর্তি গড়েন তিনি। শেন ওয়ার্নের পর ক্রিকেট র্যাংকিয়ে বিশ্বে এক নাম্বার হওয়া একমাত্র লেগ স্পিনার তিনি। পাকিস্তানে সাকলাইন মুশতাকের পর এক নম্বর হওয়া দ্বিতীয় বোলার তিনি।
২ মে ১৯৮৬ – খাইবার পাকতুনওয়ার সোয়াবি তে পশতুন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ইয়াসির শাহ। বাবা সৈয়দ খাকি শাহ বাড়িতে ক্রিকেট খেলতে নিষেধ করলেও প্রচন্ড ঠাণ্ডার মধ্যেও তিনি ক্রিকেট খেলতেন লুকিয়ে লুকিয়ে। আর এতে বাবার হাতে যথেষ্ট মারও খেয়েছেন।
আর এভাবেই নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে ক্রিকেটের সাথেই লেগে থাকেন।তার পরিবারের আরো দু’জন প্রোফেশনাল ক্রিকেটার আছেন। পাকিস্তানি পেসার জুনায়েদ খান ও অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটার ফাওয়াদ আহমেদের কাজিন হচ্ছেন তিনি।
সাল ২০০২। পাকিস্তান কাস্টমসের হয়ে তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেক করেন। এছাড়া তিনি পরবর্তীতে আবতাবাদ, সুই নর্দান গ্যাসের হয়েও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলেন। তিনি পাকিস্তান এ দলের হয়েও দীর্ঘদিন ক্রিকেট খেলেছেন। ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট লিগ বিগ ব্যাশে ব্রিসবেন হিটের হয়েও তিনি খেলার সুযোগ পান। এছাড়া পাকিস্তান সুপার লিগে (পিএসএল) পেশোয়ার জালমি ও লাহোর কালান্দার্সের হয়ে তিনি খেলেন।
সাল ২০১১। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তার ওয়ানডে অভিষেক হয়৷ অভিষেকে তিনি দুই উইকেট লাভ করেন। তবে তার পরেও তিনি ওয়ানডেতে থিতু হতে পারেননি। দলে শহিদ আফ্রিদি ও সাইদ আজমলের মতো স্পিন তারকারা থাকায় দলে সুযোগ পাননি ইয়াসির শাহ। ২০১৪ সালে সাঈদ আজমল অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের জন্য নির্বাসনে গেলে দলে সুযোগ পান ইয়াসির।
২২ অক্টোবর, ২০১৪। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আরব আমিরাতে টেস্ট অভিষেক হয় তার। ২০০২ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেক হলেও প্রায় ৯ বছর লাগে তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হতে! অভিষেকের প্রথম ম্যাচেই অজিদের বিপক্ষে ৭ উইকেট শিকার করে জয় এনে দেয় পাকিস্তানকে।
এরপর দ্বিতীয় টেস্টেও তিনি ৫ উইকেট শিকার করেন। সেবার তার অনবদ্য পারফরম্যান্সে পাকিস্তান অস্ট্রেলিয়া দলকে টেস্টে হোয়াইটওয়াশ করে৷ এরপর পাকিস্তান টেস্ট দলে নিজের জায়গা পাঁকা করে নেন তিনি।
সাল ২০১৫। নিজের খেলা মাত্র নবম টেস্টে ৫০ উইকেট শিকার করেন তিনি। দ্রুততম পাকিস্তানি বোলার হিসেবে এই কীর্তি গড়েন তিনি৷ ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই টেস্ট র্যাংকিয়ে তিনি এক নম্বর বোলার হিসেবে উঠে আসেন।
নিজের খেলা মাত্র ১৭ তম টেস্টেই তিনি ১০০ উইকেট শিকার করেন – যা টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের দ্বিতীয় দ্রুততম ১০০ উইকেট শিকার। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি এক ম্যাচেই ১৪ উইকেট শিকার করেন! তার খেলা ৩৩ তম টেস্টে তিনি ২০০ উইকেট শিকার করেন। দ্রুততম বোলার হিসেবে টেস্টে ২০০ উইকেট শিকারের রেকর্ড গড়েন তিনি।
সাদা পোশাকে একের পর এক রেকর্ড করলেও রঙিন পোশাকে তিনি নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি৷ অবশ্য পর্যাপ্ত সুযোগ পাননি বললেও ভুল হবে না। তার ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে লক্ষ্য করা যায় এখন পর্যন্ত তিনি ৪৫ টি টেস্ট খেলেছেন। ৪৫ টেস্টে নিয়েছেন ২৩৫ উইকেট!
আট উইকেটে ৪১ ইনিংস সেরার সাথে ম্যাচ সেরা আছে ১৪ উইকেট। অপরদিকে, ওয়ানডেতে ২৫ ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ২৪ উইকেট, এর মধ্যে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ক্যারিয়ার সেরা ৬ উইকেট শিকার করেন। ২ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেললেও নিতে পারেননি কোনো উইকেট।
সাদা পোশাকের তুলনায় রঙিন পোশাকে তার পরিসংখ্যান একদমই সাদামাটা। তবে পর্যাপ্ত সুযোগ না পাওয়ারও কারণ আছে বটে! তার সময়ে শহীদ আফ্রিদি ও সাঈদ আজমল নিয়মিত খেলায় তিনি সুযোগ পেতেন না। লেগ স্পিনার হিসেবে শহীদ আফ্রিদির পর দলে জায়গা পাকা করে নিয়েছিলেন শাদাব খান! এক বনে তো আর দুই রাজা থাকতে পারে না, যার ফলে রঙিন পোশাকে তিনি রয়ে গেছেন উপেক্ষিতই। তবে সাদা পোশাকে নিজেকে ইতোমধ্যেই নিয়ে গেছেন অনেক উপরে।
২০১৫ বিশ্বকাপে তিনি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অ্যাডিলেডে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলেন। ২০১৬ সালে ৪৯ বছরের ইতিহাস গুড়িয়ে লর্ডসে প্রথম ইনিংসে লেগ স্পিনার হিসেবে প্রথমবার ৫ উইকেট শিকার করেন তিনি। একই বছরের জুলাইয়ে তিনি প্রথমবার আইসিসি টেস্ট র্যাংকিয়ে এক নম্বর বোলার নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালে তিনি পিসিবির বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটারের পুরস্কার জিতেন।
২০১৮ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের হয়ে এক টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেট (১৪) নিয়ে ইমরান খানের পাশে নাম লেখান তিনি। একই বছর ডিসেম্বরে তিনি অজি লেগ স্পিনার ক্ল্যারি গ্রিমেটের ৮৮ বছরের রেকর্ড ভেঙে টেস্টে সবচেয়ে কম ম্যাচে (৩৩) ২০০ উইকেট শিকারের রেকর্ড গড়েন।
বর্তমানে টেস্ট ক্রিকেটের সেরা লেগ স্পিনার হিসেবে ইয়াসির শাহ সবার উপরেই থাকবেন। অমিত প্রতিভা নিয়ে আসা এই বোলার ইতোমধ্যেই ক্যারিয়ারে বেশ কিছু অর্জনের পাশে নিজের নাম লিখিয়েছেন। রঙিন পোশাকে সুযোগ না পাওয়ার আক্ষেপ থাকলেও সাদা পোশাকে দেশ সেরা কিংবা ক্যারিয়ার শেষে বিশ্বের সেরাদের একজন হবার স্বপ্ন নিশ্চই দেখেন তিনি।
ক্যারিয়ার শেষ দিকে এসেও ৩৫ বছর বয়সী এই লেগি যেভাবে প্রতিপক্ষকে নিজের স্পিন ভেলকি দেখিয়ে রেকর্ড গড়ে চলেছেন, অনেক দেরীতে আন্তর্জাতিক অভিষেক হবার আক্ষেপটা হয়তো থেকেই যাবে।