শুধু সেই সেদিনের মালি নেই

কফি হাউজ গানটা মনে পড়ে? মান্না দে এ গানটা গাওয়ার আগে কীভাবে কেঁদেছিলেন? জানা নেই।

হয়তো তিনি স্বয়ং কোথাও খুঁজে বেড়াতেন প্যারিসের বুকে বসে থাকা বন্ধু নিখিলেশ-কে, ক্যান্সারে ধুঁকতে থাকা অমলের কবিতা হয়ত শেষ জীবনে কানে ভেসে আসত, ডি-সুজার কবর থেকে গ্র্যান্ডের সেই গিটারের সুর আসত কানে, একে একে চলে গিয়েছে সবাই, দূরে, অনেক দূরে। তবু তো গানখানা হয়েছিল, নি:সঙ্গতা আর স্মৃতির বুনোটে মান্না গেয়েছিলেন প্রতিটা বাঙালির প্রাণের গান – ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই…’।  

উইকেটের পেছন থেকে সঙ্গী কুমার সাঙ্গাকারা আর নির্দেশ দিচ্ছিলেন না, দু-বলে পরপর বাউন্ডারি খেয়ে গেলে মিড অফ থেকে মাহেলা এসে বলছিলেন না ইয়র্কার দেবার কথা, লাইন লেংথে একটু ভুল হয়ে গেলে দিলশান এসে কাঁধে হাত রাখছে না, নেট প্র্যাকটিসে মুরলির সেই কড়া নজর নেই- তবু তিনি ছিলেন। 

কফি হাউজের সেই ফাঁকা টেবিলে যেন একলা বসে ছিলেন তিনি, চারপাশে পুরোনো মুখ সরে গিয়ে এসেছে নতুন কুঁড়ি, শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের নতুন প্রজন্ম বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ শিরোপার লড়াইতে চেয়ে ছিল সেই বৃদ্ধ সিংহের দিকেই।

স্লিঙ্গা খ্যাত লাসিথ মালিঙ্গা জানেন এই অপরিণত দলটাকে বাকি সমস্ত দল ছিঁড়ে খেয়ে নেবে। তিনি এই দলের সেই বহু যুদ্ধের ক্লান্ত সিংহ যে পাহাড়া দিল শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের পরবর্তী প্রজন্মকে। বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ মঞ্চে নিজের সর্বস্ব দিলেন দলের জন্য, তারপর?

পারিবারিক সমস্যাকে উপেক্ষা করেই তাই যে ফিরে এসেছিলেন বিশ্বকাপে, একটার পর একটা আগুনে ইয়র্কার যখন ব্রিটিশ ব্যাটসম্যানের উইকেট তুলে নিচ্ছিল তখন যেন লংকান সিংহের গর্জন আছড়ে পড়ছিল ব্রিটিশ মক্কায়, অরবিন্দ ডি সিলভা, অর্জুনা রানাতুঙ্গা, সনাথ জয়াসুরিয়াদের  রক্ত যে রয়েছে তার শরীরে। তাঁর প্রতিটা চলনে রয়েছে প্রতিপক্ষকে মেপে নেওয়া।

তাঁর প্রতিটা চাউনি তে রয়েছে প্রতিপক্ষের দূর্বলতা ধরে ফেলার খিদে। এত বছর পর যখন সাদাবলটা চুমু খেয়ে লাসিথ মালিঙ্গা দৌড় শুরু করছিলেন তখন জেগে ওঠে লঙ্কান ক্রিকেটের সমস্ত ঘুমন্ত দৈত্যেরা। যাদের বিক্রমে কেঁপে উঠত ইডেন থেকে মেলবোর্ন, পার্থ থেকে ওয়ান্ডারার্স। 

লাসিথ মালিঙ্গা জানেন তাঁর দৌড়ের শেষ প্রান্তে রয়েছে ৪% সম্ভাবনাকে ১০০%-তে বদলে দেবার ইতিহাস। তাঁর ফিটনেসে ভাঁটা পড়লেও তিনি একা ইংল্যান্ডের মাঠে প্রমাণ করে দিতে পারেন- ‘সিংহ বুড়ো হলেও সিংহই থাকে’! 

তবু তো দিনশেষে তিনি একা হলেন, ভীষণ একা। রাতের শেষ তারাটার দিকে তাকিয়ে তিনি শপথ নিলেন নতুন লড়াই-এর। তিনি নিজের মুঠো শক্ত করে মনে মনে ভাবেন এ পৃথিবীতে সিংহেরা কোনোদিন দল বেঁধে শিকারে যায় না বরং দলবদ্ধ শত্রুকে একা পরাজিত করে ফিরে আসে নিজের ডেরায়।

মালিঙ্গা তো সেই সিংহ যার কোনো এলাকা হয় না। এই পৃথিবীর অবারিত বাইশগজ তাঁর বিচরণভূমি। এখানে ঝড় ওঠে- সেই ঝড় বুকে নিয়ে তিনি নেটে একটু একটু করে তৈরি করে যান শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যত!

এই অবারিত কফি হাউজের শেষ বন্ধু তুলে রাখলেন তাঁর নতুন বলখানা, তবু তো তাঁর বুক দিয়ে আগলে রাখা শ্রীলঙ্কা থেকে যাবে, নতুনের পায়ের ছাপে ফিকে হবে এক অধ্যায়ের ইতিহাস, বেজে উঠবে-

সেই সাত জন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে

সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই,

একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি

শুধু সেই সেদিনের মালি নেই…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link