‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার শেষদিকে একটা দৃশ্য ছিল, সকলে মিলে স্বৈরাচারী রাজার মূর্তি দড়ি দিয়ে টেনে নামাচ্ছে, আর তালে তালে বলছে, ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান।’
জুভেন্টাসের রাজত্বকে ঠিক হীরক রাজার দেশের অত্যাচারী রাজার সাথে মেলানো যায় না, তবুও গল্পের খাতিরে একরম ধরাই যায়। রাজত্ব্য তো আর কম করা হয়নি ইতালিতে। ইতালির সর্বেসর্বা হয়ে উঠা জুভেন্টাসের রাজত্বে হানা দিয়েছে নতুন শত্রু, নতুন না বলে পুরাতনই বলা চলে, কিন্তু সময়ের ব্যবধান এত বেশি যে পুরোনো শত্রুকেও দেখতে নতুন লাগছে। সেই নতুন শত্রু আর কেউ নয়, ইন্টার। আর তাদের ধ্বজাধারী হয়ে আছেন তাদেরই একজন, অ্যান্তোনিও কন্তে!
অ্যান্তোনিও কন্তে যদিও আগেভাগেই উদযাপন করতে মানা করে দিয়েছিলেন, কিন্তু গত সপ্তাহে আতালান্তার বিপক্ষে সাসুলোর ২-০ গোলে জয়ই ইন্টারকে কাগজে কলমে সিরি ‘এ’ জয়ী ঘোষণা করে দিয়েছিল। বাকি ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা। আর সেটাও সেরে ফেলা হয়েছে গতকাল। সাম্পোদিয়ার মাঠে নামার আগে ‘গার্ড অফ অনার’ পেয়েছেন কোচ, খেলোয়াড় সকলে।
সাম্পোদিয়ার কোচ ক্লাউদিও রানেইরি নিজের জীবনের সেরা দিনের কথা ভুলেননি, ভুলেননি লেস্টারকে জয়ী করে মাঠে প্রবেশ করার সময় কীভাবে দুইপাশে দাঁড়িয়ে সম্মান দিয়েছিল চেলসির খেলোয়াড়েরা। জুভেন্টাসের নয় বছরের রাজত্ব ভেঙ্গে সেই সিংহাসনে বসা ইন্টারের অন্তত এটুকু তো প্রাপ্যই। কিন্তু কন্তের কী এমন পরশপাথরে বদলে গেল ইন্টার যা বাকি কোনো ম্যানেজারই করে দেখাতে পারেনি আগে? জুভেন্টাসকে সরিয়ে সিরি-‘এ’র রাজা হওয়ার নৈপথ্যে কোন কন্তে?
- ‘আক্রমণ জেতায় ম্যাচ আর রক্ষণ জেতায় শিরোপা’
স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের অমর বাণী প্রতিটি ক্ষেত্রেই সত্য। ফুটবলে অন্য যেকোনো পজিশন থেকে ডিফেন্সের গুরুত্ব বেশি। একটা ভালো ডিফেন্স পুরো ম্যাচের গতি-প্রকৃতিই পাল্টে দিতে পারে। আর লিগ যখন ইতালিয়ান, তখন তো কথাই নেই। ডিফেন্সের জন্য আজীবন প্রসিদ্ধ ইতালিতে রক্ষণের কারবার গড়বেন এটা আর নতুন কী? তার উপর কোচ হিসেবে একসময় ইতালি কাঁপানো অ্যান্তোনিও কন্তে, সবমিলিয়ে সোনায় সোহাগা হয়েছিল ইন্টারের জন্য।
গত মৌসুমের শুরুতেই ইন্টারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন কন্তে, কিন্তু পুরো মৌসুম কেটে গেলেও নিজের সেরা কম্বিনেশন খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি, যদিও লিগে ভালো করে যাচ্ছিলেন, শেষদিকে জুভেন্টাসকে চিন্তায়ও ফেলে দিয়েছিলেন, কিন্তু কম্বিনেশন পাওয়া হয়নি, কিন্তু এবার পুরো মৌসুম হারিয়ে খোঁজা কম্বিনেশন নিয়ে নিজের সেরা খেলাটা দিয়ে গিয়েছেন কন্তে।
ইন্টারের এই মৌসুম কন্তে খেলিয়েছেন থ্রি-ম্যান ডিফেন্সে। গত মৌসুমেই ইন্টারের সাথে পথচলা শুরু করেছিলেন কন্তে। সে কারণে দলটাকে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছিলেন থ্রি-ম্যান ডিফেন্সে। ডি ভ্রাই-বাস্তোনি-স্ক্রিনিয়ার মিলে ইন্টার আর কন্তের মাথাব্যাথা দূর করে দিয়েছেন শুরু থেকেই।
গত মৌসুমের সেরা ডিফেন্ডার হয়েছিলেন ডাচ ডিফেন্ডার স্তেফান ডি ভ্রাই। আর ২২ বছর বয়সী অ্যালেসান্দ্রো বাস্তোনি হয়েছিলেন সেরা তরুণ ডিফেন্ডার। আর তাদের মাঝে তো অভিজ্ঞ মিলান স্ক্রিনিয়ার আছেনই। আর পেছনে অভিজ্ঞ হাত সামির হান্দানোভিচ, ক্যারিয়ারে কখনও শিরোপার ছোঁয়া না পাওয়ার আক্ষেপে প্রতি মৌসুমে যিনি ঢেলে দিচ্ছিলেন নিজের সেরাটা। গত মৌসুম থেকে নিয়মিত খেলিয়ে গেলেও ঠিক ফলাফল পাননি, কিন্তু একবার যখন থ্রি-ম্যান ডিফেন্সে সেট হয়ে গিয়েছে ইন্টার, তখন থেকেই সব চিন্তাভাবনা ছুটিতে পাঠিয়ে দিয়েছেন কন্তে।
কিন্তু থ্রি ম্যান ডিফেন্সে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে থাকেন উইংব্যাকরা। তারাই মূলত ডিফেন্স আর অফেন্সের সঙ্গযোগকারী হন। মিডফিল্ড কন্ট্রোলাররা মিড নিয়েই এত বেশি ব্যস্ত থাকেন যে অ্যাটাকের সব দায়িত্ব থাকে উইংব্যাকদের উপরে। কিন্তু গত মৌসুমে এই জায়গাতেই হারিয়ে ফেলছিলেন কন্তে।
ক্যান্দ্রেভা, বিরাঘি, অ্যাশলে ইয়ং, ভিক্টর মোজেসদের মতন বয়স্ক খেলোয়াড়দের দিয়ে আর যাই হোক উইংব্যাকের কাজ হয় না। আর সেখানেই এই মৌসুমের সেরা ট্রান্সফারটি ঘটিয়েছে ইন্টার ম্যানেজমেন্ট। রিয়াল মাদ্রিদ থেমে ৪০ মিলিয়ন দিয়ে কিনে এনেছে এই সময়ের সেরা রাইট উইংব্যাক আশরাফ হাকিমিকে। এক হামিকি বদলে দিয়েছে ইন্টারের রাইট উইং। এমনও দিন গিয়েছে যে রক্ষণ থেকে আক্রমণ, পুরো কাজটাই একা সামলে নিয়েছেন হাকিমি।
কিন্তু বড়সর পরিবর্তন এসেছে মিডফিল্ডে। কয়েক মৌসুম ধরেই ইন্টার মিডফিল্ডের ভরসার পাত্র মার্সেলো ব্রোজভিচ। তার সাথে থাকতেন নিকোলা বারেল্লা। কিন্তু এই মৌসুমে এসে মিডফিল্ডে ফ্রিতে যোগ দিয়েছেন দুই তারকা, বার্সা থেকে আর্তুরো ভিদাল আর টটেনহ্যাম থেকে ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন। বলতে গেলে মিডফিল্ড ব্যাটেলে এমন দুই তারকারই দরকার ছিল কন্তের। সেই সাথে বায়ার্ন থেকে ধার কাটিয়ে ফিরেছিলেন ইভান পেরিসিচ। কন্তে নিজের ভাগাড়ে থাকা সকল খেলোয়াড়কেই কাজে লাগালেন সময়মতো।
মৌসুমের প্রথমদিকে ব্রোজোভিচের সাথে অপরিহার্য্য ছিলেন বারেল্লা। দুইজনই বক্স টু বক্স মিডফিল্ডার তার সাথে বারেল্লার ক্রিয়েটিভিটি ছিল চেরি অন দ্যা টপের মতন। তাই তাদের সাথে কন্তের চয়েজ ছিলেন আর্তুরো ভিদাল। মাঝমাঠে খেটে খাওয়া কোনো খেলোয়াড়ের নাম আসলে সেখানে প্রথমেই নাম আসবে ভিদালের। আর সে কারণেই অটো চয়েজ ছিলেন তিনি।
কিন্তু মৌসুমের দ্বিতীয় হাফে এসে যখন আশানরূপ গোল পাচ্ছিলেন না কন্তে, তখনই এরিকসেনের সরণাপন্ন হন কন্তে। ব্যাকলাইন থেকে বল নিয়ে নিজদের হাফ থেকে প্লে-মেকিং করার দায়িত্ব ব্রজোভিচের কাধ থেকে সরিয়ে নিয়ে দেন এরিকসেনের কাধে। পাকাপাকি রেজিস্তা হয়ে যান এরিকসেন।
আর প্লে-মেকিং রেস্পন্সিবিলিটি থেকে ফ্রী হয়ে ব্রোজোভিচ মনোযোগ দেন বল উইনে। ফলে পুরো ইন্টারের খেলার ধরণই ঘুরে যায়, মৌসুমের প্রথমহাফে গোল না পাওয়া ইন্টার, গোলে সয়লাব করে দেয় প্রতিপক্ষকে মৌসুমের দ্বিতীয় হাফে এসে।
স্কোরশীটে হয়তো প্রতিদিন এরিকসেনের নাম দেখা যেত না, কিন্তু ইন্টারের প্রতিটি অ্যাটাকের সুতাকাগার ছিলেন এরিকসেন। ইন্টারের প্রতিটা কুইক কাউন্টারে লুকাকু, লাউতারো, বারেল্লা, হাকিমি, পেরিসিচদের স্প্রিন্ট শুরুর নৈপথ্যের কাহিনীকার এই এরিকসেনই।
এরিকসেনের শুরু করা আক্রমণের শেষটা করতেন রোমেলু লুকাকু আর লাউতারো মার্টিনেজ। লুকাকুর বিশাল বডি দিয়ে বল উইন আর লাউতারোর ডিফেন্স গলে সুরসুর করে বেরিয়ে যাওয়া; দুইয়ে মিলে অনন্য অ্যাটাক আগে থেকেই ছিল ইন্টারের। অপেক্ষা ছিল সঠিক রেইনফোর্সমেন্টের। আর সেটা যখন পেয়েছেন কন্তে, ফলাফলটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন সবাইকে।
গত মৌসুমে ইন্টার ৯৮ টি বড় সুযোগ সৃষ্টি করেছে, আর চার ম্যাচ বাদ থাকতেই এই মৌসুমে ১০৩টি। লাউতারো তার গত সিজনের লীগ গোলের ট্যালি পার করে গিয়েছেন অনেক আগেই (১৬), আর লুকাকুর গোল ২১ টি।
গত মৌসুমের রেকর্ড ভানজ্ঞতে লাগে আরো ২ গোল। গত মৌসুমে স্ট্রাইকার হয়েও চান্স ক্রিয়েশনে সেরা পাঁচে নাম ছিল লুকাকুর। কিন্তু এবার সেরা আর তা নেই, ইন্টারের মিড আর উইংব্যাকরা সেই দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন নিজেদের কাঁধে। আর তার ফলাফল এখন চোখের সামনে।
বারি, সিয়েনা, জুভেন্টাস, চেলসির পর ইন্টার; লিগ জেতাতে জুড়ি মেলা ভার অ্যান্তোনিও কন্তের। গত মৌসুমে ইউরোপার ফাইনাল থেকে এই মৌসুমে জুভেন্টাসের ধ্বজভঙ্গ করে ইন্টারের হয়ে শিরোপা জয়, অ্যান্তোনিও কন্তের জন্য সময়টা আনন্দ মেতে থাকবারই। জয়তু অ্যান্তোনিও কন্তে!