সাল ২০০৬, আগস্টের ছয়। পড়ন্ত বিকেলে জিম্বাবুয়ের হারারে স্টেডিয়ামে তাদের বিপক্ষেই ওয়ানডে ম্যাচ খেলছে সফরকারী দল বাংলাদেশ। সেই ম্যাচে শাহরিয়ার নাফিসের সেঞ্চুরি বা রাজিন সালেহের ৪ উইকেট থেকে একটু বেশিই আলো কেড়ে নিল খুবই পাতলা গড়নের এক ১৯ বছরের তরুণ, দশ ওভার হাত ঘুরিয়ে ৩৯ রান খরচায় ১ উইকেটের সাথে নামের পাশে অপরাজিত ৩০ রান। সাধারণত এই সময়ে জিম্বাবুয়েতে সূর্যের তাপ থাকে বেশ প্রখর, হয়ত অনুজ্জ্বল বাংলার ক্রিকেট আকাশেও সেদিন আবির্ভাব হল এক তেজি সূর্যের, নাম- সাকিব আল হাসান।
সেই যে শুরু, এরপর আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিগত ১৭ বছরে নিজেকে সফলতার এমন শিকড়ে নিয়ে গেছেন নিজেকে সাকিব আল হাসান তার বর্ণনা লিখতে গেলে হয়ত মহাকাব্য না হোক কাব্য নিশ্চিত হবেই। দেশকে বিশ্বের প্রতিটি আসরে প্রতিনিধিত্ব করার যে গৌরব তা শুধু বাংলাদেশের মধ্যে হয়ত সাকিব আল হাসানেরই রয়েছে।
ওভার অল ৪৪৭টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা সাকিব আল হাসান দেশের হয়ে ৩৩.৮৬ গড়ে রান করেছেন প্রায় পনেরো হাজার (১৪৭৩০), নামের পাশে অর্ধ-শতকের “সেঞ্চুরি” আর শতক আছে ১৪টি।শুধু ব্যাটিংয়ের পরিসংখ্যানেই সাকিব দেশের প্রায় সব ক্রিকেটার থেকে এগিয়ে থাকবেন, এবার দেখা যাক তার বোলিং পরিসংখ্যান – ২৮.৪৮ গড়ে ৭১২ উইকেট, ইকোনমি ৩.৯৩, এক ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ২৫ বার, ৪ উইকেট নিয়েছেন ২২ বার, ফিল্ডার হিসেবে ক্যাচ ধরেছেন ১২০টি। বাংলাদেশকে নেতৃত্বাধীন সাকিবের অর্জন ৭২ ম্যাচে ৪৭ জয়, জয়ের গড় প্রায় ৬৩।
তার অর্জন কে নজর আন্দাজ করতে আমরা দুইটি প্যারামিটার দেখি। একটি সফল গুঞ্জন হচ্ছে, সাকিব শুধু দুর্বল দলের সাথেই পারফরম্যান্স ভালো করেন, আরেকটি কথা একটা সময় খুব শোনা যেত যে, সাকিব শুধু নিজের অর্জন নিয়েই চিন্তিত। এই দুইটা প্যারামিটারের সত্যতা যদি আমরা যাচাই করতে যাই তাহলে আমরা দেখতে পাই যে, বাংলাদেশের হয়ে ২৪৭ ওয়ানডে খেলা সাকিব যে ১১৭ টি ম্যাচ জিতেছেন তাতে তার ৫১.৬০ গড়ে রান ৪১২৮ আর বোলিংয়ে ৪.০৭ ইকোনমিতে উইকেট শিকার ১৮৬ টি। যে ১২৪ টি ম্যাচ তিনি হেরেছেন তাতে তার ২৮.২৫ গড়ে রান ৩৩৬২, ৪.৮৪ গড়ে তার উইকেট শিকার ১২৮ টি।
সুতরাং এটা পরিস্কারভাবে দেখা যায়, সাকিবের ব্যাট-বল হাসলেই জিতে যায় বাংলাদেশ, পক্ষান্তরে তার অনুজ্জ্বল দিনে প্রায়ই নিভে যায় বাংলাদেশের আশার ক্ষীণ প্রদীপ। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড,ইংল্যান্ড, আফ্রিকা,ইন্ডিয়া, পাকিস্তানের বিপক্ষেও তার পারফরম্যান্স ঈর্ষনীয়। আর বড় টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স জানতে শুধু ২০১২ এশিয়া কাপ, ২০১৭ চ্যাম্পিয়ান্স ট্রফি, ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের রেকর্ড বুকে একটু চোখ বুলালেই পাওয়া যায়। তার অবদান, কৃতিত্ব সংখ্যায় প্রকাশ করার চেষ্টা করাটাও বোকামি কেননা, এমন হাজারো প্যারামিটারের লাখো পরিসংখ্যানেও সাকিব কে আসলে ডিফাইন করা সম্ভব না।
এত অর্জন থাকার পরও ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান আসলে কেন অপরিহার্য এটি যখন ব্যাখার প্রয়োজন পরে, তখন বুঝাই যায় যে এখানে ক্রিকেটার সাকিবের পাশাপাশি তার ব্যক্তি স্বত্বারও যোগসূত্র চলে আসে ৷ ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান যতটুকু না সফল,আলোচিত ঠিক ততোটুকুই বা তার ও বেশি সমালোচিত তার ব্যক্তিসত্তা। সমালোচনার চাপে, রাজনৈতিক অগ্রহনযোগ্যতা ও নিরাপত্তা ইস্যুতে নিজের দেশের মাটিতে তাই আয়োজিত সিরিজও তিনি খেলতে পারেননি। আদৌ আর জাতীয় দলের হয়ে খেলবেন কি না সে নিয়ে আছে প্রশ্ন।
একজন ‘ক্রিকেটার’-এর বাদ পড়ার কারন হওয়া উচিত পারফরম্যান্স। সর্বশেষ দুই-তিন বছরে ইনজুরি এবং চোখের সমস্যায় টেষ্টে অধিকাংশ সময়ে বিশ্রাম নেওয়া সাকিব কিন্তু সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানে ৪টি টেস্ট খেলেছেন। পারফরম্যান্স আহামরি ভালো না, তবে বাংলাদেশের অবস্থা বিবেচনায় বেশ ভালো। সেটি অন্তত বর্তমানে চলমান আফ্রিকা সিরিজ দেখেও আন্দাজ করা যায়।
দেশের ক্রিকেটে বিগত ৫ বছরের যা অর্জন তা পর্যবেক্ষণ করলে প্রথম সারিতেই সাকিবের নাম পাওয়া যাবে অন্তত টেস্ট এবং ওয়ানডেতে তার সার্ভিস এখনো অপরিহার্যই বটে। রাষ্ট্র, আইন,মানবিকতা, আবেগের জায়গা ধ্রুবক রেখে যদি শুধু ক্রিকেট নিয়েই চিন্তা করি তবে এখনও দেশের ক্রিকেটে সাকিবের প্রয়োজনীয়তা ছোট্টবেলায় লেখা সেই সৃজনশীলের ‘ঘ’ প্রশ্নের উদ্দীপকের মতই অপরিসীম, অপরিহার্য।