বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা নিয়ে আবির্ভুত হওয়া ক্রিকেটারদের একজন সাব্বির রহমান রুম্মন।
এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশকে সোনা জেতানোর ভেতর দিয়ে জাত চিনিয়েছিলেন। তাকে নিয়ে হাইপ ছিলো সেই বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের সময় থেকে। আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে এসেও ঝলক দেখিয়েছেন। লোকে তাকে ‘বাংলার ম্যাক্সওয়েল’ও বানিয়ে ফেলেছিলো। কিন্তু সেই দিন টেকেনি।
বিশৃঙ্খলা, অফ ফর্ম মিলিয়ে জাতীয় দলের রাডার থেকে বেশ দূরে এখন অমিত সম্ভাবনাময় এই ক্রিকেটার। অনেকটা নিভৃতেই এখন নিজে নিজে কাজ করছেন আবার মূল স্রোতে ফেরার জন্য। আর এই সময়ে তার মুখোমুখি হয়েছিলো খেলা ৭১।
নিজের ভুল, ফেলে আসা সময়, ভবিষ্যত লক্ষ্য এবং অনুতাপ নিয়ে কথা বললেন সাব্বির। বারবারই বলতে চাইলেন, এখন তিনি অন্তত পরিণত হয়েছেন। অপেক্ষায় আছেন আরেকটা সুযোগ পাওয়ার জন্য। সেই সুযোগ পেলে কী করবেন, তাও পরিষ্কার করে বলেছেন সাব্বির।
অনেক দিন খেলা নেই। সময় কিভাবে যাচ্ছে?
ঠিকই বলেছেন। খেলা নেই। কিন্তু আমাদের তো বসে থাকার সুযোগ নেই। অনুশীলন করতে হবে। বাসা থেকে সেভাবে বের হতে পারছি না। কিন্তু বাসায়ই কিছু কাজ করা যায়। যেমন ফিটনেস নিয়ে কাজ করা যায়। ছাদে ব্যাট-বল নিয়েও সামান্য কাজ করা যায়। ছোটবেলায় যেমন বল দড়ি দিয়ে বেধে ব্যাট খেলতাম, সে রকমই কিছু করার চেষ্টা করি। অনেক কিছুই করা সম্ভব হয় না। তারপরও যতো দূর পারছি, চেষ্টা করছি।
পরিবার নিয়েও মনে হয় কিছু ব্যস্ততা যাচ্ছে?
শ্বশুর হার্ট অ্যাটাক করেছেন। করোনা পজিটিভ হয়েছিলেন। হার্টে কয়েকটি ব্লক ধরা পড়েছে। ঈদের মধ্যে আর অস্ত্রোপচার করা যাচ্ছে না। হয়তো ঈদের পর এগুলো সমাধান করতে হবে। আসলে পরিবার তো পরিবার থাকবে। তারপরও নিজের কাজগুলো এগিয়ে নিতে হবে।
মাঝখানে কিছুদিন মাইনর (খ্যাপ) ক্রিকেট খেলেছেন।
ক্রিকেটের সাথে থাকার জন্য আসলে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে উইকেট সব সময় চেঞ্জ হয়; এই ধরণের লোকাল ক্রিকেট খেললে নানারকম উইকেটে খেলার অভ্যেস হয়। মাইনর ক্রিকেট খেলেছি খেলাটার সাথে থাকার জন্য। ম্যাচ খেলার চেয়ে তো আর বড় কোনো অনুশীলন নেই। এই জন্যই ম্যাচগুলো খেলার চেষ্টা করছি। সেফটি মেইনটেইন করেই খেলেছি। অনেকটা অনুশীলন ম্যাচের মতোই ছিলো। জাতীয় দলের বাইরের খেলোয়াড়দের অনুশীলনের সুবিধা কম। সেভাবে সুযোগ পাচ্ছিলাম না। ফলে এই ম্যাচগুলো খেলেছি।
বাংলাদেশ দল এখন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আপনি এই দলে থাকতে পারতেন। না থাকার দায় কার?
এটা আমার পারফরম্যান্সের কারণে হতে পারে। অবশ্যই আমি নিজেকেই দোষ দিবো। আমি ৬৬টি ওয়ানডে খেলেছি। এই ম্যাচগুলো খেলার আগে যদি আরো পরিণত থাকতাম, তাহলে আরো কয়েকটা ফিফটি ও সেঞ্চুরি থাকতে পারতো। আমার অভিজ্ঞতা কম ছিলো, আমি তখন ম্যাচিউর ছিলাম না। অভিজ্ঞতা থাকলে আমি ২০-৩০ এর ঘরে আউট না হয়ে ইনিংসগুলো আরো বড় করতে পারতাম। ফিফটিগুলো সেঞ্চুরিতে পরিণত করতে পারতাম। এগুলো হলে হয়তো আরো ভালো কিছু হতো। তবে দলের থেকে বাদ পড়ারও একটা ভালো দিক আছে। নিজেকে শুধরে নেওয়ার সুযোগ আছে। কোভিডের কারণে গত দুই বছর সেভাবে খেলা হয়নি। ফলে নিজেকে প্রস্তুত করাও হচ্ছে না। কিন্তু সময় এখনো আছে। বয়সও আছে। অনেক দিন খেলার ইচ্ছে আছে। ইনশাল্লাহ আমি বিশ্বাস করি আবার কামব্যাক করতে পারবো।
সর্বশেষ ওয়ানডে সিরিজে একটা ফিফটি আছ। বঙ্গবন্ধু কাপেও একটা ফিফটি আছে। তাতে কী একটু সুযোগ আশা করেছিলেন?
সে রকম কিছু মনে করি না। সুযোগ তো আমি পেয়েছি। ৬৬টি ওয়ানডেতে অনেকগুলো ম্যাচে সাত নম্বরে খেলেছি। এই সম্প্রতি মাত্র তিন-চারটা ম্যাচ খেলতে পেরেছি। ফলে খুব বেশি সুবিধা করতে পারিনি, মিস হয়ে গেছে। অনেক চাপ নিয়েছি অনেক সময়। কিন্তু যা চেয়েছি তা হয়নি। কিংবা যা চেয়েছি তার বিপরীত হয়েছে। এ রকম শুধু ক্রিকেটে না, জীবনের অন্য ক্ষেত্রেও এ রকম হয়। আমার কাছে মনে হয় কাউকে দোষ দেওয়া ঠিক না। আমি সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু কাজে লাগাতে পারিনি। সামনে যদি সুযোগ আসে, তাহলে তা কাজে লাগাতে চেষ্টা করবো।
কখনো তিন, কখনো সাত; আপনার ব্যাটিং পজিশনটা আসলে কী—এটা কি আপনি পরিষ্কার হতে পারছিলেন? নিজের রোলটা বুঝতে সমস্যা হচ্ছিলো?
যখন আমি সাতে খেলেছি, আমার ভূমিকা ছিলো একটু বড় শট খেলা। আমি নরমালি ছয়-চার মেরে খেলতে পছন্দ করি। আমার তখন সে রকমই একটা ভূমিকা ছিলো। যখন আমাকে টি-টোয়েন্টিতে তিনে খেলানো হয়েছে, তখন সার্কেলটা ইউজ করে মেরে খেলার ভূমিকা দেওয়া হয়েছিলো। সব মিলিয়ে আমার ভূমিকা ছিলো ঝুঁকি নিয়ে খেলা; আমি এটা পরিষ্কার ছিলাম। এই পরিবেশেই একটা বলেই আমি ব্যর্থ ছিলো। ভূমিকা ঠিক ছিলো— কিন্তু আমি অনেক সময় সফল হতে পারিনি। ভূমিকা পরিষ্কারই ছিলো, কিন্তু আমি সফল হতে পারিনি।
আপনার ওপর প্রত্যাশার চাপ কি একটু বেশি হয়ে গেছিলো? আমি গোল্ড জেতালেন এশিয়ান গেমসে, লোকে ম্যাক্সওয়েল বলা শুরু করলো আপনাকে। আপনাকে নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিলো।
যখন ভালো সময় যায়, লোকে অনেক রকম নাম দেয়। আমি ইতিবাচকভাবে নিতাম এসব। ফ্যান-ফলোয়াররা এ ধরনের নাম দিলে ভালো লাগতো। কিন্তু আমি যথেষ্ট পরিণত ছিলাম না। ফলে এই সময়টা হ্যান্ডেল করতে পারিনি হয়তো ঠিকমতো। বেশির ভাগ সময় আগ্রাসী খেলতে গিয়ে আউট হয়ে যেতাম। কিন্তু গিয়ারটা যদি আরো নিয়ন্ত্রিত রাখতাম, তাহলে হয়তো সব কিছু আরো ভালো হতো। বলবো না এটা অন্য কারো দোষ। সব দোষই আমার ছিলো। আমার মনে হয় আমি ক্যারিয়ারটা গোছাতে পারিনি ঠিক মতো।
আপনি বেশ কয়েক বারই বললেন, আগে পরিণত ছিলেন না। এখন কী তাহলে পরিণত হয়ে উঠছেন?
বয়সের সাথে সাথে মানুষের পরিপক্কতাও বাড়ে। এখন তাই একটু পরিণত তো বলাই যায় আমাকে। যখন পরিপক্ক ছিলাম না, তখন শটস খেলার প্রবণতা বেশি ছিলো। এখন বয়স বাড়ছে, পরিপক্কতাও বাড়ছে। ভালো জায়গায় আবার সুযোগ পেলে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবো।
আপনার বয়স আপনার পক্ষে। অনেক সময় পড়ে আছে। চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত কতোটা?
আমি সব সময়ই অনুশীলন করার চেষ্টা করি, পরিশ্রম করার চেষ্টা করি। মানুষের কাছে হয়তো সব সময় দেখাই না, কিন্তু নিজের কাজটা ঠিক রাখার চেষ্টা করি। এখনো ভালো কোথাও সুযোগ পাচ্ছি না; কিন্তু অনুশীলনটা করার চেষ্টা করছি। বিশেষ করে ফিটনেস ঠিক রাখার চেষ্টা করছি। সুযোগ পেলেই আমি প্রমাণ করার চেষ্টা করবো এটা বোঝাতে যে— আমি টিকে থাকার জন্যই ফিরেছি।
আপনাকে নিয়ে বেশ কিছু শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অভিযোগ উঠেছে নানা সময়ে। ওইগুলো নিয়ে কি কিছুটা অনুতপ্ত?
যে সব বিতর্ক আমার নামের সাথে আছে, সেগুলোর পেছনে কোনো না কোনো কারণ আছে। এক হাতে তালি বাজে না। কিন্তু আমি যদি বলি সেগুলো আমি করিনি, তাহলে ভুল হবে। আবার আমি সেগুলো করেছি, বললেও ভুল হবে। আমার কাছে মনে হয় যে, সেলেব্রিটি হলেই মানুষ খোঁচা দেয়। আমি বিশৃঙ্খলা পছন্দ করি না। নিজের মতো চলতে গিয়ে অনেক সময় ঝামেলা হয়েছে। আমি মনে করি সেগুলো থেকে দূরে থাকা উচিত ছিলো। কারণ আমার ক্যারিয়ার আছে, পারিবারিক জীবন আছে। ফলে ব্যাপারটাগুলো ঠিকমত হ্যান্ডেল করতে না পারায় কিছুটা অনুতপ্ত। আমার আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিলো।
এখন কোনো লক্ষ্য ঠিক করেছেন যে, এটা করতে চাই?
জাতীয় দলে কিভাবে ঢুকতে পারি, সেটাই আমার এখন প্রথম লক্ষ্য। জাতীয় দলে আবার সুযোগ পেলে আমার লক্ষ্য থাকবে যতোদিন সম্ভব দীর্ঘ সময় খেলা, এবং আরো একবার নিজের সামর্থ্য প্রমাণ করা।