লাতিন ফুটবল বড্ড সেকেলে। আজকাল নাকি আর ফুটবলের লাতিন ঘরানা একেবারেই অচল। খোদ কিলিয়ান এমবাপ্পেই তো মুখ ফঁসকে বলে ফেলেছিলেন।
এই অচলায়ন ভাঙতে পারতেন কেবল একজন মাসিহা। হাজার বছর পরে লাতিন পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হওয়া একজন পথ প্রদর্শক। যার পায়ের ফুটবল ছন্দে লাতিন ফুটবলে রচনা করা যাবে নতুন দিনের বিপ্লব।
সেই বিপ্লবটা এসেছিল ১৮ ডিসেম্বর। কাট টু ২০২২। মাসিহার নাম লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। অবশ্য, সেই দিনটার আগেও লিওনেল মেসির নামটা একটা ম্যাটারই ছিল।
কতশত কাব্য তাঁকে নিয়ে তো রোজই করা হয়। কত দিস্তার পর দিস্তা কাগজ খরচ হয়। কত কিবোর্ডে লিখতে লিখতে হ্যাঙ হয়ে যায় কম্পিউটার। কিন্তু, লেখা থামে না। লিওনেল মেসি এমনই এক চরিত্র। তিনি মানেই হাজার গল্প, হাজার কাব্য। মেসি আসলে একটা উপন্যাসের নাম। কিন্তু, সেই উপন্যাস অসংখ্য অর্জনে ঠাঁসা। কিন্তু, একটা অধ্যায় যে একেবারেই ফাঁকা।
ট্রফি কেবিনেটের একটা জায়গা দেখে হয়তো কেবল মেসিই নয়, লক্ষ-কোটি আর্জেন্টাইন সমর্থকের বুকের ভেতরে হাহাকার উঠত। প্রায় ২০ বছরের পেশাদার ক্যারিয়ারে মেসির আক্ষেপ যে ওই একটাই – একটা বিশ্বকাপ, স্রেফ একটা ট্রফি।
২০২২-এর ফাইনালেও শঙ্কা ছিল। ফরাসী মেশিনের সামনে মুহূর্তে মুহূর্তে ম্যাচের রং বদলাচ্ছিল। মেসিও দু’টে গোল করেন।১৯৬৬ সালের পর বিশ্বকাপ ফাইনালের প্রথম হ্যাটট্রিক করেন এমবাপ্পে। কিন্তু, শেষ রক্ষা হল না। টাইব্রেকারে মেসির হয়ে, আর্জেন্টিনার হয়ে লড়াইটা করলেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। ফলাফল, ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ উঠল আর্জেন্টিনার হাতে।
ব্যাস, আক্ষেপের যন্ত্রনা মাটি চাপা দিলেন মেসি। ডিয়েগো ম্যারাডোনার আবারও সেই আর্জেন্টিনা থেকে একজন আসলেন, যার জাদুতে নাচল পুরো ফুটবল বিশ্ব। তবে, এই দিনটা দেখার জন্য নেই সেই ম্যারাডোনা। তিনি থাকলে সেদিন আর্জেন্টিনার বিশ্বজয় যেন পূর্ণতা পেত।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সাথে তাঁর একটা লড়াই ছিল। সেটা এখন অতীত। রোনালদোর তুলনায় মেসি তো এখন দূর আকাশের তারা। যে তারাদের দুনিয়ায় আগেই সামিল হয়েছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা কিংবা পেলেরা। মেসির জন্য অপেক্ষাটা বাড়ল কেবল। আসলে মেসি তো সেই কালজয়ী উপন্যাস যার পূর্ণতা আসে কেবল শেষ অধ্যায়ে গিয়েই।
তিনি ২০২২ সালের বিশ্বকাপ দিয়েই সব জিতে ফেলেছেন। এখন তো লিওনেল মেসির সাধুর জীবন যাপন করা উচিৎ, সেই জীবনে ফুটবল নামক মোহ তো তাঁকে স্পর্শ করার কথা নয়। তবে, নামটা যে লিওনেল মেসি। জীবনের কোনো মোহ তাঁর নেই, কিন্তু ফুটবলে নিত্য-নতুন কীর্তি গড়ায় তিনি আজও এক বিন্দুও ছাড় দেন না।
লিওনেল মেসি বিশ্বসেরা, লিওনেল মেসি সর্বকালের সেরা – এই কথা তিনি যখন বিশ্বকাপ জিতেছিলেন সেবারই সত্য বলে প্রমাণিত হয়। এরপর তিনি যা যা করেছেন, আর ভবিষ্যতে যা যা করবেন – সবই তাঁর অর্জনের মুকুটে একেকটা মুকুট হয়ে যোগ হবে।
তিনি ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের এমন এক অবস্থানে চলে গেছেন, যেখান থেকে সহসাই কারও পক্ষে তাঁকে নামানো সম্ভব নয়! লাতিন ফুটবল গৌরবের ঐতিহ্যও সহসাই বিলীন হবার নয়।