শরীরের ভেতরে অগুন্তি সেলাই। পেইন কিলারের অ্যালার্জিতে তাঁর প্রত্যেকটা জানান দিতে থাকে। কখনো একসাথে, কখনো একটার পর একটা। কখনো আলাদা আলাদা, কখনো সদলবলে জোট বেঁধে। আঠারোর ছেলেটির এই জ্বালা আর সহ্য হত না।
ডাক্তার সেই কবেই বলে দিয়েছেন, খেলার আশা ছেড়ে দাও। তবু মন মানে না। তবু এত কষ্ট কেন? কেন খেলতে না পারার যন্ত্রণার সাথে শরীরের ভেতরে বাইরে চোটের নুনছিটে! এর চেয়ে মৃত্যুও ভালো। এমনই ভাবত ছেলেটা।
ওরম মনে হয় মনের টালমাটাল অবস্থায়। তখন টিন এজার রবার্তো বাজ্জিওরও তাই মনে হয়েছিল । কিন্তু শুরুতেই শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাকে হাওয়ায় উড়িয়ে ফিরে এসেছিলেন খেলায়। তারপরে আবার বড় বিপদকে হারিয়ে ফিরেছেন। এভাবে বারবার ফেরার লড়াইয়ে শেষ হাসি হাসা তাঁরই।
কিন্তু, ১৯৯৪ বিশ্বকাপের ফাইনালের শেষে প্রতিপক্ষ ব্রাজিলের হাতে জয়মুকুটটা তুলে দিয়ে চরম বিষাদ আর তিক্ততা কিংবা দেশজোড়া ক্ষুব্ধ আর হিংস্র সমর্থকদের মুখের দিকে তাকিয়ে ১৮ বছর বয়সের সেই অনুভূতিটাই কি ফিরে আসেনি প্রতিক্ষণে ? ততদিনে তো ধর্ম বদলে ‘বুদ্ধিস্ট’ হয়ে আরো ধর্মপ্রাণ বাজ্জিও। কিন্তু শেষমেষ তিনি মানুষ তো। তাই আরো কয়েক বছর যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানোর পর পাপমুক্তি পেড়িয়ে প্রশ্নটা এলে জবাব দিতে এতটুকু ভাবেন না সুদর্শন। ‘আপনার মনে সম্ভাব্য যা যা আসতে পারে তার সবই এসেছিল আমার মনে’- সরল স্বীকারোক্তি বাজ্জিওর, এক সাক্ষাৎকারে।
১৯৯৪র বিশ্বকাপ। ইতালির সেরা স্ট্রাইকার বাজ্জিও। গোল্ডেন বলের দাবিদারও। অসম্ভব মেধাবী এবং প্রখর অনুমানশক্তির গেমমেকার। দ্বিতীয় স্ট্রাইকার হিসেবেও আতঙ্ক জাগান। বৃত্তের মাঝামাঝি থেকে জালের ওপারে প্রাণের উন্মাদনায় ভরা এক ফুটবলার। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে কখনো প্রতিপক্ষের ঘর ভাঙেন তো নিপাট মিডফিল্ডার হিসেবে নিজের ঘরে সৃষ্টিসুখ আনেন।
চোখ জুড়ায়, মন ভরায়, চিন্তাভাবনা ফুরায় যার খেলা দেখলে। সেবার আমেরিকা মজেছিল বাজ্জিওতে। পাঁচটি গোল করে ইতালিকে নিয়ে গেছেন ফাইনালে। ১২ বছর পর আবার ফাইনালে ইতালী। সবাই ভাবলেন, বাজ্জিওতে এবার বাজিমাত হবে ইতালির, ১৯৮২ সালের পর আবার। ফুটবল বিধাতা কিন্তু আড়ালে হাসছিলেন নিজের মনে।
ক্যালিফোর্নিয়ার রোজ বোলের ফাইনালে প্রায় লাখখানেক দর্শক। তাদের চিৎকারে কান পাতা দায়। দুই বড় শক্তির হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে নির্ধারিত সময়ে গোল হল না। অতিরিক্ত সময় শেষেও ০-০। অত:পর পেনাল্টি শ্যুট আউট। এবং খেলা গিয়ে দাঁড়াল ঐ বিশ্বকাপের অন্যতম নায়ক বাজ্জিওর পায়ে। শিরোপা নির্ধারণকারী পেনাল্টি শ্যুটআউট।
সেট পিস স্পেশালিস্ট হিসেবে তার আগেই ইতিহাসে অমরত্ব মিলেছে তার। ইতালিয়ানরা শটের আগে একশ শতাংশ নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু বাজ্জিওর শটের জেরে বল যেন পাখা মেলে বারের বেশ ওপর থেকে উড়ে গেল কোন অজানায়। হতভম্ব বাজ্জিও কোমরে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে রক্তাক্ত হতে থাকলেন, পেছনে ছুটে আসতে থাকেন ওই শটের জেরে বিশ্বকাপ ফিরে পাওয়া ব্রাজিলের ফুটবলাররা, সামনে হাঁটু মুড়ে গোলরক্ষক টাফারেলের সেকি চিৎকার!
এই ছবিটা বাজ্জিওর খুনে যন্ত্রণার সাথে স্থায়ী হয়ে আছে বিশ্বকাপের ইতিহাসে। এক মুহূর্তে স্বর্গ থেকে পতন, নায়ক থেকে ভিলেন, সিংহাসন থেকে আস্তাকুড়েতে। কি নির্মম এই ফুটবল খেলা! সেই হৃদয়ভাঙা গল্প বয়ে বেড়ানো বাজ্জিও একটু একটু করে স্বাভাবিক হন অনেকদিন ধরে। বলেছিলেন, ‘যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকতে শিখে গিয়েছিলাম।’
তার জীবনটাই তো আসলে একের পর এক লড়াই করে ঘুরে দাঁড়ানোর আর ফিরে আসার অন্তহীন গল্প। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ফুটবল-প্রাণদন্ডের আদেশ পাওয়া বাজ্জিও ফ্রান্সের জমিতে জামিনে মুক্তি পান চার বছর পর। ১৯৯৮’র বিশ্বকাপে। টানা তিনটি বিশ্বকাপে মোট নয়টি গোল করা একমাত্র ইতালিয়ান ততদিনে ঝুঁটিওয়ালা হয়ে গেছেন।
১৯৯৮ সালে ইতালি শুরু করলো চিলির বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। খেলা শেষের পথে। ১-২ পিছিয়ে ইতালি। এই সময় বাজ্জিওর কারণে পেনাল্টি পেল ইতালি। কে নেবেন সে শট? এগিয়ে আসেন দুর্ভাগা বাজ্জিও। সেই ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ হারানো পেনাল্টি শটের পর আর কখনো ভাগ্যের খেলার পেনাল্টি কিক মারেননি তিনি। কিন্তু কারো কারো সাহসের মৃত্যু হয় না কোনদিন।
পেনাল্টি থেকে গোল করে বাজ্জিও হার বাঁচান ইতালির। চার বছর আগের শাপমোচন বা প্রায়শ্চিত্ত ওখানেই। বুকের ওপর থেকে পাথরটা সরে গেলে দীর্ঘ নি:শ্বাস টেনে বাজ্জিও বলেছিলেন, ‘যেন মুক্তির স্বাদ পেলাম।’