প্রেমের পাহাড়ি পথে ইয়েহালির হাসিতে থমকে যাওয়া এক ক্রিকেট জীবন

ওই হাসিটাই তো সারাজীবনের সম্বল। বিশ্বজুড়ে তামাম বোলারদের হৃদয় কামড়ে কাভার ড্রাইভ হাঁকানোর চেয়ে ওই হাসিটাই তো বেশি সুন্দর। ওই হাসিটাই তো শেষ আশ্রয়, ওই হাসিটাই তো দিন শেষে ড্রেসিংরুমে ফেরার তাড়ণা।

মায়ানদীর ধার, ক্যান্ডি লেক। ছোট্ট একটা বসার জায়গা। মৃদু বাতাস। এমন দিনেই তাঁকে বলা যায়। বলে ফেলেছিলেন কুমার সাঙ্গাকারা। বলে ফেলেছিলেন, ভালবাসি।

বলেছিলেন, তুমি আমার চিরকালীন অভ্যাস, তোমাকে ছাড়া আমার দমবন্ধ লাগে। ঠিক তাঁর কভার ড্রাইভের মতই সাবলীল। প্রেম কিংবা ব্যাটিং – দু’টোই তো এমন অকপট হওয়া চাই।

ক্যান্ডি—শ্রীলঙ্কার পাহাড়ঘেরা এক শান্ত শহর। সকালে যখন সূর্য ধীরে ধীরে পাহাড়ের মাথা টপকে আলো ছড়িয়ে দেয়, তখন পুরো শহরটাকে মনে হয় যেন স্বপ্নের ভেতর তৈরি এক ছোট্ট পৃথিবী।

দূরে ক্যান্ডি লেক, যার পাড়ে পাখির ডাক মিশে যায় বুদ্ধ মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনিতে। সেখানেই শুরু হয়েছিল এক মধুর ভালোবাসার গল্প — কুমার সাঙ্গাকারা আর ইয়েহালির।

ট্রিনিটি কলেজের ছাত্র কুমার—সাদা ইউনিফর্ম, কাঁধে ব্যাগ, চোখে স্বপ্ন। ক্রিকেট, টেনিস, পড়াশোনা — সবকিছুর মাঝেও তাঁর মন ছিল অন্য কোথাও। হ্যাঁ, হিলউড কলেজের মেয়েটি, ইয়েহালি, তার হৃদয়ে একদম চুপিচুপি ঢুকে পড়েছিল।

হিলউড কলেজ ছিল পাহাড়ের ঢালে, গাছে ঘেরা সবুজের মাঝে এক পুরনো প্রাসাদের মতো স্কুল। কুমার মাঝে মাঝে ট্রিনিটি কলেজ থেকে বেরিয়ে সেই পাহাড়ি পথে হেঁটে আসত। রাস্তার ধারে জেসমিন ফুলের গন্ধ আর বাতাসে ভেসে থাকা পাখির ডাক যেন তার প্রেমপত্রের ভূমিকাই তৈরি করত।

দু’জনের দেখা হতো গোপনে। বন্ধুরা পাহারা দিত। কুমার ফিসফিসিয়ে বলত, ‘মিশন ওয়াই-তে যাচ্ছি, কাভার করিস তো!’ ওয়াই ফর ইয়েহালি। ক্লাস বাদ দিয়ে, ক্রিকেট প্র্যাকটিসের আগে, কখনও পাহাড়ি পথ ধরে, কখনও বাসস্ট্যান্ড ঘুরে—সব রাস্তা যেত এক দিকেই, ইয়েহালির কাছে।

যখন ইয়েহালি চলে যায় কলম্বোতে, তখন ক্যান্ডির আকাশ যেন একটু বেশিই মেঘলা থাকত। কিন্তু ভালোবাসা তো দূরত্ব মানে না। প্রতিদিন একশো রুপির টেলিফোন কার্ড কিনে, পাহাড়ি শহর থেকে সমুদ্রপারের কলম্বোতে ফোন যেত। প্রেমের লাইন ছিল, কিন্তু তাতে কখনও ব্যালেন্স শেষ হতো না।

ক্যান্ডির সন্ধ্যাগুলোতে, যখন ঝিরঝিরে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যেত পাহাড় থেকে, তখন কুমার কবিতা লিখতের। তার হাতে কলম আর মনে ইয়েহালি। একদিন, সে কবিতাগুলো একত্র করে একটি বই বানিয়েছিল শুধু ইয়েহালির জন্য।

এমন ভালোবাসা ক’জন বাসতে পারে? বন্ধুরা বলত, ‘ও শুধু গিফট দিতে ক্যান্ডি থেকে কলম্বো গিয়ে ফিরে আসত, যেন কিছুই না!’

এই ভালোবাসার গভীরতা এমন ছিল যে, ২০০৩ সালে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে, শুধু ক্যান্ডি নয়, গোটা শ্রীলঙ্কাই যেন আনন্দে ভেসে গিয়েছিল। এখন যখন সাঙ্গাকারার নাম ইতিহাসে লেখা, তার সঙ্গেই লেখা থাকে ইয়েহালির নাম। কারণ মাঠের বাইরে সে ছিল তার সাহস, তার ছায়া।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শত যুদ্ধে লড়াই করা সাঙ্গাকারা জানতেন, যখনই তিনি ফিরবেন, তার ঘরে অপেক্ষা করবে সেই মানুষটি—যে প্রেম শুরু হয়েছিল ক্যান্ডির সবুজ পাহাড়ের কোলে, হিলউড কলেজের জানালা দিয়ে দেখা এক ঝলক হাসিতে।

ওই হাসিটাই তো সারাজীবনের সম্বল। বিশ্বজুড়ে তামাম বোলারদের হৃদয় কামড়ে কাভার ড্রাইভ হাঁকানোর চেয়ে ওই হাসিটাই তো বেশি সুন্দর। ওই হাসিটাই তো শেষ আশ্রয়, ওই হাসিটাই তো দিন শেষে ড্রেসিংরুমে ফেরার তাড়ণা।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Share via
Copy link