১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগে—সব আয়োজন, উত্তেজনা, হিসেব-নিকেশ যখন চূড়ান্ত, তখনই যেন বাজ পড়ল শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে। অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ জানিয়ে দিল, তারা নিরাপত্তার কারণে শ্রীলঙ্কায় খেলতে যাবে না।
শ্রীলঙ্কা হয়ে পড়ল কোণঠাসা। বিশ্ব ক্রিকেটের রাজনীতিতে ভুগতে থাকা শ্রীলঙ্কার পাশে এসে দাঁড়াল ভারত ও পাকিস্তান। ৮৯-৯০ মৌসুমের পর যারা কোনো দ্বিপাক্ষিক ও সিরিজও খেলেনি সেই ভারত-পাকিস্তান এক হল প্রতিবেশি শ্রীলঙ্কার জন্য।
শ্রীলঙ্কার ডাকে সাড়া দিল দুই চিরশত্রু। শুধু সাড়া দিল না, গড়ে তুলল এক অভূতপূর্ব ঐক্যের ছবি। তৈরি করল এক যৌথ দল — উইলস ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ইলেভেন। দলের অধিনায়ক আজহারউদ্দিন, ম্যানেজার ইন্থিখাব আলম।
বাকিদের নাম শুনেই কাঁপন লাগে — শচীন টেন্ডুলকার, সাঈদ আনোয়ার, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, রশিদ লতিফ, অনিল কুম্বলে, অজয় জাদেজা—সব তারকা, এক ড্রেসিংরুমে! আর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে নেমেছিল ক্রিকেট ভক্তদের ঢল।
১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬—কলম্বোর প্রেমাদাসায় অনুষ্ঠিত সেই বহুল আলোচিত ম্যাচ। লঙ্কান একাদশের নেতৃত্বে ছিলেন অর্জুনা রানাতুঙ্গে। সঙ্গে সনাথ জয়াসুরিয়া, রমেশ কালুভিথারানা, আসাঙ্কা গুরুসিংহা, মুত্তিয়া মুরালিধরন, চামিন্দা ভাসরা। অরবিন্দ ডি সিলভা ছাড়া প্রায় পূর্ণ শক্তির দল।
প্রথমে ব্যাট করতে নামে শ্রীলঙ্কা। শুরুটা হয় দু:স্বপ্ন দিয়ে। ওয়াসিম আকরামের বলে শচীন টেন্ডুলকারের হাতে ক্যাচ দেন কালুভিথারানা পরের ওভারেই জয়সুরিয়াকে বোল্ড করে দেন ওয়াকার ইউনুস। ম্যাচ যেন মুহূর্তের মধ্যেই অন্যদিকে।
তবে রানাতুঙ্গা ও গুরুসিংহার ৭০ রানের জুটি কিছুটা পুঁজি এনে দেয়। কিন্তু লোয়ার অর্ডার ব্যর্থ হওয়ায় ৪০ ওভারে থামে ১৬৮ রানে। যৌথ একাদশের পক্ষে বোলিং দুর্দান্ত করেন কুম্বলে — ৮ ওভারে মাত্র ১২ রান দিয়ে ৪ উইকেট! দু’টি দুর্দান্ত ক্যাচ ছিল অধিনায়ক আজহারের হাতে।
জবাবে ব্যাট করতে নেমে সাঈদ আনোয়ার ও শচীন গড়েন এক স্বপ্নের জুটি। একপাশে মারমুখী শচীন, অন্যদিকে ধীরস্থির আনোয়ার। উদ্বোধনী জুটিতেই আসে পঞ্চাশ। কিন্তু এরপর শুরু হয় স্পিন-জাদু। উপুল চন্দনা, মুরালিধরণ —সবাই মিলে তুলে নেন পাঁচটি উইকেট। স্কোর দাঁড়ায় পাঁচ উইকেটে ১২৬! জয়ের জন্য তখনও বাকি ৪৩ রান।
চাপে থাকা ম্যাচে দায়িত্ব নেন জাদেজা ও রশিদ লতিফ। গড়ে তোলেন ছোট অথচ কার্যকর জুটি। ১৬৪ রানে জাদেজা ফিরলে ওয়াকার এসে ম্যাচ শেষ করে দেন। জয় নিশ্চিত হয় যৌথ একাদশের—৪ উইকেটে, ৩৩ বল হাতে রেখে।
কোনো সন্দেহ ছাড়াই অনিল কুম্বলে জিতে নেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার। কিন্তু সেদিন ‘সেরা’ হয়ে উঠেছিল আসলে ক্রিকেটের ভাতৃত্ববোধ। সেদিন জয়ী হয়েছিল ক্রিকেট। হার মানিয়েছিল রাজনৈতিক বৈরিতা ও শঙ্কার মেঘকে। এতকিছুর পরও অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মন গলানো যায়নি। তাঁরা শ্রীলঙ্কায় খেলতে আসেনি।
লঙ্কানরা প্রতিশোধ নিল ফাইনালে। জিতে গেল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ফাইনালের পর রানাতুঙ্গার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল এক চিরস্মরণীয় কৃতজ্ঞতা, ‘আমার অবশ্যই আজহার আর ওয়াসিমকে ধন্যবাদ জানানো উচিৎ। যখন আমাদের ঘোর বিপদ, তারা দল নিয়ে কলম্বোতে এসেছিলেন। তাঁদের প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ।’
কেবল ব্যাট-বলের খেলা নয়, সেদিন প্রেমাদাসায় ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়েছিল এক ‘ক্রিকেটীয় কাব্য’— যেখানে জিতেছিল সৌহার্দ্য আর মানবতা।