সাল ২০০৮।
ওল্ড ট্রাফোর্ডে নিজের প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেছেন লিভারপুলের হয়ে। ম্যাচের প্রথম দিকেই পল স্কোলসকে লেট ট্যাকল করতে গিয়ে হলুদ কার্ড দেখেছেন। ন্যায্য কার্ড বলে টু শব্দটি করেননি। কিন্তু খানিক পর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তুচ্ছ কারণে সতীর্থ ফার্নান্দো তোরেসকে হলুদ কার্ড দেখানো হলো।
রেফারির দিকে তেড়ে গেলেন তিনি। দেখলেন দ্বিতীয় হলুদ কার্ড। এবার মাঠ ছাড়তে হবে। কিন্তু তিনি মাঠ ছাড়বেন না; কোনো অন্যায় তো করেননি। শেষ পর্যন্ত তাকে তুলে নিতে খোদ কোচ রাফা বেনিতেজকে এগিয়ে আসতে হলো। অনেক নাটকের পর মাঠ ছাড়লেন তিনি।
ম্যাচশেষে বেনিতেজ বললেন, ‘ও অন্যায়টা নিতে পারে না। জাত নেতা তো।’
হ্যাঁ, এটাই তার সেরা পরিচয়-জাত নেতা।
জীবনে খুব বেশি সময় আর্ম ব্যান্ড পরা হয়নি। ক্লাব ক্যারিয়ারে তো ঘোষিত অধিনায়ক কখনো ছিলেন না। জাতীয় দলে সামান্য সময় দায়িত্বটা পেয়েছিলেন। তারপরও তিনি একজন অধিনায়ক। বলা হয়, আর্মব্যান্ড না পরা সেরা অধিনায়ক হ্যাভিয়ের আলেজান্দ্রো মাশ্চেরানো।
বার্সেলোনার অনেক সাফল্যের নেপথ্য নায়ক, ইউরোপ কাঁপানো বৈচিত্রময় মাঝমাঠের খেলোয়াড় এবং আর্জেন্টাইন ট্রাজেডির সবচেয়ে বড় স্বাক্ষী মাশ্চেরানো।
মাশ্চেরানোকে আমি সামনাসামনি দেখি ২০১১ সালে।
২০১০ বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট আর্জেন্টিনা দলে তখন তারকার ছড়াছড়ি। লিওনেল মেসি তো আছেনই। সার্জিও আগুয়েরো, অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া, রোমেরো, গুতিয়েরেজের মতো তারকারাও আছেন। কিন্তু মাঠে যখনই দলটাকে রিগ্রুপ করার প্রশ্ন, তখনই দেখি সবাইকে এক জায়গায় করে কথা বলছেন ওই মাশ্চেরানো। মানে, আপনি দায়িত্ব দিন আর নাই দিন, তিনি নেতা।
মাশ্চেরানোকে চেনার সবচেয়ে বড় উপায় হলো তার কমিটমেন্ট, ডেডিকেশন ও স্যাক্রিফাইসটা উপলব্দি করতে পারা। তিনি নিজের দলের জন্য যে কোনো কিছু করতে তৈরী ছিলেন।
রিভারপ্লেটে যখন শুরু করলেন, আর দশ জন আর্জেন্টাইন ফুটবলারের মতো তিনিও হতে চেয়েছিলেন একজন নতুন ম্যারাডোনা। ক্রিয়েটিভ মিডফিল্ডারই ছিলেন। কিন্তু ব্রাজিলের করিন্থিয়াস এলেন ওয়েস্টহামে। সে এক নাটকীয়পর্ব। এক দালালের হাত ধরে তিনি আর তেভেজ এসেছিলেন ইউরোপে। সে নিয়ে কম দূর্ভোগ হয়নি। তাতে হাল ছাড়েননি। নিজেকে ইউরোপের ফুটবলে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন।
লিভারপুলে কার্যত ডিফেন্সিভ মিডলফিল্ডার হিসেবে খেলেছেন। জনাথন উইলসন বলেছেন, তার দেখা সেরা ডেস্ট্রয়ার হলো মাশ্চেরানো। যে কিনা নিজের নামের কথা না ভেবে অনায়াসে প্রতিপক্ষের ক্রিয়েটিভ খেলা নষ্ট করে দিতে পারে। মানে ক্রিয়েটিভ থেকে হয়ে গেলেন ডেস্ট্রাক্টিভ!
মজাটা হলো এই মাশ্চেরানোকে পেপ গার্দিওলা আরও পিছিয়ে সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার বানিয়ে ফেলেছিলেন। সে ভূমিকাতে বার্সেলোনার টিকিটাকাতে দারুন সাফল্যও পেয়েছেন। গার্দিওলার ট্রেবল জয়ের অন্যতম হাতিয়ার ছিলেন মাশ্চে।
মাশ্চেরানোর নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার সেরা রূপটা দেখা গেছে আর্জেন্টিনায়।
২০১০ বিশ্বকাপে তাঁকে অধিনায়ক করেছিলেন ম্যারাডোনা। তার নেতৃত্বে কিছু সত্যিকারের বিউটিফুল ফুটবল উপহার দিয়েছিলো আর্জেন্টিনা। ২০১৪ সালে আলেসান্দ্রো সাবেলা অধিনায়ক করলেন মেসিকে; মাশ্চেরানো সহঅধিনায়ক। তাতে কিছু গেলো আসলো না। মাশ্চেরানো আগের মতই মাঠের জেনারেল হয়ে রইলেন।
সেমিফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে মাথায় আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারালেন। কিন্তু জ্ঞান ফিরে পেতেই মাঠ ছাড়তে আপত্তি করলেন। সেই অবস্থায় খেলে চললেন।
মাশ্চেরানোর এমন সব নিজেকে মাঠে উজাড় করে দেওয়ার গল্প পাতার পর পাতা লেখা যাবে। শেষ হবে না তার বীরত্বের গল্প। এই গল্পে অবশ্য দাড়িটা তিনি টেনে দিয়েছেন। ২০১৮ বিশ্বকাপের পর অবসর নিয়ে নিয়েছেন আর্ন্তজাতিক ফুটবল থেকে। আর গত বছর ক্লাব ফুটবলও ছেড়ে দিয়েছেন এস্তুদিয়ান্তেসের হয়ে খেলে।
এখন হয়তো নিরিবিলি জীবন কাটাচ্ছেন। হয়তো টিভিতে আর্জেন্টিনার খেলা দেখেন সোফায় কাত হয়ে। বুকের মধ্যে একটু মোচড় দিয়ে ওঠে না?
ইশ, একটা ট্রফি!