হাজার ভোল্টের শহীদ আফ্রিদি

স্মৃতির পাতায় অম্লান সেই দৃশ্য। চাইলেও ভোলা যাবে না। গোটা পৃথিবী মিথ্যা হয়ে গেলেও শহীদ আফ্রিদি কখনও মিথ্যা হবেন না।

কাউকে কোনো পরোয়া করবেন না। শেষ বলে ছক্কা হাঁকাবেন, দুই হাঁত তুলে দাঁড়িয়ে যাবেন, একটা এক হাজার ভোল্টের ভূবন ভোলানো হাসি থাকবে ঠোঁটে। বাদামী চুলগুলো শৌর্য্যর প্রতীক হয়ে দোল খাবে বাতাসে। একে একে সতীর্থরা এসে জড়িয়ে ধরবেন। ধারাভাষ্যে কেউ একজন বলবেন, দ্য বুম বুম আফ্রিদি হ্যাজ ডান ইট এগেইন! নাথিং ইজ ইম্পসিবল ফর হিম!

স্মৃতির পাতায় অম্লান সেই দৃশ্য। চাইলেও ভোলা যাবে না। গোটা পৃথিবী মিথ্যা হয়ে গেলেও শহীদ আফ্রিদি কখনও মিথ্যা হবেন না।

শিয়ালকোট, পাকিস্তান। ক্রিকেট ব্যাটের শহর। শচীন টেন্ডুলকারের ব্যাটের কপি বানানোর জন্য ওখানে যেতে হয়েছিল ওয়াকার ইউনুসকে। কিন্তু ১৫–১৬ বছরের এক ছোকড়ার হাতেই জুটল সেই ব্যাটের ভাগ্য। ওয়াকার হয়তো অনুমান করেছিলেন, হয়তো নয়—কিন্তু সেই ছেলেটি পরের বছরগুলোতে ইতিহাস গড়বে। কিংবা ভাবেননি, আসলে শাহিবজাদা মোহাম্মদ শহীদ খান আফ্রিদি কাউকে কোনো কিছু ভাবারই সুযোগ দেন না।

১৯৯৬, কেনিয়া। চার দলীয় ওয়ানডে টুর্নামেন্ট। মুশতাক আহমেদ ইনজুরিতে পড়লেন। লেগ স্পিনারের অভিষেক হল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। প্রথম ম্যাচে ব্যাট ধরেননি, উইকেটও পেলেন না।

পরের ম্যাচ, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। তিন নম্বরে ব্যাট করতে নামলেন শহীদ আফ্রিদি। একটু রান বাড়িয়ে নিতে চাইছিল পাকিস্তান। পিঞ্চ হিটার হিসেবে নেমে গেলেন। তখন ১৬ বছর বয়স, শচীনের ব্যাট হাতে। সেই প্রথম আন্তর্জাতিক ময়দানে ব্যাটিং, আর গড়লেন ইতিহাস।

কি অবিস্মরণীয় এক ইনিংস! তখনকার ক্রিকেট দ্রুততম সেঞ্চুরি। কি অবলীলাল খেললেন! ৩৭ বলে ১১টি ছয়, বিশ্ব তাকিয়ে থাকল অবাক হয়ে। সেই দিনেই জন্ম নেয় বুম বুম আফ্রিদি। জন্ম নেয় একটি বিপ্লব, আজকাল সবাই যেমন ব্যাটিং করতে চায় টি-টোয়েন্টির দুনিয়ায়, সেই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এই ভদ্রলোক।

এরপর নিয়মিত ওয়ানডে খেলে গেলেন। দুই বছর পর টেস্ট অভিষেক, অজিদের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট। ভারতের বিরুদ্ধে ১৪১ রানের ইনিংস। বলেও উইকেট, ব্যাটেও রানের ঝড়। কিন্তু টেস্টে তার স্থায়ী জায়গা হয়নি।

রঙিন পোশাকে তিনি রাজা। মারকুটে ব্যাটিং, লেগ স্পিন—বিশ্ব ক্রিকেটে তিনি সবসময় ফ্যাক্টর। ৯৯ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ১৪১৬ রান, ৯৮ উইকেট। যে কোনো মাঠ, যে কোনো মুহূর্ত, বুম বুম মানেই ম্যাচে জীবন।

১৯৯৬–এর সেই ১৬ বছরের ক্ষুদে কিশোর প্রায় বুড়ো বয়স অবধি ক্রিকেট খেলে গেছেন। কিন্তু, বার্ধক্য তাঁর আদৌ আসেনি। কখনও ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ, কখনও টি-টোয়েন্টি—ব্যাটে-বলেই ঝড় তুলে গেছেন। হয়তো ৪৭ বছর বয়সেও প্রতিযোগীতামূলক ক্রিকেট খেলে গেছেন। তাঁর বয়স নিয়ে বিশ্ব যতটা চিন্তিত ছিল, তিনি কখনও ছিলেন না। তিনি খেলেছেন, উপভোগ করেছেন।

আফ্রিদি বরাবরই ধাঁধা। ম্যাচের মোড় ঘুরতে পারে, বা নাও পারে। আপনি তাঁর ভক্ত হতে পারেন, বা ট্রলও করতে—কিন্তু এড়িয়ে যেতে পারবেন না। তিনি হঠাৎ ছক্কার ঝড় তুলতে পারেন, হঠাৎ আউটও হতে পারেন। অতি দায়িত্ববান হয়ে কখনও পাকিস্তানকে বিশ্বকাপও জিতিয়ে দিতে পারেন, যেমন দিয়েছিলেন ২০০৯ সালে।

এটাই তার বৈশিষ্ট্য। পাকিস্তান জানে, জানে ক্রিকেট বিশ্ব – আফ্রিদি আছেন মানেই সম্ভাবনা আছে, তা আস্কিং রেট যাই হোক না কেন। তাঁর মধ্যে চোখ রাঙিয়ে দেওয়ার পাশবিকতা নেই, যখন কিছু করতে চাইতেন সেটা ব্যাট-বলের মধ্যেই থাকত। যার বলে পেটাচ্ছেন, ম্যাচ শেষে তাঁকেই গলায় জড়িয়ে ধরবেন, মিষ্টি হেসে বলবেন, মাঠের খেলা মাঠেই শেষ।

জন্ম পশতুন গোত্রে, খাইবার সীমান্তে। যুদ্ধবাজ পরিবারের ছেলে। সুফী শিক্ষক ও গোত্রনেতার বংশধর। কিন্তু ক্রিকেটে আসার পথ কঠিন। বড় ভাই এবং সেনা কর্মকর্তা চাচা ক্রিকেটের আলো দেখান। করাচিতে হারুন রশিদের প্রতিবেশী হয়ে শিখলেন ব্যাটিং, কিন্তু নিজে হয়ে গেলেন লেগ স্পিনার।

পাকিস্তান টিম ম্যানেজমেন্ট তাকে কখনো ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেনি। কোচিং ফরম্যাটে মানানো সম্ভব হয়নি। ওয়ানডেতে সফল, টেস্ট খেলেছেন সীমিত সংখ্যক। অধিনায়কত্ব, বল টেম্পারিং, ঝামেলা—সব মিলিয়ে অসীম প্রতিভার প্রকাশ হয়নি পুরোপুরি।

অবসর নিয়েছেন অসংখ্যবার, ফিরেও আসেন। বয়স বেড়েছে, কিন্তু বুম বুম আফ্রিদি মাঠে থাকতে চেয়েছেন চিরকাল। এর ফাঁকে হঠাৎ কোথায় যেন তিনি হারিয়ে গেলেন। বুকটা মুচড়ে ওঠে কখনও, আফ্রিদির নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসে।

আজও যখন ব্যাট হাতে কখনও কোনো দল বিরাট বিপদে পড়ে যায়, আস্কিং রান রেট আকাশে চলে যায় – তখন জানালার ওপাশ থেকে আক্ষেপ আসে, ইশ যদি অসম্ভবকে সম্ভব করতে আফ্রিদি আবারও ফিরে আসতেন।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Share via
Copy link