লড়াই করে বাঁচতে চাই

বলা হয়, নেইমার পিএসজিতে আসেন লিওনেল মেসির তথাকথিত ছায়া থেকে বের হবেন বলে। সবচেয়ে দামি ফুটবলার খুব সহজেই ‘সেটেল’ হয়ে যান প্যারিসে। তার পথ ধরে আসেন উঠতি তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পে। এডিনসন কাভানি-নেইমার-এমবাপ্পে -এই তিনে মিলে তৈরি করেছিলেন ইউরোপের সবচেয়ে মারাত্মক এক আক্রমণ ত্রয়ী।

অবশ্য, নেইমার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেড়ে নেন লাইমলাইটের সব আলো; আর উদীয়মান এমবাপ্পে তার মত করেই হচ্ছেন হেডলাইন। বিশেষ করে বিশ্বকাপের পর এমবাপ্পেও সমান তালে কেড়েছেন আলো। আর এদের পরে সুযোগ থাকলেই কেবল মিডিয়া ও দর্শকমহলে আলোচিত হতেন কাভানি।

অবশ্য তার এই সংগ্রাম নতুন না। এই পিএসজিতেই প্রথম তিন মৌসুমে ইব্রাহিমোভিচকে নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে খেলতে বাধ্য হয়েছে রাইট উইংয়ে। এমনকি নিজের জাতীয় দল উরুগুয়েতেও সুয়ারেজের জন্য প্রায় সময় ভিন্ন পজিশনে খেলেছেন, সুয়ারেজের আগে ছিল ফোরলান।

দলে আরো বড় তারকা থাকায় ওয়ার্ল্ড ক্লাস স্ট্রাইকার হিসেবে প্রায় সময়ই তার সঠিন মুল্যায়নটা পাননি সেভাবে। দেখতে দেখতে বয়সও ত্রিশ পার হয়ে গেছে, আর কি সুযোগ হবে তার নিজের জেনারেশনের সেরাদের তালিকায় আসার?

বিশ্বমঞ্চে উরুগুয়েকে প্রথম প্রতিনিধিত্ব করেন ২০০৭ যুব বিশ্বকাপে। তার আগে সেবছরের জানুয়ারিতে দক্ষিণ আমেরিকান যুব চ্যাম্পিয়নশিপে ৭ গোল করে হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা যেটা এসি মিলান আর জুভেন্টাসের মত দলগুলোকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু তাঁদের কোনো কিছু করার সুযোগ না দিয়েই আরেক সিরি ‘এ’ ক্লাব পালের্মোর প্রেসিডেন্ট মাওরিজিও জাম্পারিনি জানুয়ারির ট্রান্সফার মৌসুমে কাভানিকে ৪.৫ মিলিয়ন ইউরোতে কেনার কথা ঘোষণা করেন।

পালের্মোর হয়ে অভিষেক হয় ২০০৭ এর মার্চে। ফিওরেন্তিনার সাথে ম্যাচটাই দল পিছিয়ে ছিল ০-১ গোলে।  ৫৫ মিনিটে নেমে করেন ভ্যান বাস্তেনের ১৯৮৮ ইউরোতে করা গোলের অনুরূপ একটা গোল।  ডিবক্সের বাইরে থেকে ডান পায়ের দুর্দান্ত ভলি, মাথা নষ্ট করা গোল। পরের মৌসুমের (২০০৭-০৮) শুরুতে প্রথম একাদশে খেলার জন্য সংগ্রাম করতে হয়,  কিন্তু পালের্মোতে তার তৃতীয় মৌসুম শুরু হওয়ার আগে পালের্মোর মেইন স্ট্রাইকার আমাওরি জুভেন্টাসে যোগ দেয়ার পর দলে জায়গা পুক্ত হয় কাভানির।

২০০৮-০৯ সিরি ‘এ’ মৌসুম শেষ করেন ৩৫ ম্যাচে ১৪ গোল করে। তবে শুধু গোলসংখ্যা দিয়ে আসল চিত্রটা বুঝা যাবেনা। ওই সিজনে রোমা আর এসি মিলানের সাথে জয় এসেছিল তার গোলে, আর মোরিনহোর ইন্টারের বিপক্ষে সান সিরোতেই তার ক্লিনিক্যাল ফিনিশিংয়ে ম্যাচ শেষ হয় ২-২ এ। পরের মৌসুমে, অর্থাৎ ২০০৯-১০ এ, আরো দুর্দান্ত ছিলেন কাভানি, বিশেষ করে বড় ম্যাচগুলোতে। ওইবার মোট গোল ছিল ১৫।

ন্যাপোলি, লাজ্জিও, জুভেন্টাস এবং ইন্টারের বিপক্ষে গোল করেন।  ন্যাপলস এর ক্লাব এর চোখ এড়ায়নি ব্যাপারটা। পরের মৌসুমের জন্য পাঁচ মিলিয়ন ইউরো লোন ফি দিয়ে কাভানিকে দলভুক্ত করে নেয় ন্যাপোলি, চুক্তিতে অতিরিক্ত ১২ মিলিয়ন দিয়ে একেবারে কিনে ফেলার অপশনও ছিল। তবে পালের্মোর সাথে ওই মৌসুমের শেষের দিকে স্বদেশি আবেল হার্নান্দেজের কাছে জায়গা হারান। কিন্তু সেটা তাঁর বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নিতে বাঁধা হয়ে দাড়ায়নি।

২০১০ বিশ্বকাপে নিয়মিত প্রথম একাদশে ছিলেন। উরুগুয়ের অবিশ্বাস্য সেমিফাইনাল যাত্রায় অবশ্য ফোরলান আর সুয়ারেজই ডমিনেট করে উরুগুয়ে ফ্রন্টলাইন, তাই তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে জার্মানীর সাথে এক গোল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় কাভানিকে।

বিশ্বকাপ শেষে ফিরেন ক্লাব ফুটবলে। ন্যাপোলির সাথে প্রথম মৌসুম শুরু করেন দারুণভাবে। শীতকালীন বিরতির আগেই করেন ১৭ গোল যেটা ইতিমধ্যেই তার আগের সিরি ‘এ’ রেকর্ড অতিক্রম করে ফেলে। সেবার কাভানির নেতৃত্বে ন্যাপোলি সিরি ‘এ’-তে তৃতীয় হয়ে মৌসুম শেষ করে চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা করে নেয়।

মৌসুমের দ্বিতীয় ভাগে কাভানি ছিলেন ডিসাইসিভ। লাজ্জিও ও জুভেন্টাসের বিপক্ষে করেন হ্যাট্রিক, রোমার সাথে করেন দুই গোল। এই বিধ্বংসী ফর্ম নিয়েই খেলতে যান কোপা আমেরিকাতে। কাভানি, ফোরলান আর সুয়ারেজ নিয়ে গড়া আক্রমনভাগ উরুগুয়েকে ১৯৯৫ এর পর কোন শিরোপা জয়ের স্বপ্ন দেখায়।

কোপাতে কাভানি রাইটেই খেলে, ফোরলান মাঝখানে আর সুয়ারেজ বামে। টুর্নামেন্ট চলাকালীন আবার ইনজুরিতে পড়েন ফলে ফাইনালের আগের নকাউট ম্যাচগুলো খেলেননি। ফাইনালে ৬৩ মিনিটে মাঠে নামেন, ওই ম্যাচে উরুগুয়ে ৩-০ গোলে হারায় প্যারাগুয়েকে। সেই সাথে নিজের দেশের রেকর্ড পঞ্চদশ কোপা আমেরিকা শিরোপা জিতে নেন। সেবারও তার অবদান সামান্যই ছিল ইনজুরির জন্য কিন্তু ইতালিতে ফিরে আবারো নিজের জাত চেনাতে মুখিয়ে ছিলেন।

আগের মৌসুমে লিগে করেছিলেন ২৬ গোল। কিন্তু কাভানির আরো গুরুত্বপূর্ণ ‘ইম্প্যাক্ট’ আসে পরের মৌসুমে। দ্বিতীয় মৌসুমে (২০১১-১২) লিগে ২৩ গোলের পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নকাউট রাউন্ডে নিয়ে যান দলকে।  এই পথে ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে দুই লেগ মিলিয়ে করেন তিন গোল যেটা পরের রাউন্ডে যাওয়ার জন্য অপরিহার্য ছিল।

দ্বিতীয় রাউন্ডে চেলসিকে হোম ম্যাচে ৩-১ গোলে হারানোর পথে করেন এক গোল। দুর্ভাগ্যবশত ফিরতি লেগে নতুন ম্যানেজারে অনুপ্রাণিত চেলসির কাছে নাটকীয় ম্যাচে ৪-১ এ হেরে বিদায় নেয় ন্যাপোলি। চেলসি পরবর্তিতে চ্যাম্পিয়ন হয়। তবে ন্যাপোলি থেকে থাকেনি, সাফল্য আসে সিজনের শেষে।

কোপা ইতালিয়ার ফাইনালে জুভেন্টাসকে ২-০ গোলে হারানোর পথে কাভানি করেন এক গোল। সেই সাথে দিয়েগো ম্যারাডোনা যুগের পর প্রথম কোন শিরোপার স্বাদ পায় ন্যাপোলি। কাভানি করেন পাঁচ গোল। তার হাত ধরে প্রায় দুই যুগ পর ন্যাপলস শহরে চলে রাতভর আনন্দ উৎসব। আর ওখানেই হয়ত কাভানি ঢুকে যান ন্যাপোলির ইতিহাসে।

এরি মধ্যে ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর চাপ শুরু হয়ে যায়।  কিন্তু কোনভাবে আরো এক মৌসুম কাভানিকে ধরে রাখে ন্যাপোলি। ২০১২/১৩ তে নিজেকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যান।  লিগে ২৯ গোলের পাশাপাশি সব প্রতিযোগীতা মিলিয়ে করেন ৩৮ গোল। সিরি ‘এ’র সর্বোচ্চ গোলদাতা হোন আর সেবার ন্যাপোলিকে লিগে দুই নাম্বারে রেখে সিজন শেষে প্যারিসের ক্লাবে যোগ দেন।  কিন্তু সেখানে পুরনো ভূত চাপে আবার।

উরুগুয়ে আর পালের্মোর মতোই পিএসজিতে  ইব্রাহিমোভিচের ছায়ায় থাকতে হয় তাকে।  সুইডিশ তারকাকে জায়গা ছেড়ে দিলেও পরবর্তী তিন মৌসুমে উইংয়ে খেলেই ১৪৭ ম্যাচে ৮১ বার বলকে জালে জড়ান উরুগুয়েইন স্ট্রাইকার। আর যখনি ইব্রাহিমোভিচ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেন – কাভানি তার জাত চেনাতে সময় নিলেন না।

কাভানির ইউরোপে এই প্রথম সত্যিকারভাবে আধিপত্য তৈরি করেন। ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত টানা তিন মৌসুম ইব্রা নামের বটবৃক্ষের ছায়ায় না থাকলে তার গোল সংখ্যা কেমন হতো তা বলা মুশকিল তবে অসংখ্য গোল মিস করার জন্য সমালোচিত হয়েও ২০১৬-১৭ মৌসুমে সব মিলিয়ে ৪৭ গোল করেন। শুধুমাত্র মেসির গোলসংখ্যাই ছিল তার চেয়ে বেশি। অবশেষে হয়ত উনত্রিশে এসে কাভানি দলের ‘মেইন ম্যান’ হতে পেরেছেন।

কিন্তু সেই সুখ আর বেশিদিন থাকলো কই। ইউরোপে সাফল্য পেতে উদগ্রীব পিএসজি বার্সেলোনার সাথে ৬-১ গোলে হারের পর ওই ম্যাচের মূল ঘাতককেই নিয়ে আসে দলে। আর নেইমারের রেকর্ড ব্রেকিং ট্রান্সফারের পর রাতারাতি পালটে যায় পিএসজির চেহারা। হঠাৎ উড়ে এসে দলের প্রধান খেলোয়াড় হয়ে গেলেন নেইমার।

পিএসজি ক্যারিয়ার তিনি শেষ করেছেন ২০০ ম্যাচে ১৩৪ গোল করে। মাঝে বারবার মিসের খেসারত দিতে গিয়ে অন্তত ৫০টার মত গোল কমে গেছে তাঁর। পিএসজি ছেড়ে তাঁর ঠিকানা এখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। সেখানেও ২৬ ম্যাচে করেছেন ১০ গোল।

অথচ বয়স তাঁর ৩৪। জাতীয় দলেও গোলের হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন। এবার যখন উরুগুয়ে কোপা খেলতে নামবে, তখনও তিনি দলের মূল তারকা নন। তবে, কাভানি জানেন কিভাবে আলোটা কেড়ে নিতে হয়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link