সাবিনা, দ্য গোল মেশিন

তাঁর নামের পাশে ’গোল মেশিন’ উপাধিটা অনেক আগে থেকেই জুড়ে দেওয়া আছে। এখন যখন মাঠে নামেন তখন গোল করার ব্যপারে কোন প্রকার দ্বিধা থাকেনা। আর সাবিনার একেকটি গোল এখন যেন ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়েছে। পেশাদার ফুটবলে প্রবেশের পর বাংলাদেশের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে গোলের সেঞ্চুরিতে নিজের নামটি লেখালেন।

মেয়েদের ফুটবল লিগে গোলের সেঞ্চুরি পূরণ করার মধ্যদিয়ে নিজেকে অনেকগুলো রেকর্ডে সঙ্গী করে নিয়েছেন। যেমন দেশে ঠিক তেমনি দেশের বাইরেও সমানতালে গোল করে গেছেন সাবিনা। খেলেছেন ভারত ও মালদ্বীপে। আর সর্বশেষ দুই মৌসুমে মেয়েদের ফুটবলে নতুন জায়ান্ট বসুন্ধরা কিংসের হয়ে খেলছেন। বর্তমান চ্যাম্পিয়নও দেশের ফুটবলে নতুন সেনসেশন এই দলটি। অনেকের মনে হতে পারে সাবিনার গোল সংখ্যা বুধি এই ১০১, আসলে সেটা নয়।

চারটি মেয়েদের লিগ খেলেই গোলের সেঞ্চুরি পূরণ করেছেন জাতীয় দলের এ অধিনায়ক। ২০০৮-০৯ মৌসুমে অনেকটা প্রতিকুল পরিস্থিতিতে ফুটবলটা শুরু করেছিলেন। সমাজে খেলাধুলা করা মেয়েদের অনেকটা অন্য চোঁখে দেখা হয়। সেসবকে টপকে নিজেকে নতুন যুদ্ধে সামিল করে আজ সফল মুখ হয়েছেন। যদি বলা হয় মেয়েদের ফুটবলে বিজ্ঞাপন সাবিনা খাতুন তাহলে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হবেনা। কারণ বাংলাদেশে সাবিনা খাতুন একজনই।

মেয়েদের লিগ শুরু হওয়ার আগেই ২০১০ সালে প্রথমবারের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ মাঠে গড়ায়। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত সেই অভিষেক আসরে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছিলেন সাতক্ষীরার মেয়ে সাবিনা। এরপরের সময়টাকে একেবারে নিজের করে নিয়েছেন।

বয়সভিত্তিক দল থেকে শুরু করে জাতীয় দলে যেন নিজেকে অনন্য হিসেবে প্রমাণ করেছেন। ২০১১ সালে প্রথমবার মেয়েদের লিগ আয়োজন করে। সেবার শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের হয়ে খেলে ২৫ গোল করেছিলেন। দুই বছর পর ২০১৩ সালে দ্বিতীয়বার আয়োজিত লিগে ২৮ গোল করে ধারাবাহিকতা অব্যহত রেখেছিলেন। আর গতবছর তৃতীয় লিগে বসুন্ধরা কিংসের জার্সি গায়ে করেছিলেন ৩৫ গোল!

তিনটা লিগ খেলেই নামের পাশে ৮৮ গোল যোগ করেছিলেন। সেঞ্চুরি করতে এবারের লিগে তার প্রয়োজন ছিল ১২ গোল। সদ্য পুস্করিণীর বিপক্ষে দ্বিতীয় লেগের প্রথম খেলাতেই সেই মাইল ফলকে নিজের নামটি উঠিয়েছিলেন। দলের ৫-০ গোলের জয়ে সাবিনা হ্যাট্টিক করে বসেন। তাতেই গোল সংখ্যা পৌছে যায় তিন অংকের ঘরে, ১০১!

চারটি মৌসুম খেলে শততম গোল করার রেকর্ড কোন বাংলাদেশি ফুটবলারের নেই। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত ১৩টি গোল এসেছে সাবিনার পা থেকে। তবে সংখ্যাটা আরও বাড়তে পারত বলে মনে করেন সাবিনার সাথে খেলা সতীর্থরা। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক, বয়সভিত্তিক, জাতীয় দল আর ক্লাব দল মিলিয়ে গোল সংখ্যা ৩০০ পার করেছেন! গেল নভেম্বরে তার ক্লাব বসুন্ধরা কিংস আবার ২৫০ গোল উৎযাপন করেছিলেন।

সব মিলিয়ে সাবিনা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন তাতে করে গোল সংখ্যা যে কোথায় গিয়ে ঠেকে সেটা বলাই মুশকিল।  ধারাবাহিকতা ধরে রেখে বছরের পর বছর খেলে যাওয়াটা মেয়েদের ফুটবলে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের নাম। সেখানে জয়ী খেলোয়াড়টির নাম সাবিনা। যে সময়ে তিনি যাদেরকে  নিয়ে খেলা শুরু করেছিলেন তাদের সিংহভাগই আর ফুটবলে নেই। সে কারণে সাবিনাকে যে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

তবে যেদিন ক্লাব ফুটবলে গোলের সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন সেদিন তার ক্লাব থেকে বিরাট আয়োজন করা হয়। সেঞ্চুরি লেখা সম্বলিত টি শার্ট সতীর্থদের পরিয়ে দেয় ক্লাব কর্তৃপক্ষ। ১০০ লোগো সম্বলিত বিশেষ ক্রেষ্টও দেওয়া হয় তাকে। সতীর্থরা কোরাসও গাইতে থাকেন। প্রিয় সতীর্থের এমন অর্জনের দিনে রাজধানীল কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল ষ্টেডিয়ামে ছুটে আসেন কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন।

সবমিলিয়ে সদ্য পুস্করিণীর বিপক্ষে হ্যাটট্টিক করে সেঞ্চুরি পূর্ন করার দিনটি অনেক বছর মনে থাকবে তার। অনুভুতিটাও ছিল অনেকটা কৃতজ্ঞতায় ভরা, ‘আমরা ক্লাব বসুন্ধরা কিংস আজকে যেভাবে অভিনন্দিত করেছে সেটি অনেক বেশি সস্মানের ছিল। তাই আমি ক্লাব কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। বিশেষ করে কিংষ সভাপতি ইমরুল হাসান স্যার অনেক বেশি উৎসাহ দিয়ে থাকেন। ক্লাব আমার প্রতি আস্থা রেখেছে তার প্রতিদান দিতে চাই।’

এরই মধ্যে নতুন আরেকটি নামে ডাকা শুরু হয়ে গেছে সাবিনা খাতুনকে। ’ফুটবলের শিল্পী’ ডাকা শুরু হয়ে গেছে এই গোলের রানীকে। সর্বশেষ তিনটি মেয়েদের লিগেই সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জিতেছেন। এছাড়া ২০১৩ সালে জাতীয় মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপেও সর্বোচ্চ গোলদাতার খেতাব জিতেছিলেন।

তবে এবারের লিগে সতীর্থ কৃষ্ণা রানী সরকারের চেয়ে ৪ গোল পিছিয়ে রয়েছেন সাবিনা। এখন ফুটবলার হিসেবে অবসর নিয়ে ফুটবলের সঙ্গেই থাকতে চান সব ধরনের ফুটবল এখন পর্যন্ত ৩৭১ গোল করা সাবিনা। গেল ছয় বছর ধরে জাতীয় দলের অধিনায়ক সাবিনা এসএ গেমস, সাফ, এএফসি, ফুটসাল, প্রীতি টুর্নামেন্ট ও ক্লাব ফুটবল মিলিয়ে এরই মধ্যে খেলেছেন ১৩৩ ম্যাচ। জাতীয় দলে ৩৭ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন ১৯টি। ঘরোয়া ফুটবলেই তার গোল সংখ্যা ২৭৯টি! যা বাংলাদেশের মেয়েদের তো বটেই ছেলেদের ফুটবলেও এক বিরল রেকর্ড।

যে কারণে সাবিনাকে মনে রাখবে ফুটবল –

  • বয়সভিত্তিক, লিগ আন্তর্জাতিক আসরে ৩৭১ গোল!
  • শুধুমাত্র ঘরোয়া ফুটবলে করেছেন ২৪৯ গোল।
  • জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ ১৯ গোল তার।
  • এখন পর্যন্ত টানা তিনটি লিগে আলাদা তিনটি ক্লাবের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতার খেতাব জিতেছেন।
  • সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন জাতীয় মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে।
  • সর্বোচ্চ হ্যাটট্টিক করেছেন ঘরোয়া ফুটবলে
  • ২০১৯-২০ মৌসুমে এক লিগে সর্বোচ্চ ৩৫ গোল।
  • বসুন্ধরা কিংসের হয়েছে এখন পর্যন্ত করেছেন ৪৮ গোল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link