মুখ বুজে রোজারিওর সাইডলাইনের ধারে বসে মেসি। কিছুক্ষণ পরেই মাদেইরার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো কাছে এসে মেসির হাতটা টেনে তুলে বলে – ‘চল ওঠ, এখনও খেলা বাকি।’ — নেহাতই কাল্পনিক একটি গল্প।
কিন্তু, একটু অন্যভাবে ভেবে দেখলে,ইউরোপ আর দক্ষিণ আমেরিকার দুই মশালবাহক সত্যিই কি একসাথে হেঁটে যাচ্ছেন না রোলার কোস্টারের পথে? একটু অন্যভাবে ভেবে দেখলে অর্বাচীনের মতো আমাদের পরস্পরবিরোধী দাগ লাগিয়ে দেওয়া ফুটবল নক্ষত্রযুগল কি একই আকাশে থেকে পথ দেখাচ্ছেন না দেশজ ফুটবলকে? কোথায় বিরোধ! কোথায় দ্বন্দ্ব!রোজারিওর লিয়োনেল আর মাদেইরার ক্রিশ্চিয়ানো সেই কবে থেকেই ফুটবলে গেয়ে চলেছেন – ‘আরও আলো, আরও আলো, এই নয়নে প্রভু ঢালো।’
সমান্তরালভাবে বয়ে চলা এই ইউরো কাপ আর কোপা আমেরিকা কিন্তু কখনও পরস্পরভেদী ফুটবলরেখা হয়ে দাঁড়ায়নি, বরং দিনে দিনে তা হয়ে উঠছে সমান্তরাল, পরিপূরক।ইউরোতে ক্রিশ্চিয়ানো দেখিয়ে চলেছেন স্টেপওভারের নকশা। কোপায় মেসি দেখিয়ে চলেছেন ফ্রি-কিকের বক্রপথ। এমন মেনু কার্ড ফুটবল-খাদকেরা আর পাবে কি?
কোপা আমেরিকা কি সত্যিই শুধু লাথালাথির খেলা? সেখানে কি সত্যিই মেসি একা টানছেন আর্জেন্টিনাকে? অন্যদিকে ইউরো কাপের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো কি সত্যিই অতোটা সাহায্য পাচ্ছেন না দিয়োগো জোটা কিংবা ব্রুনো ফারনানদেজের কাছ থেকে? আলোচনা তাত্ত্বিক হোক কিংবা দার্শনিক, ইউরোর রন আর কোপার লিও-এর ফুটবলশিল্পের ভিতর যদি বিজ্ঞান খোঁজার চেষ্টা করা হয়, তবে মন্দ কি?
আর্জেন্টিনা আন্তর্জাতিক ট্রফি পায়নি দীর্ঘ বৎসরব্যাপী। তাঁদের দরকার ছিলো এমন একজন কোচের যিনি হবেন পুরোটাই ক্যালকুলেটিভ। লিওনেল স্ক্যালোনি কিছুটা এরকমই কোচ। ফুটবলবিজ্ঞান যদি মানা হয়,তবে দেখা যাবে আর্জেন্তিনা দল নামাচ্ছে ৪-৩-৩ এ। কিন্তু খেলার সাথে সাথে তারা বদলে যাচ্ছে ৪-৪-২ ডায়মন্ডে।
এটা করতে গেলে উপরের তিন ফরোয়ার্ডের একজনকে নিচে নামতে হয়। তাহলে নিচে নামছেন কে? — লিওনেল মেসি। ৪-৪-২ ডায়মন্ড ফর্মেশন ফলপ্রসূ হতে গেলে এই নিচে নামা ফরোয়ার্ডকে হতে হবে কঠিন এবং একইসাথে শিল্পী। এরকম উদাহরণ মেসি ছাড়া আর কেইবা আছে লা আলবিসেলেস্তেদের। ৪-৩-৩ এ মেসি শুরু করছেন ডানদিক বেয়ে, যেটা তিনি বার্সেলোনায় খেলতেন লুই এনরিকের সময়ে।
কিন্তু, ম্যাচের মাঝখানে আর্জেন্তিনা ৪-৪-২ ডায়মন্ডে আসলে, মেসি হয়ে যাচ্ছেন অফেনসিভ মিডফিল্ডার। মেসি কিন্তু পুরোপুরি ফলস নাইন হিসাবে খেলছেন না৷ কারণ ফলস নাইন হলো ডিপলাইয়িং ফরোয়ার্ড আর সেটা হতে গেলে ফরমেশন হয়ে যায় ৪-৪-১-১। উরুগুয়ে ম্যাচটা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ৪-৪-২ ডায়মন্ডে খেলে সুয়ারেজ-কাভানিদের জালে ফাঁসালো আর্জেন্টিনা।
তাতে খেলা বিশ্রী হোক না, ক্ষতি কি! এই ৪-৪-২ ডায়মন্ডে মেসির কাজ সবথেকে বেশি। মেসি ডানদিক বরাবর শুরু করে বিপক্ষের অনেকগুলো ম্যান টেনে নিচ্ছেন নিজের দিকে। এর ফলে ক্রিয়েট হওয়া স্পেসে আক্রমণে যেতে পারছেন মোলিনা-ডি পলেরা। আবার ফর্মেশন যখন ৪-৪-২ এ বদলাচ্ছে, মেসির ভূমিকা হয়ে যাচ্ছে মিডল থার্ড আর অ্যাটাকিং থার্ডের মধ্যেকার লিংকিং মিডফিল্ডারের, এতে করে গঞ্জালেজ কিংবা মার্টিনেজ আরও বেশি করে অ্যাটাকে যেতে পারবেন।
আবার ম্যাচ যখন শেষের দিকে লিওনেল মেসি তখন ডানদিকের সাইডলাইন দিয়ে ক্রমাগত ড্রিবল করে বিপক্ষের সময় নষ্ট করছেন, কখনও বা বিপক্ষকে ফাউল করতে বাধ্য করছেন। একটা ম্যাচে একজন খেলোয়াড়ের এতোগুলো রোল। একই সাথে কঠিন মানুষ ও শিল্পী মানুষের দ্বৈত ভূমিকা—ফুটবলের মহানায়ক ছাড়া এমন কাজ সম্ভব নয়। অপরদিকে পর্তুগিজ মহাতারকাও যে পিছিয়ে নেই। আর্জেন্টাইন মহানায়ক যদি কোপা আমেরিকায় রেকর্ড ১০ গোল-১০ অ্যাসিস্টের মালিক হন, তবে তাঁর পোর্তুগিজ পরিচালকও কিন্তু ইউরোর সর্বোচ্চ ১৪ গোলের মালিক। এখন যদি ইউরোর পোর্তুগালকে নিয়ে ফুটবল অ্যানাটমি পড়তে বসা হয় তবে দেখা যাবে, দ্রোন ফারনান্দো সান্তোস আর তাঁর অর্জুন ক্রিশ্চিয়ানোও কিন্তু পিছিয়ে নেই।
সান্তোস কখনও পর্তুগালকে খেলাচ্ছেন ৪-১-৪-১ এ, কখনও বা খেলাচ্ছেন ৪-২-৩-১ এ। দুটোই খানিকটা এক, কিন্তু তফাৎ একজায়গাতেই—একটাতে সিঙ্গেল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার, অপরটাতে ডাবল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। কিন্তু উভয়ক্ষেত্রেই ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো থেকে যাচ্ছেন লোন স্ট্রাইকার। কিন্তু, ক্রিশ্চিয়ানোর ভূমিকা শুধু এইটুকুই — ভাবাটা ভুল।
বার্নাডো সিলভা যখন ম্যান টানছেন, ক্রিশ্চিয়ানো তখন স্পেস দিয়ে হয় বল বাড়িয়ে দিচ্ছেন ব্রুনো-জোটাদের, না হলে নিজেই স্টেপওভারের নকশা কাটতে কাটতে এগিয়ে চলেছেন ‘জালের সন্ধানে’। হাঙ্গেরির বিপক্ষে রোনালদোর ওই শেষ মুহূর্তের ইনসাইড-আউটসাইডটা দেখলেন? কিংবা জার্মানির দুজনের পাশ ঘেঁষে ওভাবে অফসাইড এড়ানোটা? — ‘আহা, কি নয়নাভিরাম এ দৃশ্য!’
ক্রিশ্চিয়ানো আর লিয়োনেল কি সত্যি বুড়িয়ে গেছেন? রোনালদোর ইনসাইড-আউটসাইড ডজে নেওয়া শট রুখতে পারেননি হাঙ্গেরির পিটার গুলাকসি, মেসির বাম পায়ে নেওয়া ফ্রি কিক ঝাঁপিয়ে পড়েও রুখতে পারলেন না চিলির ক্লডিও ব্রাভো। জার্মানদের অফসাইড ট্র্যাপ ছিঁড়ে যায় রনের পায়ে, আবার ডানদিকে সাইডলাইনের দর্শক দেখে লিও-এর পায়ে কাবু হয়ে যাচ্ছেন উরুগুয়ের পাঁচ-পাঁচজন। এবারের কোপা আর ইউরো কি সত্যিই দেখিয়ে দিলো না আধুনিক ফুটবলের সত্যতম বচনটি—ক্রিশ্চিয়ানো বুড়োবেন না, লিওনেল ফুরোবেন না!
রোজারিওর সাইডলাইন আর মাদেইরার ডি-বক্সে এক আশ্চর্য নকশাপথে এগিয়ে যাচ্ছেন লিওনেল আর ক্রিশ্চিয়ানো। একজন লড়ছেন বহুদিনের কাঙ্খিত আন্তর্জাতিক ট্রফির জন্য। আরেকজন লড়ছেন অনেক শ্রম দিয়ে পাওয়া ট্রফিকে ধরে রাখার জন্য। কিন্তু উভয়েরই সেই সংকল্পবদ্ধ চোখের দৃষ্টিতে মুছে যাচ্ছে ক্লাব বনাম দেশের কলহ, মুছে যাচ্ছে মহামারী আক্রান্ত পৃথিবীর ব্যথা। লিও-এর পা আর রনের হেডের চেয়ে বড়ো মহৌষধ আছে নাকি আজ পৃথিবীতে?
দেশ, ক্লাব, এনডোর্সমেন্ট, বিরোধ, মহামারী — এসব কিছুকে পিছনে ফেলে ইউরোর ডন আর কোপার ম্যাজিশিয়ান আজ ফুটবল খেলে যাচ্ছেন শুধু ফুটবলের জন্যেই।ঘনায়মান মেঘ সরিয়ে আলো ফুটছে ইউরোপ-দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল গ্যালারিতে। রাত জাগছে বাঙালি ক্রিশ্চিয়ানোর জন্য। ভোরে উঠছে বাঙালি লিওনেলের জন্য। কোথায় বিরোধ, কোথায় দ্বন্দ্ব! তাঁরা তো একসাথেই বলে চলেছে — ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরও আরও আরও দাও ‘পাস’।