শাখতার সাতকাহন

১.

পঞ্চান্ন হাজার দর্শক আসনের একটা স্টেডিয়ামের ওপর আঘাত এল পরপর দুবার৷ প্রথমবার একটা শেল ফাটল। তার জবাবে উড়ে এল রকেট৷ মুহূর্তে বিধ্বস্ত স্টেডিয়ামের ছাদ, পশ্চিম দিকের গেট। বিধ্বস্ত অবশ্য শুধু স্টেডিয়াম নয়, গোটা একটা প্রদেশ।

২০১৪ সাল থেকে ঘরছাড়া প্রায় দেড়লাখের বেশি মানুষ। মারা গেছেন ১৩ হাজার মত। রোজ রাত দশটার পর কার্ফু, চলে ভোর চারটে অবধি৷ একের পর এক কয়লাখনি, হোটেল, ব্যাংক বন্ধ পড়ে রয়েছে৷ নষ্ট হয়ে গিয়েছে অজস্র টেলি কমিউনিকেশনের লাইন, প্রদেশের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর৷ নেই-রাজ্যের মালিক এখন- রাস্তায়, অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ানো হাই হিল বুট আর গুলির আওয়াজ।

আর আছে ফুটবল।

এখনো শহর ছেড়ে চলে যাননি যারা, প্রদেশের পুরোনো স্টেডিয়ামে তারা জড়ো হন নিয়মিত। ছোট্ট একটা প্রিমিয়ার লিগ তাঁদের। প্রিমিয়ারশিপের বিজয়ীরা, আমন্ত্রণ জানায় পড়শি শহর লুশাঙ্কের ক্লাবগুলিকে৷ বিজয়ীর গলায় ওঠে প্রদেশ সেরার শিরোপা। পঞ্চাশ হাজার করতালি, চিৎকার, হাসি-কান্না-আবেগের জায়গায় জনা একশো লোক তাঁদের পছন্দের দলের গলায় তুলে দেয় বরমাল্য। ফুটবল আছে, যদিও এ শহরের প্রাণভোমরা ছিটকে গেছে অনেকদূর।

২.

স্বাধীন ইউক্রেনের একেবারে পূর্বদিকের অঞ্চল ডোনবাস প্রদেশের এক বিপুল অংশ জুড়ে রয়েছে কয়লাখনি। পুরোনো সোভিয়েত আমলে রাষ্ট্রায়ত্ত এই সমস্ত খনির কাজে সোভিয়েত রাশিয়ার বিভিন্ন প্রদেশ থেকে কাতারে কাতারে মানুষ ভিড় করেন এই ডোনবাস প্রদেশে। অধিকাংশই রাশিয়ান। কিছু কিছু অন্য প্রদেশের।

হাজার হাজার এই সব পরিযায়ী মাইন শ্রমিকরা তৈরি করেন তাঁদের নিজের ফুটবল ক্লাব। ৩০ দশকের সোভিয়েত শিল্পায়নের পোস্টার বয়, আলেক্সি স্তাখানভের নামে ডোনবাস অঞ্চলের এই ক্লাবের নাম হয় স্তাখানোভেৎস। মাইন শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বের রুপক হিসেবেই ক্লাবের জার্সির রং হয় কমলা ও কালো।

ষাটের দশকে, স্তাখানোভেৎস নাম বদলে এই ক্লাবের নাম হয় শাখতার। ইউক্রেন তথা পুরোনো সোভিয়েত ফুটবলে ডায়নামো ক্লাবগুলির চিরাচরিত দাপটের বিপ্রতীপে ওই ষাটের দশকেই পরপর দু’বার সোভিয়েত কাপ জিতে নেয় শাখতার। এরপর আশির দশকে আরো দু’বার।

আশির দশক থেকে ভাগ্য বদলাতে থাকে ডোনবাস প্রদেশের৷ গোরবাচেভের পেরেস্ত্রৈকার সুযোগ নিয়ে সমস্ত ডোনবাস প্রদেশে সক্রিয় হয়ে ওঠে একদল মাফিয়া। কয়লাখনিতে প্রচুর টাকা, আর সেই টাকার বখরার জন্য প্রদেশের মাইন ও ফ্যাক্টরির সোভিয়েত অফিসিয়ালদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে থাকে এই মাফিয়াগোষ্ঠী। এই মাফিয়াদের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত মাফিয়া ছিলেন আখাত ব্রাগিন।

ডোনবাস জুড়ে যার পরিচিতি ছিল ‘আলিক দ্য গ্রিক’ নামে। আটের দশকের শেষ দিকে গোটা ডোনবাস প্রদেশের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠেন ব্রাগিন। মাফিয়া ব্রাগিনের ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার গল্প শুরু হয় ১৯৮৮ সালে, প্রদেশের বিখ্যাত বাজার ওখতিয়াব্রস্কের দখলদারি ও বেসরকারিকরণের মধ্যে দিয়ে।

এরপর নিজের কোম্পানি লিউকস তৈরি, ‘ডোংগরব্যাঙ্ক’( ডোনেস্ক সিটি ব্যাঙ্ক)-এর খরিদারি ও তারপরেই মাইন শ্রমিকদের ক্লাব শাখতার ডোনেস্কের ওপর হাত পরে ব্রাগিনের৷ ততদিনে নতুন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে ইউক্রেন। গোটা প্রদেশ জুড়ে নয়ের দশকে অপরাধের পারদ চড়ছে ক্রমশ। একের পর এক ব্যবসায়ীর( মাফিয়া?) খুনে নাম জড়ায় ব্রাগিনের। শাখতারের নামও জড়াতে থাকে বিপুল টাকাপয়সা লুঠ ও অন্যান্য নানা কারণে।

স্বাধীনতা পরবর্তী ইউক্রেনের আরেক ক্লাব, ডায়নামো কিয়েভের মতোই, ব্রাগিন শাখতারকে ঘিরে এক ছোটখাটো সাম্রাজ্য তৈরি করেন। হোটেল ব্যবসা, নিজস্ব খবরের কাগজ তৈরি, শাখতারে ততদিনে বিপুল টাকাপয়সা লেনদেন, অপরাধ ও গ্যাংওয়ারের এপিটাফ হয়ে উঠেছে৷

এই গ্যাংওয়ারের সম্ভাব্য পরিণতি হিসেবেই ১৯৯৫ সালে ডোনেস্ক বনাম সিম্ফারপুলের ম্যাচে ডোনেস্কের পুরোনো স্টেডিয়ামের ভিয়াইপি বক্সে বোমার হামলায় নিহত হন ব্রাগিন। শোনা যায়, দীর্ঘদিন ধরে যে গ্যাংওয়ার ডোনবাস জুড়ে চলে আসছিল, সরাসরি তার কারণেই মৃত্যু হয় ব্রাগিনের৷

ব্রাগিনের মৃত্যুর পর ডোনবাস ও ইউক্রেন জুড়ে তার বিপুল সাম্রাজ্য ও ফেলে যাওয়া ক্লাব শাখতার ডোনেস্কের অধিপতি হন তাঁরই সেকেন্ড ইন কম্যান্ড রিনাত আখমেতভ। ততদিনে সিলভিও বার্লুসকোনির নাম সারা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে৷ ফুটবল তার চিরাচরিত প্যাটার্ন ছেড়ে ক্রমশ এক নতুন মোড়ক নিচ্ছে।

ব্রিটিশ ফুটবলের প্রিমিয়ারশিপে বদল, বার্লুসকোনির মিলানের চূড়ান্ত সাফল্যের সিঁড়িতে পা রাখা, একের পর এক ক্লাবের মালিকানার স্বত্বা সমষ্টির হাত থেকে ক্রমশ ওয়ান পার্টি ইনভেস্টরের হাতে চলে যাওয়ার হাত ধরে ফুটবল হয়ে উঠছে এক গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট৷ টাকা ঢাললে গোল আসে, গোল এলে আসে জনপ্রিয়তা আর জনপ্রিয়তার হাত ধরে আসে বিপুল ব্যবসা অথবা রাজনৈতিক ক্ষমতা।

সোভিয়েত-উত্তর রাশিয়া ও ইউক্রেনও হাঁটলো এক রাস্তায়। মস্কোর সেন্ট্রাল হাই কম্যান্ড থেকে বেরিয়ে প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্টের অবারিত দ্বার হয়ে উঠল দুই দেশের ফুটবল ক্লাবগুলো। সমগ্র ইউক্রেন জুড়ে তৈরি হল অলিগার্ক নিয়ন্ত্রিত এক ফুটবল আমলাতন্ত্র।

ঠিক এই পরিস্থিতিরই সুযোগ নিলেন আখমেতভ। ২০০০ সালে তার তৈরি কোম্পানি সিস্টেম ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট বা এসসিএমের হাতে চলে এল ডোনবাস প্রদেশের অজস্র কয়লাখনি, ব্যাংক, টেলিকমিউনিকেশন সেক্টর, হোটেল, কৃষিজমি, ইনসিওরেন্স কোম্পানি, টেলিভিশন সেক্টর৷ পাশাপাশি বিপুল টাকা দিয়ে ঢেলে সাজালেন শাখতার ডোনেস্ককে। প্রচুর টাকার বিনিময়ে বিদেশী খেলোয়াড়দের ট্রান্সফার, সাথে ক্লাবের পরিকাঠামোয় বিপুল বদল – ফলও এলো হাতেনাতে।

২০০২ সালে প্রথমবারের জন্য ইউক্রেনের প্রিমিয়ারশিপ জিতে নিল শাখতার ডোনেস্ক। তারপর ২০১৩ অবধি আরো সাতবার৷ সাথে ইউক্রেনের জাতীয় কাপ। ২০০৯ সালে শাখতার জিতল উয়েফা কাপ বা ইউরোপা লিগ৷ সেমিফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বী কিয়েভকে দ্বিতীয় লেগে ঘরের মাঠে ২-০ হারাল তাঁরা।

আখমেতভ নিজে এইসময় সমগ্র ইউক্রেনের ধনীতম ব্যক্তি হয়ে উঠলেন। পাল্লা দিয়ে বাড়লো শাখতারের নাম, প্রতিপত্তি৷ শোনা যায়, গোটা সময় একের পর এক ক্রিমিনাল কেস নথিভুক্ত হয়েছিল আখমেতভের নামে। একটিও প্রমাণিত হয়নি। ব্রিটিশ কোর্টেও তাকে চ্যালেঞ্জ করে আটকানো যায়নি।

৩.

২০০৪ সালের নভেম্বর মাস। ঘোরতর শীত উপেক্ষা করে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের ফ্রিডম স্কোয়ারে জড়ো হয়েছেন হাজারে হাজারে মানুষ। তাদের হাতে কমলা পতাকা। সদ্যসমাপ্ত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। আর তাঁর বিরুদ্ধেই রাস্তায় নেমেছে ইউক্রেনের এক বড় অংশের মানুষ।

বিপুল ভোটলুটের অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে৷ এতটাই যে আন্তর্জাতিক আদালত অবধি ব্যাপার গড়িয়েছে। আদালতের রায় এলো৷ পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এবারে পরাজিত ইয়ানুকোভিচ, নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতায় এলেন ইয়ুশচেঙ্কো। প্রধানমন্ত্রী হলেন টিমোশেঙ্কো। তার পার্টি প্রো-ইউক্রেনিয়ান, আ্যান্টি-রুশ।

সমস্ত ডোনবাস প্রদেশ জুড়ে এর অভিঘাত হল মারাত্মক। দেশের পূর্বতম অংশ এই ডোনবাস প্রদেশ ইয়ানুকোভিচের পার্শিয়া রেজিনভের ক্ষমতা ও ভোট শেয়ারের কেন্দ্রবিন্দু৷ ইয়ানুকোভিচের যাবতীয় রাজনৈতিক ক্রিয়া কলাপের পেছনে গডফাদারের মত হাত ছিল আখমেতভের।

২০০৪ এর অরেঞ্জ রেভোলিউশনের পর আখেমেতভই তাঁর ক্লাবের দরজা খুলে দেন ইয়ানুকোভিচ ও তার পার্টি পার্শিয়া রেজিনভের জন্য। বদলে আদায় করে নেন পার্টির সদস্যপদ এবং তাঁর নিজের যাবতীয় ব্যবসায়িক লেনদেন ও স্বার্থরক্ষার প্রতিশ্রুতি। ২০০৫ সাল থেকে শাখতারের প্রতিটি জয়কে সামনে রেখে ঘুঁটি সাজিয়েছেন আখমেতভ-ইয়ানুকোভিচ জুটি৷ পার্শিয়া রেজিনভের ব্যবসায়ী-রাজনীতিবীদদের পরবর্তী প্রজন্ম শাখতারের ওপর পা রেখে নিজেদের তৈরি করেছে৷

২০০৯ সালে স্বাধীনতা পরবর্তী ইউক্রেনের প্রথম দল হিসাবে শাখতার ইউরোপা লিগ জিতলে শাখতারকে সমগ্র ইউক্রেনের ঐক্যের কাণ্ডারী হিসাবে ঘোষণা করেন ইয়ানুকোভিচ। আখমেতভ ও সুরকি ভাইদের অর্থকড়ির সাহায্যে ২০০৬ সালে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ও পরে ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ইয়ানুকোভিচ।

অলিগার্ক নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের ফুটবল প্রশাসনে ব্যাপক প্রভাব বৃদ্ধি পায় অলিগার্ক আখমেতভ ও সুরকি ভাইদের। পার্শিয়া রেজিনভের চাপে সমস্ত দেশজুড়ে একের পর এক অলিগার্করা তাদের টিম বেচে দেয় রেজিনভের সমর্থনপুষ্ট অলিগার্কদের হাতে৷ ব্যবসায়ী হিসাবে ক্রমশ ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে থাকেন আখমেতভ।

 

মাইনিং ফ্যাক্টরির তেল-ঝুল-ধুলো মাখা শরীরগুলোর থেকে শাখতারের দূরত্বও বেড়ে যায় কয়েক যোজন।

৪.

নাতিকে কোলে নিয়ে ধীরে ধীরে কথা বলছিলেন বছর পঞ্চান্নের শাসা। তিরিশ বছর ধরে একটানা ডোনবাস প্রদেশের মাইনে কাজ করছেন। মাঠে যাচ্ছেন তারো বছর দশেক আগে থেকে। ২০০৪ সালের পর থেকে মাইন জুড়ে একের পর এক সমস্যা। যন্ত্রপাতি কাজ করেনা ঠিক মত। মাইন রক্ষণাবেক্ষণের টাকা তাদের পকেট থেকে নেয় অফিসিয়ালরা।

কতদিন টিকবে মাইন তাও জানেন না। তার মধ্যেই সমস্ত সঞ্চয় জমিয়ে ৯০ ঘন্টা জার্নি করে ইস্তানবুল যাবেন তিনি৷ দিন পাঁচেক পরেই উয়েফা কাপ ফাইনাল৷ তার প্রিয় শাখতার খেলবে ওলিম্পিক লিঁয়র সাথে৷ থাকা-খাওয়া অনিশ্চিত৷ কাজও অনিশ্চিত। অনিশ্চিত জীবনের নিশ্চয়তা বলতে শাখতার ডোনেস্ক।

‘আগে শাখতার জিতলে, মাইনের উৎপাদন বেড়ে যেত কয়েকগুন। এখন সেসব অতীত’।, একমনে কথা বলার মাঝেই নাতিকে দেখিয়ে দেন ছোট্ট একটা বল। ‘ও আর মাইনে কাজ করবেনা। ও খেলবে, মাইন শ্রমিকদের টিমের জন্য। শাখতারের জন্য।’ ডোনবাস অঞ্চলের আনাচ-কানাচ জুড়ে ছড়িয়ে আছেন এই শাসারা। মাইনিং লেবার।

ইউক্রেনের ভাষার সাথে সড়গড় নন বিশেষ। কথা বলেন রুশ ভাষায়৷ একের পর এক মাইনের বেসরকারিকরণ, ওয়েজ কাট, কথায় কথায় ফাইন আর সংগঠিত ক্রাইমের জ্বালায় অধিকাংশই রিক্ত, বিধ্বস্ত। দুঃস্বপ্নের মত অনেককে তাড়া করে বেড়ায় সোভিয়েত ভেঙে যাবার যন্ত্রণা।

‘সোভিয়েত আমলে মাইনের অবস্থা এতটা খারাপ হয়নি। আমাদেরও সুযোগ সুবিধে ছিল অনেক বেশি’- ষাটের কাছাকাছি ভ্যালিয়া অকপট স্মৃতিচারণা করেন। ভ্যালিয়ার মতই ডোনবাসের বেশকিছু মানুষ এখনো বেঁচে থাকেন সোভিয়েতের স্মৃতিতে। নতুনদের একাংশ অবশ্য বাস্তবের রুঢ় জমিতে দাঁড়িয়েই মনে করেন ডোনবাসের ইউক্রেনের পাট পাকাপাকিভাবে চুকিয়ে রাশিয়ার সাথে সংযুক্ত হয়ে যাওয়া উচিৎ।

নি:স্ব-রিক্ত-বিধ্বস্ত স্মৃতিতে বেঁচে থাকা এই সমস্ত মানুষগুলোর একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে ওঠে তাই শাখতার ডোনেস্ক। জাতীয় ডার্বির দিন ডোনবাস থেকে ৩০ হাজার দর্শক চলে আসেন কিয়েভে। রাজধানীর আনাচ কানাচ ভরে ওঠে কালো-কমলা পতাকা আর রুশ স্লোগানে। ডোনবাসে বেড়ে ওঠা ফুটবলার এমনকি বিদেশিদের মধ্যেও রুশ জাতিসত্বার বোধ কাজ করে প্রবলভাবে৷

২০১৭ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে উগ্র জাতীয়তাবাদী এক দল যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের প্রতি সম্মান জানিয়ে কিছু স্লোগান লেখা টি-শার্ট পরে ম্যাচ খেলতে অনুরোধ জানান। ১৮ টির মধ্যে ১৭ টি ক্লাব সে অনুরোধ রাখে, নাকচ করে একমাত্র শাখতার। ঠিক যেভাবে ইউক্রেনের জাতীয় সঙ্গীতকে নাকচ করে দেন আজীবন ডোনবাস প্রদেশে বেড়ে ওঠা শাখতার ডিফেণ্ডার ইয়ারোস্লাভ র‍্যাকিটস্কি।

স্বাধীন ইউক্রেনের জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন ইগর পেত্রভ বলেছিলেন দেশের হয়ে মাঠে নামার সময়ও তাঁর সমস্ত মনন জুড়ে ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার ছবি। ইউক্রেনের নয়। র‍্যাকিটস্কি বা পেত্রভ দুজনেই এখন ইউক্রেন সরকারের সন্দেহের তালিকায়। র‍্যাকিটস্কি জেনিট সেন্ট পিটার্সবার্গে খেলার জন্য রাশিয়ায়, পেত্রভ অবশ্য থেকে গিয়েছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত তার নেটিভ প্রদেশেই।

ডোনবাস থেকে বেরোতে পারেননা, গ্রেপ্তারির ভয়। অজস্র মাইন শ্রমিকদের খবর নেই কোনো। অনেকে মারা গেছেন, অনেকে নিখোঁজ। সব হারিয়ে স্রেফ প্রাণটুকু নিয়ে পালাতে পেরেছে কেউকেউ। মাইন শ্রমিকদের টিমও ডোনবাস ছেড়ে চলে গেছে বছর ছয়েক আগে। একের পর এক বিদেশি ফুটবলার প্রাণের ভয়ে ফিরে আসেননি ডোনবাসে। খাঁ খাঁ শুন্যতার মাঝে পরে আছে বিধ্বস্ত স্টেডিয়াম ‘ডোনবাস এরিনা’।

৫.

২০১৪ সালের মে মাসে মারিউপুলের সাথে শাখতারের ম্যাচের তিনদিন পরে ডোনবাস এরিনায় স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী ডোনবাসের পতাকা তুলে দেয় প্রো-রাশিয়ান বিপ্লবীরা৷ তার ঠিক দিনতিনেকের মধ্যেই ডোনবাস প্রদেশে ঢুকে পরে ইউক্রেনের সেনা।

অভিশপ্ত সেই ম্যাচ ১৮০০০ দর্শকের সামনে জিতেছিল শাখতার। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে এক অনন্ত দৌড়। ছুট ছুট আর ছুট। ছুটছে শাখতার ডোনেস্ক। ছুটছে ডোনবাসের অজস্র শ্রমিক। প্রথমে দেশের পশ্চিমে লিভিভ শহরে। ইমিগ্রেশন বিরোধী নাৎসি ফ্রিডম পার্টির প্রবল প্রভাবে রুশ বিরোধী সেন্টিমেন্টের জন্য প্রবল টোন-টিটকারি-হেনস্থার মুখে পড়ে শাখতার ও তার সমর্থকরা।

বাধ্য হয়ে লিভিভ ছেড়ে রওয়ানা দেয় উত্তরপূর্ব সীমান্ত খারকিভ শহরের দিকে। দেশের উত্তর পূর্ব দিকের জন্য এবার অবশ্য অতটা বিরূপতা জোটেনি। খারকিভের মেটালিস্ট স্টেডিয়ামেই যুদ্ধপরবর্তী সময়ে ফুটবল খেলেছে শাখতার৷ সম্প্রতি নির্দিষ্ট কিছু আইনানুগ জটিলতার জন্য আবার দৌড়৷ এবার রাজধানী কিয়েভ৷ শাখতারের অস্থায়ী ‘হোম’।

ক্লাব যেভাবে দৌড়ায়, তার সাথে তাল রাখতে পারেননা সমর্থকরা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে যান। ডোনবাসের অলিতে গলিতে এরকম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে অপেক্ষা৷ ফুটবল আছে এখনো। সমর্থক আসেন। সরকার, বিপ্লবী অথবা আখমেতভে ভরসা হারানো মানুষ অপেক্ষা করছেন ফুটবলের৷ অপেক্ষা করছেন, শাখতারের।

গেনাডি লাগুতেভ যেমন। ২০১৫ সালে নিজের বাড়ির বারান্দা থেকে স্টেডিয়ামে শেল ফাটতে দেখেছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘শাখতার ফিরবে। এ শহরের মানুষ যন্ত্রণায় আছে। ফিরতেই হবে শাখতারকে।’ মাইনের কাজ সেরে আ্যামেচার ফুটবল দেখতে যাওয়া মানুষজনও আশা করছেন। ফ্লাডলাইটের আলোয় গমগম করবে সমস্ত ডোনবাস এরিনা। ‘স্লভ’সিয়া রণ্ডয় শাখতার, স্লভ’সিয়া রণ্ডয় শাখতার’।

শাসা, ভ্যালিয়ারা কি এদের মধ্যেই রয়েছেন কোথাও?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link