লেখাটা লিখব, ভাবনা অনেক দিনের। তখনও সংবাদমাধ্যমে চাকুরিরত। কিন্তু এটা ওটা করে কিছুতেই হয়ে উঠছিল না। আর সংবাদমাধ্যমকে বিদায় জানানোর পর, উপযুক্ত জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন সময়, সুযোগ, মঞ্চ সবই আছে। তাই লিখেই ফেললাম।
বিশ্ব ত্রাস ফাস্ট বোলার শোয়েব আখতাররের সাক্ষাৎকার। নিচ্ছেন আরেক বন্দিত ক্রিকেটার। তখন শোয়েব সদ্য খেলা ছেড়েছেন। মাঠের বাউন্সার আছড়ে পড়ছে মিডিয়ায়। যার বিরুদ্ধে পারছেন বাঁকা সুরে তাল ঠুকছেন। যিনি প্রশ্ন করছেন হঠাৎ কী মনে হল, পাল্টা বাউন্সার দিলেন শোয়েবকে, ‘কারও বিরুদ্ধে বল করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন?’
ভেবেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার বা বীরেন্দ্র শেবাগের নাম করবেন পাক পেসার। আর ক্রিকেট মহলে সারা ফেলবে সেই সাক্ষাৎকার। শোয়েব বললেন এমন এক ক্রিকেটারের নাম যিনি বক্স অফিস নন। রাহুল শরদ দ্রাবিড়।
এই লেখা তাঁকে নিয়ে, যত বড় হয়েছি তত বেশি করে যাঁকে আদর্শ হিসাবে মেনে এসেছি। ক্রিকেটার দ্রাবিড়ের কথা সবাই বলেন। আমার লেখায় প্রথম পর্বে থাকবে মানুষ পরের পর্বে থাকবে ক্রিকেটার দ্রাবিড়। প্রণাম!
আমাদের বেশিরভাগের মত এক সনাতন মধ্যবিত্ত ভারতীয় পরিবারে জন্ম রাহুলের। যেখানে ক্যামেরার ফ্লাশের ঝলকানি নেই, আছে গল্পের বইয়ের শীতলতা। নেই মধ্যমণি হওয়ার উচ্চাকাঙ্খা, আছে দায়িত্ব বহনের নির্ভরতা। নেই বড় বড় কথা, আছে নি:শব্দে নিজের কাজ করে যাওয়ার দৃঢ়তা। এই আচরণই সারা জীবন বহন করে চলেছেন তিনি। কী ক্রিকেটে, কী ব্যক্তি জীবনে!
বেশ কিছু দিন আগে একটা ছবি নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। বেঙ্গালুরুর এক বিজ্ঞান মেলায় ছেলেকে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন দ্রাবিড়। ভাব এমন, ‘আমি তোমাদেরই লোক। সাধারণের মতোই লাইন দিয়ে ভেতরে যাব।’ ভাবুন যে দেশে রনজি খেলা ক্রিকেটাররা নিজেদের মহাতারকা ভাবেন, মাটিতে পা পড়ে না, সেখানে দেশের প্রাক্তন অধিনায়ক ছেলের হাত ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে। কোনও ইগো নেই। নেই কোনও বিরক্তি। এটাই দ্রাবিড় সভ্যতা। আমরাও এরকম হতে চাই, সম্ভব?
বছর তিনেক আগেকার ঘটনা রাহুলকে সাম্মানিক ডক্টরেট দিতে চাইল বেঙ্গালুরু বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের রাজনীতিবিদ, ফিল্ম স্টাররা হলে লাফিয়ে উঠতেন। খুশি মনে খেতাব নিতে যেতেন বাকি ক্রিকেটাররা। দ্রাবিড় কী করলেন সটান না বলে দিলেন। ধন্যবাদ জানিয়ে জানালেন, এই সম্মান নিতে পারবেন না। যদি ভবিষ্যতে সম্ভব হয়, অৰ্জন করে নেবেন। শোনা যায় পরিবারের অনেককে দ্রাবিড় দেখেছেন, ডক্টরেটের জন্য কী পরিমান পরিশ্রম করতে হয়, যেহেতু তিনি ঘাম ঝরাননি, তাই প্রাইজও নেবেন না। এটাই দ্রাবিড় সভ্যতা।
আমরাও এরকম হতে চাই, সম্ভব?
কেভিন পিটারসেন নিজের বইয়ে লিখেছেন। ইউনিস খান টিভিতে বলেছেন বার বার। তাঁদের ক্রিকেট জীবনই বদলে দিয়েছেন দ্রাবিড়। একটা সময় স্পিন খেলতে, বিশেষ করে লেফট আর্ম স্পিন খেলতে, বেশ সমস্যা হচ্ছিল পিটারসেনের। দ্রাবিড়ের কাছে পরামর্শ চাইলেন। অনেকেই চান, কিন্তু সেটা সামনা সামনি। কেপি-কে নাগালে না পেয়ে রাহুল কম্পিউটার খুলে বসলেন। লম্বা চওড়া মেইল করলেন তাঁকে।
স্পিন খেলার সময় পা কী ভাবে নড়বে, মানসিকতা কেমন থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর ভারত সফরে এসে অশ্বিন, ওঝাদের কেমন শাসন করেছিলেন কেপি আমরা জানি। ইউনিসের গল্পটা আরও আকর্ষণীয়। ভারত, পাকিস্তান তখন একই হোটেলে। হাতের কাছে পেয়ে দ্রাবিড়ের কাছে সাহায্য চাইলেন প্রাক্তন পাক অধিনায়ক। কিছুক্ষণ পর ইউনিসের দরজায় নক নক। খুলে চক্ষু ছানাবড়া। ইউনিস এখনও ভাবতে পারেন না, কোনও ইগো না দেখিয়ে, সেদিন সাহায্যের জন্য তাঁর ঘরে চলে এসেছিলেন রাহুল। ব্যাটিং নিয়ে পরামর্শ দেন অনেকক্ষণ। এটাই দ্রাবিড় সভ্যতা।
আমরাও এরকম হতে চাই, সম্ভব?
ভারতের বিশ্বকাপ ইতিহাসে কালো অধ্যায় ২০০৭। গ্রুপ লেগে হেরে গোটা দল মুহ্যমান। দুদিন পরেও প্রায় সকলের নাওয়া খাওয়া বন্ধ। দ্রাবিড় দায়িত্ব নিলেন দলের হাল ফেরানোর। ক্যাপ্টেন হিসাবে নিজের হতাশাকে দূরে সরিয়ে। ডেকে নেনে মুষড়ে থাকা ধোনি ও ইরফান পাঠানকে।
বাড়ির বড় ভাইয়ের মত বলেন, ‘তোরা এত ভেঙে পড়ছিস কেন। সবে তো শুরু করেছিস। সামনে অনেক সুযোগ পাবি, দেশকে ট্রফি দেওয়ার।’ আজও ইরফান মনে রেখেছেন দ্রাবিড়ের সেদিনের কথা। এত সহজে নিজের হতাশা লুকিয়ে জুনিয়রদের উৎসাহ দেওয়া যায়! এটাই দ্রাবিড় সভ্যতা। আমরাও এরকম হতে চাই, সম্ভব?
শেষে বলব ১৯৯৬-এর কথা। শোনা এক নামকরা সাংবাদিকের মুখে। ভারতের বিশ্বকাপ দলের প্রাথমিক তালিকায় রয়েছেন দ্রাবিড় ও এখনকার নির্বাচক বিক্রম রাঠোর। দুজনে রুমমেটও। তবে ফাইনাল দলে জায়গা হল না কারও। সাংবাদিক দাদা গেলেন রাঠোরের ঘরে। সমবেদনা জানাতে। গিয়ে দেখেন রাঠোর বিমর্ষ হয়ে বসে। কিন্তু দ্রাবিড় নেই। ব্যাগ গুছিয়ে এরমধ্যে বেরিয়ে গেছেন। রাঠোরও অবাক।
বিশ্বকাপ দলে জায়গা না পেয়ে দ্রাবিড় শুধু বলেছিলেন, ‘ও আমি নেই।’ অনেক পরে সেই সাংবাদিককে দ্রাবিড় বলেন, ‘কী করতাম বসে কাঁদতাম! তার চেয়ে হিসেব করে দেখলেম, বিশ্বকাপ ও ভারতের ইংল্যান্ড সফরের আগে চারটে রনজি ম্যাচ পাব। চারটেতেই সেঞ্চুরি করতে হবে।’
হয়েওছিলো তাই। এটাই দ্রাবিড় সভ্যতা। আমরাও এরকম হতে চাই, সম্ভব?