ছোট্ট মেয়েটা গ্যালারিতে বসে একদিন হাসবেই!

ওয়েম্বলির ভরা স্টেডিয়ামে প্রিয় দলের হারে কান্নায় ভেঙে পড়া এই টুকু বাচ্চা হয়তো ভাল ভাবে চেনে না জোয়াকিম লো-কে। প্রিয়জনের সঙ্গে এত বড় গ্যালারিতে এসে হয়তো সে জীবনের প্রথম খেলা দেখল। হয়তো লক্ষ্য করল কিংবা করল না, কালো জার্সি পরা জার্মান খেলোয়াড়দের সঙ্গে একরাশ মনভার নিয়ে স্টেডিয়াম থেকে বিদায় নিলেন আধুনিক জার্মান ফুটবলের সফলতম কোচ। জার্মানির খেলা হলে সাইডলাইনের ধারে দেখা যাবে না আর তাঁকে।

এই ছোট্ট একরত্তি মেয়ের জন্মের বেশ কিছু বছর আগে জার্মানির কোচ হিসেবে ইউর্গেন ক্লিন্সমেনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে লো হাল ধরেন জাতীয় দলের। তারপরেই ধীরে ধীরে নিজের ফুটবল ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দলের ফুটবলের ধরন আস্তে আস্তে আমূল বদলে দেওয়া। সে সময় বিশ্ব  ফুটবলেও এক অদ্ভুত বাঁক আসছে।

লুই আরাগোনেসের হাত ধরে স্পেন চমকপ্রদ ফুটবল খেলতে শুরু করছে। ২০০৮ এ তারা জিতে নিচ্ছে ইউরো কাপ। প্রতিপক্ষ লো-এর জার্মানি। সেই সময় থেকেই বিশ্বফুটবলে কোচ হিসেবে সাড়া ফেলে দেওয়া উত্থান পেপ গার্দিওলার। তাঁর প্রশিক্ষণে বার্সেলোনা সারা বিশ্বকে মুগ্ধ করছে, তিন-চার বছরের মধ্যেই সারা ইউরোপে সেটাই ফুটবলের আদর্শ মডেল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

জার্মানির খেলাতেও কি তার ছোঁয়া লাগছে না? যে জার্মানিকে সারা বিশ্ব চিনত দ্রুত গতিতে লম্বা পাস খেলা ফুটবল দল হিসেবে, যাদের দলে বিশাল লম্বা খেলোয়াড়দের প্রাধান্য থাকত সেই দল আস্তে আস্তে রপ্ত করছে ছোট পাসের প্রেসিং নির্ভর ফুটবল, খেলায় বলের দখল বাড়ছে। এ এক নতুন জার্মানি।

২০১০-এ মারাদোনার প্রশিক্ষণাধীন আর্জেন্টিনাকে ৪-০ গোলে উড়িয়েও বিশ্বকাপ সেমি ফাইনালে জার্মানি হারল সেই স্পেনের কাছেই। অপ্রতিরোধ্য সেই স্পেনের কোচ তখন ভিসেন্তে দেল বস্কি। ২০১২ ইউরোয় সেমিফাইনালে উঠল জার্মানি।

এবার হার বরাবরের গাঁট ইতালির কাছে। অনেক প্রশংসা কুড়ালেও বার বার কাছে এসেও থেমে যেতে হচ্ছে লো-এর জার্মানিকে। সেই সঙ্গে জার্মান ফুটবলের ধরন পাল্টে দেওয়ায় মাঝে মাঝেই হজম করতে হচ্ছে কঠোর সমালোচনাও। ২০১৪ এ কি তবে লো-এর শেষ চেষ্টা?

২০১৪ বিশ্বকাপে যে ফুটবল খেলল জার্মানি তাতে তারা না জিতলে হয়তো ফুটবলের প্রতি সুবিচার হত না। ততদিনে স্পেনের ফুটবল সূর্যও অস্তমিত। পাসের ফুলঝুরিতে, দুর্দম গতিতে সারা মাঠ জুড়ে ফুল ফোটাল তারা। ব্রাজিলকে তাদের ঘরভর্তি স্টেডিয়ামের সামনে ৭ গোলের লজ্জা উপহার দিল। ফাইনালে নিজেদের স্বাভাবিক খেলা খেলতে না পারলেও বরাবরের নাছোড় জার্মান মনোভাব নিয়ে আর্জেন্টিনাকে পরাস্ত করল তারা।

লো ছাড়া কি এসব সম্ভব হত? ২০০৬-এর বিশ্বকাপে জার্মানির কোনওক্রমে সেমিফাইনালে পৌঁছনো দেখে অতি বড় জার্মান সমর্থকও হয়তো ভাবেননি যে আট বছরের মধ্যে জার্মান ফুটবলের চিরায়ত ধরণকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে জার্মানি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দলের শিরোপা পাবে!

এর পর থেকেই জার্মানির ফুটবলের মান পড়ে আসছিল। তবুও জার্মান ফুটবলের ধারাবাহিক সাফল্য বজায় রেখেই ২০১৬ ইউরোর সেমিতে পৌঁছানো আর ২০১৭ এর কনফেডারেশন কাপ জিতে নেওয়া। কিন্তু ২০১৮-এ গ্রুপ রাউন্ডে মেক্সিকো আর দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে বেহাল হার এবং সুইডেনের সঙ্গে কোনওক্রমে জয় বুঝিয়ে দিচ্ছিল লো-এর দিন শেষ।

জার্মানির বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক অধ্যায়ও এই ২০১৮। ২০২১-এর ইউরোয় জার্মানির সমর্থকেরা বোধহয় তেমন আশাও করেননি। পর্তুগালের সঙ্গে এক ম্যাচে জ্বলে ওঠে ছাড়া জার্মানির সেই রুদ্ধশ্বাস ফুটবল দেখা গেল কই!

লো চলে যাচ্ছেন। চলে যাচ্ছেন একটা সময়কে নিয়ে। ফুটবল তাঁর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।  প্রতিটা শেষেই যেমন নতুন শুরু অপেক্ষা করে থাকে তেমনই দলের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তুত লো-এর এক সময়ের সহকারী হ্যান্সি ফ্লিক। ওয়েম্বলির গ্যালারিতে ক্রন্দনরত ওই খুদের চোখের জলকে ঝকঝকে হাসিতে বদলে দেওয়ার দায়িত্ব তো এবার তাঁর কাঁধেই।

এই বাচ্চা মেয়েটা গ্যালারিতে বসে একদিন হাসবেই।  ফুটবল সেই গল্পই বলে। অবিরত পথচলার গল্প। যেখানে শেষ বলে কিছু নেই। হয় না। বিদায় জোয়াকিম লো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link