আমার গল্প শুরু করার আগে, আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর কে! আমি আরো ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার আরেক ঈশ্বর কে; বলুন তো তিনি কে? তিনি হলেন ম্যারাডোনা, ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা! আমি আরো ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার বাবা কে!
আমি তখন সবে আট, আমি একটি পাপ করে ফেলি! সম্ভবত ইহা সবার কাছে পাপ সমতুল্য নয়, কিন্তু আপনি যখন নাপোলিতে জন্ম নিবেন কিংবা বেড়ে উঠবেন, তখন তা অনেক বড় পাপ! আমি কেবলমাত্র ফুটবল নিয়ে লাফঝাপ শুরু করেছি তখন, আমার একজোড়া বুট কেনার সাধ জাগলো। আসলে সেসময় ফুটবল খেলার মত কোন বুট আমার ছিলোনা, কেনোনা বয়সে তখন আমি সত্যিই অনেক ছোট।
বাবার কাছে তৎক্ষণাৎ বুট কিনে দেওয়ার টাকা ছিলোনা। কিন্তু আমি পরোয়া করলাম না। আমার বুট চাই’ই চাই। আমি যেকোনো মুল্যে বুট পড়ে ফুটবল খেলতে চাই। একদিন আমি মাঠে যাচ্ছিলাম আমার ভাইয়ের খেলা দেখতে, কিন্তু শুধু গ্যালারিতে বসে খেলা দেখাই আমার উদ্দেশ্য ছিলোনা। আমার অন্য এক পরিকল্পনা ছিলো। আমি গিয়ে পাগলের মত কান্না শুরু করে দিলাম, আমি মাঠে খেলতে চাই। বিশ্বাস করুন, আমি এমন ভাবে কান্না করতে লাগলাম, যেনো খেলতে না পারলে আমি মরেই যাবো। শেষমেশ কোচ বলে উঠলেন, ‘ঠিকাছে ঠিকাছে! বাচ্চাটাকে ২ মিনিট খেলতে দাও!’
তারা আমার কান্না থামানোর জন্যে আমাকে মাঠে নামালেন, কিন্তু আমি ভাবলাম অন্য কিছু! আমি তাদের দেখাতে চাইলাম, হ্যা আমি খেলতে পারি! আমি যেনো স্কুলে নিয়মিত সুযোগ পাই!
আমি খুবই খুশি ছিলাম, কিন্তু আমার নিজের একজোড়া বুট না থাকার আফসোস রয়েই গেলো। প্রত্যেকদিন আমি বাবার কাছে বুট চাইতাম, জেদ করতাম; কিন্তু সেখানে সমস্যা ছিলো দুটো!
প্রথমত, আমি ছিলাম গরীব পরিবারের সন্তান। আমি যেখানে বেড়ে উঠেছি, মানুষ খুব কস্ট করে জীবিকা নির্বাহ করে। আমার বাবার পক্ষে একজোড়া দামী জুতো কিনে দেওয়া অসম্ভব ছিল।
দ্বিতীয়ত, আমার নির্দিষ্ট এক বুটের শখ ছিলো! আমি চেয়ে বসেছিলাম রোনালদো ৯’র সেই বিখ্যাত বুটজোড়া! দা জিনিয়াস স্ট্রাইকার রোনালদোর বুটজোড়া! আপনাদের মনে আছে তো, না? রুপালি, নীল এবং হলুদ এর মিশ্রণ! আইকনিক! ৯৮ বিশ্বকাপে যেই বুটজোড়া পড়ে মাঠে নেমে, নিজের নামে খেলায় তাক লাগিয়েছিলেন বিশ্বকে! আমি ঠিক সেই বুটজোড়ার কথাই বলছি!
‘বাবা, প্লিজ, প্লিজ আমায় রোনালদোর জুতোজোড়া দাও না, প্লিজ!’ – প্রত্যেকদিন, প্রত্যেকদিন আমার চাওয়া ছিলো কেবল এইটাই!
‘বাবা, বাবা, জুতোগুলো!’
আমার এই আবদারে বাবা বুঝি আমাকে মেরেই ফেলতে চাইতো! কেনোনা বাবা কেবল একজন ফুটবলারের গুণকীর্তন পছন্দ করতেন, তিনি হলেন দিয়াগো। আমি যেসময়ে জন্মেছি বা বেড়ে উঠেছি, সেসময় আমাদের চারপাশে সবাই একটা রহস্য ঘেরা মন্ত্রমুগ্ধে আবর্তিত ছিলো, তা হলো ডিয়েগো ম্যাজিক!
ম্যারাডোনা নি:সন্দেহে সেরাদের একজন; কিন্তু ন্যাপোলিতে? নাপোলি তে সে একজন ঈশ্বর! বাবা চাইতো, আমি ম্যারাডোনার মত কালো জুতো পড়ি। কিন্তু আমি বলতাম, না, আমার রোনালদোর মতই চাই, রোনালদো সবার সেরা।
বাবা বলতো- ‘হে ডিয়েগো, আমায় ক্ষমা করো, আমায় ক্ষমা করো!’
আমার বাবা একজন কট্টরপন্থী ন্যাপোলি সাপোর্টার। আর সেই সময় রোনালদো খেলতো ইন্টারে, একই সাথে নাপোলির চোখের জলের কারণ’ও ছিলো সেসময় একজন রোনালদো! এত কিছু সেই বয়সে আমার মাথা ব্যাথার কারণ ছিলোনা, আমি কেবল রোনালদোর জুতো বলতে পাগল ছিলাম!
একদিন সকালে বাবা বললো, চলো দোকানে যাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেনো। তিনি বললেন, জুতো কিনতে! অবশ্যই বাবার পর্যাপ্ত টাকা ছিলোনা সেসময়, কিন্তু তিনি যে কোনোভাবে তা ম্যানেজ করে ফেলে। কি যে আনন্দ লাগছিলো, সেই অনুভূতি বুঝানো সম্ভব নয়। আমরা বের হয়ে দোকানে দোকানে ঘুড়তে লাগলাম।
প্রথম দোকানে পেলাম না। পরের দোকানেও পেলাম না। তারপরের দোকানে পেলাম, তবে আমার সাইজে হলোনা। আমরা সারা শহর ঘুড়লাম। সন্ধ্যা অবধি ঘুড়েও আমরা কোন দোকানে জুতোজোড়ার সন্ধান পেলাম না। আমি আশা ছেড়ে দিচ্ছিলাম, ঠিক সেসময় আমার কাংখিত সেই জুতোজোড়া খুঁজে পেলাম, আমার পায়েও ঠিকঠাক লেগে গেলো।
আমি নিশ্চিত ছিলাম, এই একটা স্মৃতি সম্ভবত আমার জীবনে আমি কখনও ভুলতে পারবোনা! এটি আমার জীবনে পাওয়া যেকোনো উপহারের চাইতে সেরা। একজন প্রোফেশনাল ফুটবলার হিসেবে এখন অসংখ্য জুতো ফ্রি পাই, কিন্তু কখনও সেই অনুভূতিগুলোকে তা ছুঁয়ে যেতে পারেনা। জুতোজোড়া পড়ে অন্যরকম এক অনুভূতি পেতাম। হ্যা আমি ছোট, হ্যা আমি নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান, হ্যা আমি খুব ভালো ফুটবল খেলিনা, কিন্তু আমি ঠিক সেই জুতো পায়ে দিতাম, যেইটা রোনালদো পায়ে দিতো! এই অনুভূতি আসলে বলে বুঝানো সম্ভব না। এই অনুভূতি আমাকে স্বপ্ন দেখাতো, সম্ভবত, হ্যা সম্ভবত, আমি একদিন রোনালদোর মত ভালো খেলতেও পারি!
প্রত্যেকদিন খুব সুন্দর করে জুতোগুলো পরিস্কার করতাম। আমরা যেসব মাঠে খেলতাম তার প্রায় সবগুলো ছিলো অপরিচ্ছন্ন। আমি জানতাম, জুতোগুলো কিনে দিতে বাবার অনেক কস্ট করতে হইছে; তাই জুতোগুলো যত্ন নিতাম অনেক।
আরো ছোটতে, যেখানে আমার স্কুলের অন্যান্য ছেলেরা খেলতো নিন বিল্ডিংয়ের মাঠে, বড় মাঠে; কিন্তু আমি খেলতাম ঘরের ছোট্ট এক কোনায়, কাগজে বানানো ফুটবলে। আমার হোমওয়ার্কের পুরোনো খাতার কাগজে বানাতাম সেই বল। ছোট থেকেই একটা বিষয়ই কেবল আমার মাথায় ঘুড়পাক খেতো, তা হলো ফুটবল!
আমার সবসময়ের স্বপ্ন ছিল, নাপোলির জার্সিতে সান পাওলোর মাঠে খেলা। বলতে পারেন, তা ছিলো একমাত্র স্বপ্ন’ও বটে। আমি অন্য খেলাও খেলতাম না, আমি ফুটবল ছাড়া কিছু ভাবতামও না৷
কিছু ক্লাবের স্কাউট একটা সময় আমায় যখন দেখলেন, তখন তারা আমাকে বললেন, আমি খাটো। আমার তখন ১৪। গতি, শক্তি সামর্থ্য, টেকনিক সবদিকেই নাকি খাটো’রা খুব বেশি উন্নতি করতে পারেনা। এসব শুনে আমি আশা ছেড়ে দিলাম। আমার বাবাকেও জানালাম, আমার বুঝি আর ফুটবলার হয়ে উঠা হলোনা।
বাবা বললো, তবে তুমি কি হতে চাও? আমি বললাম, তবে কি হওয়া যায়? আসলে ফুটবল ছাড়া আমার মাথায় আর কিছুই আসেনাই কক্ষনও, আমার পৃথিবী আবর্তিত ছিলো কেবল ঐ ছোট্ট গোলকে, সেটা হলো ফুটবল!
সেসময় আমি আমার এলাকার ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলে সময় কাটাতাম। এরই মাঝে নাপোলি থেকে আমি আরেকটা সুযোগ পাই। খুব সম্ভবত উনারা আমার মাঝে কিছু খুঁজে পেয়েছিলেন। নাপোলির ট্রায়ালে আমার মত অনেক ১৫ বয়সীরা ছিলো। তাদের মাঝে আমি খুব বেশি সুবিধা করতে পারিনি। বেশিরভাগ সময়ই আমি বলবয়ের কাজ করতাম। কিন্তু তারপরেও মনে একটা স্পৃহা কাজ করছিলো। আমার পরিবার কট্টরপন্থী নাপোলি সমর্থক, আর আমি নাপোলির ট্রায়ালে, এটা তাদের জন্য আনন্দদায়ক ছিলো।
নাপোলির মাঠে থাকা যেকোন নাপোলিয়ানের জন্যে গর্বের, আনন্দের। আমি সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা। আমি ভাবতাম, নাপোলির জার্সি পড়ে যদি একটা ম্যাচ অন্তত খেলতে পারতাম, হয়তো খুশিতে মরেই যেতাম!
যখন আমি ২০১০ এ প্রথমবার নাপোলির জার্সি পড়ে সিনিয়র টিমের হয়ে মাঠে নামার সুযোগ পাই, তা আনন্দদায়ক ছিলো, আর আমার পরিবারের জন্যে ছিলো যার পর নাই গর্বের, সম্মানের। খড়কুটোর বাড়ি থেকে উঠে আসা এক ছেলে যখন নাপোলির জার্সিতে মাঠে নামবে তখন এর চেয়ে বড় পাওয়া কিংবা সৌভাগ্যের আর কি’ই বা থাকতে পারে।
আমার প্রথম ম্যাচ ছিলো লিভোর্নো তে – ম্যাচ শেষে ফিরার সময় এয়ারপোর্টে বাবা আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলো। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বাসায় কি আমার জন্যে প্রতিবেশীরা অপেক্ষা করছে?? তিনি উত্তর দিলেন, না, সবাই ঘুমিয়ে গেছে, অনেক রাত হয়ে গেছে তো! অথচ, বাসায় ফিরে আমি রীতিমতো অবাক ছিলাম! সব প্রতিবেশীরা আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলো! তারা সবাই রীতিমতো উৎসব সাজিয়ে রেখেছিলো। কেউ গাচ্ছিলো, কেউ ফায়ারওয়ার্কস নিয়ে ব্যাস্ত ছিলো, কেউ বা নাঁচছিলো। তারা আমার জন্যে বড় একটি কেকের ব্যাবস্থা করে রেখেছিলো। এগুলো ছিলো অবিশ্বাস্য প্রায়!
ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মা’র চোখে তাকিয়ে আমি যে সুখানুভূতি, যে চাহনি, যে পরম পাওয়ার উপলব্ধি লক্ষ্য করেছিলাম, তা ছিলো আমার জীবনের সেরা অংশ! আমি কখনও আমার আমার মা কে এত খুশিতে দেখিনি!
নাপোলি আমাদের রক্তে মিশে আছে। আমি এই ক্লাবের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। নাপোলি আমায় কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে আলোর মুখ দেখিয়েছে।
ন্যাপোলিতে অভিষেকের পর, আমি ফোগিয়া এবং পেসকারা তে লোনে ছিলাম। দুটি ক্লাব ছিলো বি ও সি লিগের! ফোগিয়া তে আমি একজন কোচ পাই, মি. জিম্যান! মানুষটাকে আমি অনেক ভালোবাসতাম, আমাদের মাঝে ভালো সম্পর্ক ছিলো! তিনি আমায় আস্থা রেখেছিলেন। আমি ঐ সিজনে ১৮ গোল করেছিলাম। তিনিই আমাকে নিজের সাথে পেসকারাতে নিয়ে আসেন। পেসকারা আমার জন্যে সৌভাগ্যের। কেননা, এখানে সিজন শেষ করেই আমি ন্যাপোলিতে ফিরি। এছাড়া ঐ বছরেই আমার স্ত্রী জেনি’র সাক্ষাৎ হয়!
পেসকারাতে আমি করেছিলাম প্রায় ১৯ গোল। মৌসুম শেষে নাপোলির তৎকালীন কোচ আমায় ডেকে বলেছিলেন, তুমি যদি নাপোলির স্কোয়াডে নিজেকে দেখতে চাও, তবে তোমার নিজেকেই তা অর্জন করতে হবে! আমি উত্তরে বলেছিলাম- সমস্যা নেই, ছোট থেকেই আমায় কেউ কিছু বিনামূল্যে দেয়নাই, আমি অর্জন করে নিয়েছি!
বিশ্বাস করুন, বাস্তবেই কোন বাঁধা আমায় কখনো রুখতে পারেনাই। আমি সবসময় নিজের অবস্থান জানান দিয়েছি।
নতুন সিজনের শুরুতেই আমার স্ত্রী গর্ভবতী হোন, আমি আমার মৌসুমের প্রথম গোল তাকে ডেডিকেটেড করেছিলাম। বল জার্সির ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়ে স্ত্রী বা গর্ভে থাকা সন্তানকে ডেডিকেট করা হয়তো আপনাদের কাছে সাধারণ কিছু মনে হতে পারে, কিন্তু একজন বাবার কাছে এই অনুভূতি বিশাল!
আমার মনে আছে, দর্শক আমার নামে গান গেয়েছিলো! এই অনুভূতি লিখে প্রকাশ করার নাহ, যা কেবলই হ্রদয় দিয়ে অনুভব করা যায়!
সাত বছর হতে চললো, আমি নাপোলির জার্সি পড়ি। কিন্তু ন্যাপোলির হয়ে করা গোলে সেই একই আবেগ কাজ করে! ন্যাপোলির হয়ে গোল পাওয়া আনন্দের, কেনোনা আমি এই শহরের হউয়ায় গর্ববোধ করি! আমার কাছে এটি বিশ্বের সেরা শহর! আপনি চেয়ে দেখুন আমার টিমমেটদের প্রতি, অনেক বড় ক্লাবের অফার পেয়েও তারা নাপোলিতে রয়ে গেছে! এ শহর এক মায়ার শহর! হামশিকের দিকে চেয়ে দেখুন, ১১ বছর ধরে সে নাপোলী তে আছে। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এ ব্যাপারে, সে বলেছিলো যে – আমি এই শহর ভালোবাসি, আমি এই শহরের মানুষ ভালোবাসি। আপনারা সম্ভবত ভুলে গেছেন, এমনকি স্বয়ং ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনা এই শহরের প্রেমে পড়েছিলেন!
ন্যাপোলির দর্শকদের চিৎকার আমার জীবনের বড় পাথেয়! নাপোলির জার্সি আমায় আমার পরিবারের ত্যাগ কে মনে করে দেয়, আমার পরিবারের ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দেয়!
আমি আজও জানিনা, বাবা কোথাথেকে টাকা এনে জুতোজোড়া কিনে দিয়েছিলেন! কিন্তু আমি উপলব্ধি করি, তার পরিশ্রম! আমি উপলব্ধি করি, তার সংগ্রাম!
আমি ন্যাপোলির জার্সিতে নিজেকে ভাগ্যবান ভাবি! কেনোনা এটি এই শহরের অস্তিত্বে বিরাজ করে! কেনোনা এই জার্সিতে এই শহরের ঈশ্বর ম্যারাডোনা খেলে গিয়েছেন!
প্রিয় রোনালদোর প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান জানিয়ে বলতে চাই – আপনি সেরা, আপনি জিনিয়াস, আপনি ইতিহাসের সেরা নাম্বার নাইন, আপনি আজীবন আমার অনুপ্রেরণা হয়েই থাকবেন! কিন্তু আমি নাপোলিয়ান, নাপোলিতে আমার জন্ম, একজন ন্যাপোলিয়ান হিসেবে আমার ফুটবল ঈশ্বর একজনই; তিনি হলেন ম্যারাডোনা, ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা!