সাদমান-শান্ত ও পরিপক্বতা

‘আমরা সৃজিব নতুন জগত, আমরা গাহিব নতুন গান, সম্ভ্রমে নত এই ধরা নেবে অঞ্জলি পাতি মোদের দান।’ – জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিটি শব্দকে সত্য প্রমাণ করে আজ ঝঞ্জার মতো উদ্দাম কিংবা ঝর্নার মত চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন শান্ত-সাদমানরা। টেস্টের চতুর্থ দিনে দুজন মিলে করলেন নতুন ইতিহাস। শান্ত’র সেঞ্চুরির পর সাদমান যেভাবে উল্লসিত হয়েছেন তাতেই বোঝা যায় এই জয় শুধু শান্ত কিংবা সাদমানের নয় এই জয় তারুণ্যের।

বাংলার ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় অভিযোগ তরুণদের সাফল্য কই। লিটন, সৌম্য কিংবা শান্তদের হাতে গোনা দুই একটা ঝলক শুধু মনের আঙিনায় খেলা করে। আজ হয়তো শান্ত-সাদমানরা চাপে ছিলেন না। গতকালই বাংলাদেশ এই টেস্টের চালকের আসনে চলে এসেছে। তবে আজ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ বাকি ছিল, বড় কিছু করে দেখানোর সুযোগ ছিল, অনেক প্রশ্নের জবাব দেয়ার ছিল।

দ্বিতীয় উইকেটে এটি বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ জুটি। ইমরুল কায়েস ও শামসুর রহমানের সর্বোচ্চ জুটিতে এসেছিল ২৩৪ রান, চট্টগ্রামে ২০১৪ সালে। নাজমুল হোসেন শান্ত ও সাদমান ইসলামের জুটি থেকে আজ এসেছে অপরাজিত ১৯৬ রান।

দুইজন যেভাবে খেলছিলেন তাতে এই জুটি হতে পারতো সুদূর নীহারিকা। তবে চা বিরতির আগেই প্রতিপক্ষকে ব্যাট করতে পাঠাবেন বলে অধিনায়ক ডেকে নিলেন তাঁর দুই তরুণ তুর্কীকে। ২৮৪ রানে ইনিংস ঘোষণা করার আগেই দুজনই পূরণ করেছেন সেঞ্চুরির কোটা। সাদমানে পয়লা, শান্ত’র দ্বিতীয়টা।

তবে এই দুইজন যে এমন একটা মহাকাব্য লিখতে পারেন এই বিশ্বাসটা কী কেউ রেখেছিল। অন্তত দল কী রেখেছিল। সাদমান-সাইফ-শান্তদের উপর ভরসা না রাখতে পেরেই নয় ব্যাটসম্যান নিয়ে মাঠে নামলো বাংলাদেশ। ওদিকে ইনজুরির কারণে তামিম ছিটকে না গেলে এই টেস্টে খেলাই হতো না সাদমানের। কেননা সাদমান খেললে টপ অর্ডারের চারজনই বাঁহাতি হয়ে যায়। এই ডানহাতি-বাঁহাতি কম্বিনেশনের অযুহাত দিয়েই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট খেলানো হলো না সাদমানকেই। এবারো হতো না, কপাল খুললো তামিমের চোটে।

অথচ টেস্ট ক্রিকেটে সাদমান পরীক্ষিত ও প্রমাণিত। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে শেষ টেস্টে ১৫৪ বলে ৫৯ রানের একটি ইনিংস খেলেছিলেন। তাঁর প্রথম সাত টেস্টে বল খেলেছেন ৮১৮ টি। অর্থাৎ প্রতি ম্যাচে  গড়ে প্রায় ১১৬ টি বল। প্রমাণ করতে চাচ্ছি সাদমান প্রায় প্রতিটি ম্যাচের শুরুর কঠিন সময়টায় অনেকগুলো করে বল খেলেছেন। উইকেটে থিতু হয়েছেন, ভালো শুরুও পেয়েছেন।

শুধু একটা বড় ইনিংস খেলতে পারছিলেন না। তবে সাদমান ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছিলেন তিনি লম্বা সময় ব্যাট করতে জানেন। টেস্ট ক্রিকেটে এমন একজনকেই তো আমরা খুঁজছিলাম, যিনি ২২ গজে মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকবেন। কিন্তু ডানহাতি-বাঁহাতি কম্বিনেশনের কথা বলে তাঁকে আর সুযোগ দেয়া হলো না।

গতকাল দিনের শেষে ব্যাট করতে নেমে কোনো ভুল করেননি। পাকা টেস্ট ব্যাটসম্যানের মত দেখেশুনে বল ছেড়ে দিয়েছেন। দিনটা শেষ করে এসেছেন। আজ শান্ত যখন ব্যাট করতে নামলেন তখন রানরেট একটু বাড়ানো প্রয়োজন। এবার শান্ত’র সাথে দ্রুত রান তুলতে শুরু করলেন। অবশ্য একটু ভুলও করেছিলেন। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে একটি ক্যাচ তুলে দিয়েও জীবন পেয়েছেন। তারপর আর ভুল করেননি কোনো।

১৯৬ বলে ১১৫ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে মাঠ ছেড়েছেন। একবারো মনে হয়নি এটা তাঁর প্রথম সেঞ্চুরি। তিনি হয়তো শান্ত-লিটনদের মত চোখ ধাঁধানো ব্যাটসম্যান না, তবে তিনি তাঁর দুর্বলতা বোঝেন এবং নিজের শক্তির জায়গায় বিশ্বাস রাখেন। আমাদেরও উচিৎ সাদমানের উপর বিশ্বসা রাখা।

ওদিকে নাজমুল হোসেন শান্তকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ ভাবা হয়। ক্রিকেট বোদ্ধারাও বলেছেন শান্ত বড় মাপের খেলোয়াড়, শুধু একটু সময় দরকার। টিম ম্যানেজম্যান্ট তাই শান্তকে তাঁকে সুযোগের পর সুযোগ দিয়ে গিয়েছে। তাই হওয়া উচিৎ। তবে সেই বিশ্বাসের একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৬৩ রানের বিশাল এক ইনিংস খেলেছেন। তাতেও সমালোচনা কমেনি। প্রশ্ন উঠেছে তাঁর ধারাবাহিকতা নিয়ে।

তবে আজকে শান্ত ছিলেন দুর্দান্ত। তিনি ব্যাট করতে নেমেছিলেন বাংলাদেশে দ্রুত একটা বড় স্কোর দাঁড় করিয়ে দেয়ার জন্য। তাঁর হাতে আজ সময় নেয়ার সুযোগ ছিল না। ফলে ১১৮ বলে ৯৯.১৪ স্ট্রাইকরেটে খেলেছেন ১১৭ রানের ইনিংস। তবে একবারো বাড়তি কিছু করতে জাননি। বড় খেলোয়াড়ের মতই ক্রিকেটীয় শট খেলেছেন। ভালো বল গুলো থেকে সিঙ্গেলস বের করেছেন।

প্রতিপক্ষকে একটাও সুযোগ দেননি। শান্ত’র ক্রিকেট পরিপক্কতার কথা অনেক শুনেছি। আজ দেখলাম যখন নার্ভাস নাইন্টিজে ব্যাট করছেন। একবারো মনে হয়নি চাপে আছেন। বরং ৯১ রানে থাকা অবস্থায় ডান্সিং ডাউন দ্য উইকেটে এসে বোলারের মাথার উপর দিয়ে বিশাল এক ছয় মারলেন। একেবারে মাপা শট, যেখানে নেই একবিন্দু বাড়তি উন্মাদনা।

সাদমান-শান্তরা নিজেদের প্রমাণ করতে পারলে আখেরে লাভবান হয় বাংলার ক্রিকেটেই। তবে এখনো অনেকটা পথ বাকি। বড় দলগুলোর বিপক্ষে ওদের ব্যাট থেকে নিয়মিত রান আসা জরুরি। কেননো টেস্ট ম্যাচ জিততে হলো সাদমানের ধৈর্য্য ও শান্ত’র পরিপক্কতা দুটিই প্রয়োজন। তাঁদের এই মহাযাত্রা অব্যাহত থাকুক।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link