আমার গল্পের শুরু সেই ১৯৯৮ সালে! আন্তর্জাতিক ফুটবলের ক্রেজ ধরতে সেসময় বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় হওয়া লাগতো। ’৯৪ এর বিশ্বকাপের সময় ফুটবল বুঝার সময় হয় নাই।
তাই আমার ক্ষেত্রে ১৯৯৮ পর্যন্ত অপেক্ষা করা লেগেছে। সেবার গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা হ্যাটট্রিক করলেন। আমার এক কাজিন আমাকে বুঝালো যে আর্জেন্টিনাই সেরা। বাতিস্তুতার কী গ্ল্যামার, অ্যারিয়েল ওর্তেগা হচ্ছে নতুন ম্যারাডোনা। আর ম্যারাডোনা হচ্ছে ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়! ব্যাস, আমি আর্জেন্টিনায় বুঁদ হয়ে গেলাম।
সেই কাজিনের কাছেই গল্প শুনলাম, ১৯৯০ বিশ্বকাপে নাকি আর্জেন্টিনা অবশ্যই বিশ্বকাপ জিততো। ম্যাচ রেফারি জার্মানিকে এবারের ইংল্যান্ডের মতো ফাইনাল মোমেন্টে পেনাল্টি দিয়ে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিততে দেয় নাই! কিন্তু সেবার আর্জেন্টিনা কোয়ার্টার ফাইনালে হারলো ৯০তম মিনিটে বার্গক্যাম্পের অসাধারণ গোলে। সেই গোল সইতে না পেরে হার্ট অ্যাটাক করে বাংলাদেশে একজন মারা গেছেন, সেই খবর পরেরদিন পত্রিকায় এল।
আর্জেন্টিনা আমাদের সমর্থকদের হৃদয় শক্ত করার দায়িত্বও কি নিলো?
ব্যাস, ফুটবলে আমার আর্জেন্টিনা প্রেমের শুরু।এরপর ২০০২ বিশ্বকাপ আসলো। তখন আর্জেন্টিনা আসলেই বিশ্বের সেরা দুই দলের একটা। প্রথম আলো ‘স্টেডিয়ামে’ লিখলো, ‘স্বপ্নের ফাইনাল হচ্ছে না!’ অর্থাৎ গ্রুপ অফ ডেথে পড়ায় বিশ্বের সেরা দুই দল ফ্রান্স আর আর্জেন্টিনার ফাইনালের আগেই দেখা হবে। সেই আর্জেন্টিনা তো বিশ্বসেরাই! র্যাংকিংয়ে তাঁরা তখন এক নাম্বার! বাতিস্তুতা, ক্রেসপো আছে, আছে ভেরন।
আর সেবারের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে চমক হিসেবে ম্যারাডোনার সাথী ক্যানিজিয়াও আছে। এইবার বিশ্বকাপ কে ঠেকায়! অথচ সেই আর্জেন্টিনা বাদ পড়ে গেলো প্রথম রাউন্ডেই। সেবারই প্রথম আর্জেন্টাইন ফ্যান হিসেবে পতাকা টানিয়েছিলাম বাড়ির ছাদে। বেকহ্যাম করলেন ’৯৮ বিশ্বকাপের দায়মোচন।
সুইডেনের সাথে মাস্ট উইন ম্যাচ। আমার মনে আছে, যখন সুইডেন আর্জেন্টিনার সাথে যখন সমতাসূচক গোলটা দেয় তাঁর ৫ মিনিটের মধ্যেই আমি বুঝে যাই যে আর্জেন্টিনা আর এই গোল শোধ করতে পারবে না। আমি খেলার মাঝেই ছাদে উঠে পতাকা খুলে ফেলি, আর ম্যাচ শেষে আমার চিৎকার করে বারান্দায় বসে কান্না।
সেই কান্না থামানোর জন্য পাশের বাসার দাদু আমাকে সান্ত্বনা দেন, উল্টোদিকের বাসার বারান্দা থেকে এক আপু সান্ত্বনা দেয়! কিন্তু আমার কান্না বন্ধ হয় না। এটা নিয়ে একটা মজার কথা বলি! অনেক বছর পরে আমাদের পাশের বাসার দাদুর সাথে ফোনে কথা হচ্ছিলো! তো ২০২০ সালে এসে সেই দাদু আমাকে ফোনে বললেন, ‘তোমার কথা মনে হলে আমার মনে হয়, আর্জেন্টিনা হারসিলো বলে তুমি অনেক কাঁদসিলা! আহারে!’
আর্জেন্টিনার সাথে এই কান্নার আবেগ কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়!
২০০২ গেলো, ২০০৪ সালে কোপা আমেরিকা আসলো। এবার ফাইনালে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল মুখোমুখি। ভোরে উঠে খেলা দেখার পালা। ৮৭ মিনিটে আর্জেন্টিনা ২-১ গোলে এগিয়েও গেলো। এবার তো চ্যাম্পিয়ন হচ্ছি। ব্রাজিলের সাথে টক্করের ব্যাপারে পাড়ায় কথা বলা যাবে। কীসের কী! ৯৩ মিনিটে একদম শেষ মুহূর্তে আদ্রিয়ানো গোল দিয়ে দিলো! খেলা চলে গেলো টাইব্রেকারে! শেষ মুহূর্তের সেই গোল এসেছিলো শক হয়ে।
একই সাথে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সমর্থক হবার কারণে আগের বছরে মুলতান টেস্টেও কান্নাকাটি হয়ে গেছে! ততদিনে এর সাথে সহজাত পরিচিতি হয়ে গেছে! হৃদয় শক্ত করবার কাজটা আগেই শুরু হয়েছে বলেছি। আদ্রিয়ানোর সেই গোল আসলে আমাদের আর্জেন্টাইন সমর্থকদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতও করেছিলো।
যত জয়ের অবস্থাতেই থাকি না কেন, শেষে গিয়ে আমরা ম্যাচ হারবোই! এই প্রস্তুতি আমাদের সেই ম্যাচটা দিয়ে গিয়েছিলো। ২০০৭ এর কোপা আমেরিকার ফাইনালে কেন যেন আগে থেকেই জানতাম যে আর্জেন্টিনা হারবে! সেবার ব্রাজিল আমাদের ৩-০ গোলে হারাল। সেবার দু:খটাও পাইনি।
ওহ, মাঝে তো ২০০৬ বিশ্বকাপ চলে গেছে। হ্যাঁ, সেই ২০০৬ বিশ্বকাপেও আমরা বিশ্বসেরা! মাঝমাঠের অলস জাদুকর রিকুয়েলমে আছে, নতুন ম্যারাডোনা মেসি আছে! আর্জেন্টিনা সার্বিয়ার সাথে জিতলো ৬-০ গোলে! ২৪ পাসের বিশ্বসেরা গোল। পরেরদিন প্রথম আলোতে উৎপল শুভ্র হেডলাইন দিলেন, সুন্দর ফুটবল আর্জেন্টিনাও খেলে!’ – ‘আর্জেন্টিনা-ও’ খেলে মানে কী? ও-টা আবার লাগাতে হবে কেন? সুন্দর ফুটবল তো আর্জেন্টিনা সবসময়েই খেলে।
আমরা ভক্তরা অনেকটা রাগই করলাম। শুভ্র পরের একটা কলামে সেটাও লিখলেন! জার্মানির সাথে কোয়ার্টার ফাইনাল পড়লো! সেবারও আমরা ৭০ মিনিট পর্যন্ত ১-০ গোলে এগিয়ে। কোচ প্যাকারম্যান রিকুয়েলমেকে মাঠ থেকে তুলে নিলেন। তিনি কী চিন্তা করেছিলেন, কেন চিন্তা করেছিলেন- সেটা আজ পর্যন্ত একটা রহস্য! শেষ ২০ মিনিটে মাঝমাঠের কন্ট্রোলটা চলে গেলো জার্মানির হাতে। মিরোস্লাভ ক্লোজা গোল দিয়ে জার্মানিকে সমতায় ফিরিয়ে নিলো! তারপর টাইব্রেকারে হার। ততদিনে আমরা জানি যে আর্জেন্টিনার গোলকিপিংয়ে ভালো কেউ নেই। যত্নে কেনা জার্সিটা তুলে রাখি, পতাকাটা আবার নামিয়ে আনি, রাতের আঁধারে।
বিশ্বকাপের পর বিশ্বকাপ চলে যাচ্ছে, কোপার পর কোপা চলে যাচ্ছে! কোথাও কোন ট্রফি জেতা হচ্ছে না। আমরা বুঝে গেছি যে অন্যান্য দলের সাথে তর্কে আসলে আমাদের বলার কিছু নেই। ৫ বার, ৪ বার, ৩ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের সমর্থকদের সাথে এক ম্যারাডোনা সেরা দিয়ে তর্ক করার মানে হয় না। হয়তো হেড টু হেডে অনেক দলের সাথে আর্জেন্টিনা এগিয়েই, হয়তো বিশ্বকাপ বাদে বাকি অন্য ট্রফির হিসাবেও আর্জেন্টিনা এগিয়ে। তবু তর্ক করি না। তাঁর চেয়ে আর্জেন্টিনা জায়গাটা আমাদের আবেগ। এই জায়গাটাতেই ভালো লাগে।
স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় বারবার পুড়ে খাঁটি হই? নাকি আসলে ছাই হয়ে আবার ফিনিক্স পাখির মতো উড়তে চাই? প্রত্যেকবারের ব্যর্থতা থেকে আমরা ফিনিক্স পাখি হতে চাই, কিন্তু আমরা ছাই হয়েই থাকি। সেই ছাই থেকে আবার হীরা খুঁজে স্বপ্ন দেখি।
২০১০ বিশ্বকাপ এলো। এবার তো আর্জেন্টাইন ইতিহাস তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসের সেরা দুই ফুটবলারের জুটি আর্জেন্টিনা দলে। মাঠে মেসি, কোচ ম্যারাডোনা! এবার তো আমাদের জেতা উচিত। এইটা একটা মজার ব্যাপার। প্রত্যেকবারই আমরা খেলতে যাই, এমন কিছু আশা নিয়ে। কখনো বাতিস্তুতা, কখনো ভেরন, আবার কখনো রিকুয়েলমে, ক্রেসপো আবার কখনো মেসির সাথে স্বয়ং ম্যারাডোনা।
ঈশ্বর আর্জেন্টাইন সমর্থকদের সাথেও যথেষ্ট হেঁয়ালিই করেছেন। সেবার তো মেসির সাথে তেভেজও আছেন। একজন বাম পায়ের ম্যারাডোনা হলে আরেকজন ডান পায়ের ম্যারাডোনা। আর ডাগ আউটে স্বয়ং আসল ম্যারাডোনা! তো ২০১০ বিশ্বকাপ এলো আবারও জার্মানির সাথে দু:স্বপ্ন হয়ে। আবারও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। তখন সোশাল মিডিয়া জনগণের মধ্যে মাত্র পৌঁছাচ্ছে। ব্লগ, ফেসবুকে অন্য দলের সমর্থকেরা নতুন ট্রল করা শিখছে।
‘এক হালি ডিমের দাম কত?’ এই নিয়ে ট্রল শুরু হচ্ছে। আমাদের বাস্তব জীবনের অপমান তখন সোশাল মিডিয়ায় ভার্চুয়াল রূপ নিচ্ছে!
২০১৪ তে জানা গেলো, এইটা নাকি আর্জেন্টিনার সেরা সুযোগ। এবার কেবল মেসির উপর ভরসা করতে হবে না। ডি মারিয়া আছেন, আছেন হিগুয়েইন। সবাই ইউরোপ সেরা হয়ে এসেছেন। এবারের গোলকিপার রোমেরো নাকি আসলেই গোলকিপার! বল ধরতে জানে! দেখতে দেখতে আর্জেন্টিনা সেমি ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে গেলো। এবার টাইব্রেকার! আমি জানি আমরা টাইব্রেকারে হারবো। আগে প্রত্যেকবার হেরেছি!
ততদিনে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাথে ২০১২ এশিয়া কাপ পার করে এসেছি। সুতরাং আমি জানি যে এই টাইব্রেকারে হৃদয় ভাঙন দেখবার প্রস্তুতি আমার আছে! অথচ কী আশ্চর্য, রোমেরো সেই টাইব্রেকার জিতিয়ে দিলেন! আর্জেন্টিনা ফাইনালে, বিশ্বকাপ ফাইনালে! প্রথম ধাক্কা এলো, যখন ডি মারিয়া খেলতে পারবেন না। তারপর!! তারপরে হিগুয়েইন ফাঁকায় বল পেলেন একদম গোলকিপারের সামনে, খালি পোস্ট।
আমি সোফা থেকে লাফ দিচ্ছি, এবার হয়েই গেল। অথচ হিগুয়েইন বলটা বাইরে মারলেন! হিগুয়েইন গোলও দিলো, এবার আবার লাফ দিলাম! দেখলাম অফ সাইড। প্রথমার্ধের কিছুক্ষণ আগে মেসি গোলকিপারকে একা পেয়ে বল বাইরে মারলেন। আমি বুঝলাম, এই আর্জেন্টিনা ফাইনাল জিতবে না। জিতলোও না।
তবে সেবারের দলটা আসলেই ভালো ছিল। সেটা বুঝা গিয়েছিলো। সোশাল মিডিয়ায় ততদিনে ‘রঙিন টিভিতে আর্জেন্টিনা কাপ জেতে নাই।’, ‘হারজেতেনা’ – ইত্যাদি ট্রলে ভরপুর। একবার মনে হয় বলি যে, ‘রঙিন টিভিতে জিতেছে ঠিকই, কিন্তু আপনার বাসায় তখন রঙিন টিভি ছিল না।’
আবার এসব অপমানের জবাব দেবার মতো মুখও করে রাখি নাই! জবাব দেবার জন্য একবুক আবেগ ছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আর আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের সমর্থকদের কাছে সেরকম কিছু নাই! একেকবার যায়, নতুন জার্সি কিনি, পতাকা কিনি। আবার সেই জার্সি খুলে রাখি ড্রয়ারের কোনায়। দুই বছর, চার বছর পরপর একেকটা কোপাতে, বিশ্বকাপে সেই জার্সি বের হয়। কিন্তু জার্সি পরে বুক ফুলিয়ে রাস্তায় হাঁটতে পারি না।
তবে ২০১৫ আর ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকার ফাইনালে হারাটা আসলেই এক বিস্ময়কর ব্যাপার! ট্রফি ব্যাপারটা আসলেই মনে হয় ভাগ্যে ছিল না। নাহলে আজ থেকে অনেক বছর পরে যখন ফুটবলের ইতিহাস দেখা হবে তখন ২০১৫, ১৬ সালে পরপর দুইবার আর্জেন্টিনার এই দল কীভাবে দুইবারই চিলির মতো মধ্যম সারির দলের কাছে একইরকমভাবে টাইব্রেকারে হেরে গিয়েছিলো – সেটা ভেবে বিস্ময় প্রকাশ হবে! হয়তো ভবিষ্যতের ফুটবল ইতিহাসবিদরা এই নিয়ে গবেষণা করবেন।
প্রায় অজেয় হয়ে ফুটবল খেলেও ফাইনালের গণ্ডিটা পেরুনো যাচ্ছিলো না আর। টাইব্রেকারে দুইবারই হার! ২০১৫ তেও হিগুয়েইনের একইরকম মিস। আবারও দর্শক হিসেবে আমার সোফা থেকে লাফ দেয়া। আর্জেন্টিনার সাথে এতো বেশি দেজা ভ্যু হয়েছে যে হঠাৎ আর ধাক্কা লাগেই নাই কখনো।
তারপর ২০১৮ বিশ্বকাপ গেলো। অবস্থা সেই তথৈবচ! এর মধ্যে দর্শক হিসেবে আমার ইভ্লভ হয়েছে অনেক। সেই ’৯৮, ’০২ এর প্রায় কিশোর বয়সী আমার হয়তো কিছুটা পরিপক্বতা এসেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলও আমাকে ৩ বলে ২ উপহার দিয়েছে, ’১৮ এর এশিয়া কাপ ফাইনাল দিয়েছে। আমি জানি যে এই দুই দলের কাছে আমার হারানোর কিছু নেই! নাকি উলটোটা হবে? দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ! নাকি তাঁদের কোন ঋণ আমরা দেইনি। সমর্থকেরা যা দিয়েছি সেটা শুধুই ভালবাসা আর অন্ধ লয়ালটি! হয়তো কিছু জেদও! কেন জিতবো না, দেখি না- এই জেদ! ডিনায়ালের জেদ!
এর মধ্যে মেসি হয়ে উঠেছেন মহীরূহ! নতুন ম্যারাডোনা হয়ে ফুটবলে এসেছিলেন। ক্লাব ফুটবলে সম্ভাব্য সবকিছু জিতেছেন। ম্যারাডোনাকে সব জায়গায় ছাড়িয়ে যাচ্ছেন! কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে কিছুই জিততে পারেননি। স্পেনের হয়ে খেলতে পারতেন, কিন্তু বেছে নিয়েছিলেন জন্মস্থান আর্জেন্টিনাকেই। একের পর এক হতাশা ব্যর্থতা। ২০১৬ এর টাইব্রেকারে নিজেই পেনাল্টি মিস করলেন। প্রচণ্ড হতাশায় অবসর নিয়ে ফেললেন।
একদল দর্শক কেবল নাটক নাটক বলে চিল্লালো। তাঁরা এর পেছনের হতাশা, আবেগটা দেখলো না। এর আগে ২০১৪ তে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় ‘গোল্ডেন বল’ জিতেছেন। গোল্ডেন বলের পুরষ্কার নিতে গিয়ে মূল বিশ্বকাপের দিকে তাকিয়ে আছেন মেসি – এটা তো ক্রীড়া ইতিহাসের একটা চিরন্তন ছবি হয়েই আছে!
তাই ২০২০ কোপা আমেরিকাতে আবার যখন ব্রাজিলের সাথেই ফাইনাল হলো, আমি আগে থেকে আবার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। ডি মারিয়া যখন গোল দিলো, তখনও জানি যে যেকোন মুহূর্তে ব্রাজিল গোল দিয়ে দিবে। এরপর মেসি যখন ৮৮ মিনিটে একদম সহজ সুযোগ মিস করলো তখন বুঝে গেলাম, এবার কাপ আমাদের কাছে আসবে না। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়। আমিও পেয়েছিলাম! ৫ মিনিট এক্সট্রা সময় আছে।
এর মধ্যে তো ব্রাজিল সমতা আনবেই, ঠিক যেমন ২০০৪ কোপা আমেরিকা ফাইনালে আদ্রিয়ানো সমতা এনেছিলো!
কিন্তু এ কী! ২০২১ সালে করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে এখন অনেক কিছুই ‘নিউ নরমাল’! এমন একটা ব্যাপার যেটা ২০২০ এর আগে অস্বাভাবিক ছিল সেটা কি এখন নতুন স্বাভাবিক হয়ে গেলো?
সব আশংকাকে দূরে সরিয়ে রেফারির লম্বা তিন ফুঁ বাজলো। সেই যে মুহূর্ত! ক্যামেরা চলে গেলো মেসির কাছে! তিনি হাউমাউ করে কাঁদছেন। আর আমরা যারা এতো বছর দলটাকে অন্ধের মতো সমর্থন দিয়ে গেছি কোন প্রাপ্তি ছাড়া, তাঁরা? টিভি সেটের সামনে বসে তাঁদের চোখে কি পানি চলে আসেনি?
এই একটা মুহূর্ত, একটা আন্তর্জাতিক ট্রফির জন্য কত অপেক্ষা, কত ট্রল সহ্য করা অনলাইন, অফলাইনে। তারপর মেসির হাতে আসলো একটা ট্রফি! আকাশী-নীলের জার্সিটা পরে অন্তত এইবার বুক ফুলিয়ে একটু ঘুরবো!
তবে সেই যে কতবছর আগে প্রথম জার্সি কিনেছিলাম, তখন থেকেই জার্সিতে দুই তারকা। এরপর জার্সির রকমফেরের পরিবর্তন হয়েছে। বয়সের প্রয়োজনে জার্সির সাইজ সমল, মিডিয়াম , লার্জ হয়েছে। নিউ মার্কেটের জার্সি থেকে শুরু করে আডিডাসের তৈরি করা অরিজিনাল জার্সিও পরেছি। কিন্তু কোন জার্সিতেই দুই তারকার কোন পরিবর্তন হয়নি। এখনও সেখানে তিন নাম্বার তারকার অপেক্ষা।
সেই অপেক্ষা হয়তো অনেকবছর ধরেই চলছে, হয়তো এই লেখা নিয়েও অনেক ট্রল হবে যে, ‘একটা ট্রফি জিতেই কত আবেগ!’ কিন্তু অফলাইন-অনলাইন দুই জগতেই বুক ফুলিয়ে নীল-সাদা জার্সি পরতে পারার যে আবেগ, বারেবারে পুড়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত অন্তত একবার ফিনিক্স পাখির মতো উড়তে পারার যে আবেগ, সেটার কাছে ওই ট্রল কিছুই না!
এখন কেবল তিন নম্বর তারকার অপেক্ষা! হয়তো আরও অনেক বছর সে অপেক্ষা চলতে পারে হয়তো দ্রুততম সময়েও হতে পারে। কিন্তু বারবার পুড়ে যে আবেগ খাঁটি হয়েছে সেই আবেগ কখনো মরে যাবে না। দিনশেষে এই আবেগটার জন্যই তো খেলা দেখি!