ফুটবল নিয়ে একটু বেশি প্যাশনেট ছিলাম সবসময়। একেবারে ছোটোবেলা থেকেই। ২০০২ বিশ্বকাপে বাতিস্তুতা-ভেরন-ওর্তেগাদের খেলা দেখেছি। খুব বেশি মনে নেই। তবে সেই শুরু আর্জেন্টিনাকে সমর্থন। তখন কার ক’টা বিশ্বকাপ বা শিরোপা এই দেখে সমর্থন করা শিখিনি। এই শিরোপা দেখে সমর্থক হলে নিশ্চিত খুশিতে চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল কিংবা দু:খে সমব্যথী হয়ে জার্মানির সমর্থক হতাম।
২০০৬ সালে ভালমত বুঝে বিশ্বকাপ দেখলাম। ওই শিরোপা-সুখ-দুঃখ সূত্র প্রয়োগ করলে ইতালি কিংবা ফ্রান্সই হত আমার দল। না, এমন কিছু হয়নি। রিকুয়েলমে-মাশ্চেরানো-মেসি-তেভেজদের প্রেমে তখন মন অস্থির হয়ে উঠেছিল। ফেনীর পরশুরামে জীবনে সেরা সময় কাটিয়েছি। এখনো মনে পড়ে বিশ্বকাপ উপলক্ষে প্রথম আলোর বের করা ম্যাগাজিন-ফিচার-সাময়িকিগুলো কিনতে উপজেলা গেটের নান্টু ভাইয়ের পত্রিকার দোকানে যেতাম।
ফেনী থেকে পত্রিকা আসতে আসতে ১১ টার বেশি বাজত। আর যেদিন এমন বিশেষ ম্যাগাজিন দিত সেদিন তো ১০টা-সাড়ে ১০টা থেকে ওই উপজেলা গেট-রাস্তায় ভিড় জমে থাকত। প্রথম আলোর এই ম্যাগাজিনগুলো ছিল ফুটবল জ্ঞানে আমার হাতেখড়ি। তখনই প্রথম জার্মানির কোলন ক্লাবের নাম পড়েছিলাম লুকাস পোডলস্কির বদলৌতে। তেভেজের কারণে ব্রাজিলের কারিন্থিয়ান্স। লুকা টনির সৌজন্যে ফিউরেন্টিনা।
২০১০ বিশ্বকাপটা কী ছিল আসলে বুঝে উঠতে পারি না এখনো। ম্যারাডোনা কোচ হয়ে আসলেন, আমরাই দক্ষিণ আফ্রিকায় যেতে পারব কি না তা নিয়েই তো চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার এখন স্পষ্ট মনে আছে আমাদের অতি প্রিয় পদ্মা মাঠে মংশিউ ভাইয়ের সাথে আলাপ করেছিলাম যদি আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে না যায় তাহলে কী করব।
স্পেনই হয়তো করতাম বা খেলাই না দেখতাম। কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে হারার পরে ওই বিশ্বকাপের আর একটা ম্যাচও দেখিনি। ফাইনালও না। এবার কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় প্রথম আলোকে, সাথে সেবার অবশ্য কালের কণ্ঠও যোগ হয়েছিল। মেসুত ওজিলের জন্যে ওয়েডার ব্রেমেন ক্লাবকে এবার চেনা হল। ডি মারিয়ায় বেনফিকা আর পাস্তোরেতে পালেরমো। ঘানা দলের সবার খোঁজ রাখতে চেয়েছিলাম। কালের কণ্ঠের বিশাল ম্যাগাজিন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।
ব্রাজিল বিশ্বকাপ। আমার সবচেয়ে স্মরণীয় বিশ্বকাপ। স্মৃতিগুলো একদম সতেজ। গুটি গুটি পায়ে আর্জেন্টিনা গিয়েছিল অনেকদিনের দু:খ ভুলতে। মারিও গোৎজে সেবার দিল না সেই সুযোগ। মাঝেমধ্যে আমার ফুটবল সংক্রান্ত স্ট্যাটাসে অ্যান্টি জার্মানি টাইপ কথা থাকতে পারে। আসলে জার্মানির বিপক্ষে আমার কিছুই নেই। যে রাগটা দেখাই সেটার জন্যে দায়ী আমার দল।
উপরের দুই বিশ্বকাপ মেমোরিতে বলেছি পোডলস্কি-ওজিলদের কথা। ওদের খোঁজখবর রাখতাম। ভাল লাগত। কিন্তু টানা জার্মানির কাছে বিশ্বকাপে বাদ পড়ায় মনের অজান্তেই একট ক্ষোভ কাজ করা শুরু করে। ব্রাজিল বিশ্বকাপে হেরে যাওয়াটা ছিল কফিনে শেষ পেড়েক। ইরানের সাথে মেসির গোল, রোমেরোর সে একই ম্যাচে বেশ কটি সেভ, মারিয়ার সুইস বধে সেলিব্রেশনটা, হিগুয়েনের বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে নাটমেগের পরে বারে শট, মাশ্চেরানোর ট্যাকেল – অনেক কিছুই ছিল মনে রাখার মতন।
২০১৫, ২০১৬ – পরপর দুটি কোপার ফাইনাল হারলাম। ভেবেছিলাম নিশ্চিত জিতব। মেসির হাতে অন্তত কাপ দেখতে পাব। পেলাম না। টানা তিন বছর তিন ফাইনাল হার। একজন সমর্থক হিশেবে মানা কষ্টের। অগোছালো আর্জেন্টিনা ফুটবল সংস্থা, দলের অবস্থাও শোচনীয়। এরপরেও রাশিয়া বিশ্বকাপ দেখতে বসেছিলাম জয়ের স্বপ্নে।
খেলাধুলা নিয়ে একেবারে ছোটোবেলায় ‘বাংলাদেশ ডায়েরি’ নামের এক বই পড়েছিলাম। সেখানে পড়া ইমরান খানের পাকিস্তানের ৯২ বিশ্বকাপ জেতার গল্প মনে থাকত সবসময়। মার্টিন ক্রো-নেইল ফেয়ারব্রাদার-বোথামদের নামটা তখনই শুনেছিলাম। ওই আহত বাঘদের বিশ্বজয় পড়ে ভাবতাম আর্জেন্টিনার অবস্থাও খারাপ। এবার হয় গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ না হয় চ্যাম্পিয়ন। না, কিছুই হল না। পরের বছরের কোপাতেও কোপাতে পারলাম না। ব্রাজিলের কাছে সেমিতে বিদায়।
স্ক্যালোনিকে পছন্দ করি না, করতামও না। পেকারম্যান-বাসিলে-ম্যারাডোনা-বাতিস্তা-সাবেলা-টাটা মার্টিনো-বাউজা-সাম্পাওলিদের দেখেছি ডাগআউটে। ভালো-মন্দের মিশেল। স্ক্যালোনিকে গালি দিতাম প্রচুর। এইবারের কোপার আগে-মধ্যেও দিয়েছি প্রচুর। কিন্তু, ক্যাপ্টেন মেসিকে বের করে আনতে পেরেছের স্ক্যালোনি।
এমি মার্টিনেজে শেষ পর্যন্ত আস্থা রেখেছে স্ক্যালোনি। যেমন ফুটবল খেলে শিরোপা স্পর্শ করা যায় তেমনটাই খেলেছে স্ক্যালোনির দল। সেমিতে জেতার পরে একরাতও ঠিকঠাক ঘুম হয়নি। ব্রাজিলকে হারাতে পারব তো! না কি আরেকটা হার্টব্রেকের দিকে যাচ্ছি। সবকিছু শেষে স্ক্যালোনিকে ধন্যবাদ জানাই। অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে জানাই।
শুরুতে ফিরে যাই। ২৮ বছর পরে আর্জেন্টিনা আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতল। অনেকগুলা ফাইনাল হারার পরে।একবারের জন্যেও মনে হয়নি আর্জেন্টিনা সমর্থন করা বন্ধ করব। যতই খারাপ গেছে, চলে গেছে। বিশ্বকাপ জিততে দেখব কিংবা দেখব না। আফসোস নেই। কারণ কয়েক বছর আগেই ভাবতাম কোপাও জিততে পারব না। অথচ আজ ঠিকই জিতে গেলাম। কি অপেক্ষা করছে সামনে, জানি না।
তবে যাই দিবেন আমাদের চাওয়ার থেকে বেশি দিবেন। ইন ঢাকা ব্যান্ডের ‘এই রাতে’ গানটি শোনার পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তখন থেকে পরবর্তী জীবনের তিন সময়ের আনন্দ উৎযাপন করব এই গান দিয়ে। আজ একটা করে ফেললাম। বাকী দুটো সামনে হবেই, হতেই হবে।
ফুটবলে আনন্দ-বেদনা অনেক কিছু পেয়েছি। বেদনার পরিমাণটা অনেক বেশি। এবার অনেকটাই কমে গেল। বাকিটা নিয়ে আফসোস নেই। ফুটবলকে বিদায় জানাচ্ছি কিছু সময়ের জন্যে। আবার আসব। রচনা করব নতুন কোনো ট্যাঙ্গো। ততদিন তুমি ভাল থেকো, ফুটবল। লিও মেসির কান্নাতেই সই।