গডফাদারই ছিলেন, শুধু সিগারটা বাদ দিয়ে

গডফাদার সিনেমাটা দেখেছেন কি? সাতের দশকের শুরুর দিকে। মুখ্য চরিত্র ডন ভিটো কর্লিয়নের চরিত্রে তুমুল সাড়া ফেলেছিলেন মার্লন ব্র্যান্ডো। মারিও পুজোর যে বই অনুসারে সিনেমাটি হয়েছিল সেই গডফাদারের বই টি প্রথম দু’বছরে বিক্রি হয়েছিল ৯০ লক্ষ কপি।

চলচ্চিত্র থেকে বাস্তব। খেলার মাঠের গ্যাংস্টার। বিভিন্ন সংবাদপত্রে ইমেজ ছিল ঠিক এইরকমই। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। ক্যারিরিয়ান পেস ব্যাটারির উত্থানের গল্প। সেই বিখ্যাত পেস ব্যাটারির অংশ ছিলেন দৈত্যাকার গার্নার, দুরন্ত গতির ক্রফট,রোলস রয়েসের মত মসৃণ রানআপের হোল্ডিং আর একজন গডফাদার।

হ্যাঁ। গডফাদারই বলা হত তাঁকে। সেই ভিটো কর্লিয়নের মতনই। সেই মাঠের গদফাদারই ছিলেন অ্যান্ডি রবার্টস। ‘Expressionless assassin.’ – ঠিক এই হেডিং টাই ছিল ক্রিকেট কান্ট্রির প্রতিবেদনে। কথা কম বলতেন যে,হাসতে খুব কম লোক দেখেছে তাঁকে।

‘এটা কি সার্কাস যে হাসব?’ – বলেছিলেন রবার্টস। এতটাই সিরিয়াস ছিলেন নিজের বোলিং নিয়ে। ১৫ বছর বয়সে প্রথম বলে হাত দেওয়া। কেমন ছিল সেই অনূভূতি?

একজন পুলিশের হাতে বন্দুক তুলে দিলে যেরকম অনূভূতি হয় ঠিক সেরকম। প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন কিংবদন্তি। অ্যান্ডি জন্মেছিলেন এক মৎস্যজীবীর পরিবারের অংশ হয়ে। ১৪ ভাইবোনের অভাবের সংসার। ১৬ বছর বয়স অব্দি ক্রিকেট ম্যাচই খেলা হয়নি কোনদিন। ১৮ বছর বয়সে যখন মোটামুটি ক্রিকেট খেলা চলছে,তখন সে অ্যান্টিগার এক সংস্থার সেলসম্যান। তারপর হ্যাম্পশায়ারে খেলা। জীবনের মোড় ঘোরে তারপরেই। অবাক করার মতন ব্যাপার ,কোন কোচ ছিল না তাঁর।

জাতীয় দলে আসাও তো কম চমকপ্রদ নয়। সাল ১৯৭৩, তখন বার্বাডোজে ফার্স্ট ক্লাস খেলা চলছে,তখনকার জাতীয় দলের অধিনায়ক কিংবদন্তি রোহান কাহ্নােই এগিয়ে এলেন তার দিকে, ১কিথ বয়েসের চোট রয়েছে,তুমি বার্বাডোজেই থাক। পরের টেস্ট তো এখানেই হবে। কথা বলব তোমার সাথে। তোমায় দরকার হতে পারে।’

জাতীয় দলের অধিনায়ক,তার কথা তো না করা যায় না। কথামত অপেক্ষা করল অ্যান্ডি। কিন্তু কোথায় কি? কেউ একটাও কথা এসে বলল না তার সাথে। তাহলে তো অপেক্ষা করে লাভ নেই। সোজা ব্যাক টু অ্যান্টিগা। বাড়ি ফিরে দেখে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন লেস্টার বার্ড,যিনি তখন অ্যান্টিগার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট।

‘কাল সকালে তোমায় বার্বাডোজ যেতে হবে টেস্ট খেলতে।’ সংক্ষিপ্ত কথায় সেই শুরু অ্যান্টিগা থেকে জাতীয় দলে দাপটের । যদিও প্রথম টেস্টেই লরেন্স রোর ট্রিপল সেঞ্চুরিতে চাপা পড়ে যায় এক আগুনে নবাগতর অভিষেক।
তবে তাতে জয়যাত্রা থামেনি।

রবার্টসের পরে অ্যান্টিগা থেকে বিশ্বক্রিকেটে রাজত্ব কায়েম করেন রিচি রিচার্ডসন, কার্টলি অ্যামব্রোস, এবং অতি অবশ্যই ভিভ ‘দ্য কিং’ রিচার্ডস।

লোকমুখে প্রচলিত, রবার্টসের বাউন্সার ছিল দুই রকম। দুটিই মিথ। প্রথম ধরণের বাউন্সার খেলা পুল বা হুক দিয়ে সামাল দেওয়া সম্ভব হত যদি বা ব্যাটসম্যান উচ্চ স্তরের হতেন,কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় বাউন্সার টি ছিল একেবারেই ধ্বংসাত্বক আর দ্রুতগতির যা বেশিরভাগের ব্যাটসম্যানের পক্ষেই সামাল দেওয়া সম্ভব হত না। ইয়ান বোথামের দাঁতটি দ্বিতীয় ধরণের বাউন্সারেরই শিকার।

১৯৭৪-৭৫ মৌসুমের ভারত সফর। অবিশ্বাস্য গতি দিয়ে তুলে নিয়েছিলেন ১৮ গড় নিয়ে ৩২ টি উইকেট। ১৯৭৫-৭৬ এর অস্ট্রেলিয়া সফরে ৫-১ হারলেও রবার্টস নিয়েছিলেন ২২ টি উইকেট। তবে এই সিরিজটি স্মরণীয় হয়ে আছে এক যুগান্তকারী কারণে। বলা হয়ে থাকে,এই লজ্জাজনক টেস্ট সিরিজ হারের পরই লয়েড সিদ্ধান্ত নেন তার দলে পেস ব্যাটারি তৈরি করবেন। বাকিটা ইতিহাস।

১৯৭৫ এর বিশ্বকাপেও তাঁর অবদান ভোলার নয়। ব্যাটেও কম ছিলেন না অ্যান্ডি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ উইকেটে ডেরেক মারের সাথে ৬৪ রানের পার্টনারশিপ নিশ্চিত হার বাঁচায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের। বিশ্ববিখ্যাত ফাস্ট বোলারের নামের পাশে কিন্তু তিনটি টেস্ট হাফ সেঞ্চুরি লেখা আছে।

এর পরেই তো সেই কুখ্যাত ‘grudge series’. টনি গ্রেগের সেই কুখ্যাত “গ্রভেল” মন্তব্যের খেসারত বেশ ভালোভাবেই দিতে হয় ইংরেজদের। ক্যারিবিয়ানরা সিরিজ জেতে ৩-০ ফলে। রবার্টস নেন ২৮ টি উইকেট। সেই প্রথম জুটি তৈরি হয় রবার্টস হোল্ডিংয়ের।

দু’বারের বিশ্বজয়ী ঠিক কতটা আতঙ্কের ছিলেন? সাতচল্লিশ টেস্টে ২০২ টা উইকেট,২৫ গড় দিয়ে তাঁকে মাপা যাবে না। একজন ফাস্ট বোলারের সবচেয়ে বড় অস্ত্র গতি আর আগ্রাসন। তার সেরা উদাহরণ ছিলেন তিনিই।

ব্যাটসম্যানেরা তাঁকে ভয় পেতেন। ইমরান খান বলেছিলেন তাঁর দেখা বিপক্ষের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ছিলেন অ্যান্ডি। তাই অভিব্যক্তিহীন একজন দুরন্ত গতির বোলার হিসেবেই বরং আমরা মনে রাখি তাঁকে। বিভিন্ন সংবাদপত্র তাঁকে ঘাতক আখ্যা দিলেও যিনি চাইতেন শুধু ব্যাটসম্যানের উইকেটটুকুই। আইসিসি হল অফ ফেমার স্যার অ্যান্ডি রবার্টস। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মতে, যিনি মাঠের গডফাদারই ছিলেন, সিগারটুকু বাদ দিয়ে।

প্রথম প্রকাশ: ময়দান পত্রিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link