তিনি ভারতের ক্রিকেটের কোনো মহানায়ক নন। ভারতের সমৃদ্ধ ব্যাটিং ঐতিহ্যের বাহক হিসেবে যে নাম গুলো আসে তাঁর বিস্তারিত তালিকাতেও হয়তো তাঁর নাম আসে না। তবুও তিনি ভারতের ক্রিকেট আকাশের তারার মত। কখনো দেখা যায়, কখনো দেখা যায় না। তবে সবাই জানে একজন চেতন চৌহান ছিলেন, চেতন চৌহান আছেন।
মূলত দিল্লীর ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিত হলেও চেতন চৌহানের ক্রিকেটীয় শিক্ষার শুরু হয় পুনেতে। পুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে ১৯৬৬-৬৭ সালে একটি আঞ্চলিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে প্রথম নিজেকে প্রমাণ করেন এই ব্যাটসম্যান। সেবছরই ওয়েস্ট জোনের হয়ে খেলার সুযোগ পান তিনি।
ফাইনাল ম্যাচে যথাক্রমে ৮৮ ও ৬৩ রানের দুটি ইনিংস খেলেন। দুই ইনিংসেই তাঁর ওপেনিং পার্টনার ছিলেন সুনীল গাভাস্কার। যেই ওপেনিং জুটির বীজ সেদিন রোপিত হয়েছিল সেটিই পরবর্তীকালে ভারতের ক্রিকেটের বটগাছ হয়ে ওঠে।
তাঁর ঠিক দুই বছর পর ১৯৬৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন তিনি। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম রানের খাতা খোলেন চার মেরে। পরের বলে আবার মেরেছিলেন ছয়। অভিষেক টেস্টেই চেতন বুঝিয়েছিলেন তিনি বুক চিতিয়ে লড়াই করতে জানেন।
পরিসংখ্যান দেখে ঠিক চেতন চৌহানকে পড়া যাবেনা। কেননা ভারতের ব্যাটিং ইতিহাস নতুন করে লিখা সুনীল গাভাস্কারের সবচেয়ে যোগ্য পার্টনার ছিলেন চেতন চৌহানই। প্রায় এক যুগের ক্যারিয়ারে ভারতের হয়ে মোট ৪০ টি টেস্ট খেলেছেন। এরমধ্যে ৬০ ইনিংসেই ওপেন করেছেন সুনীল গাভাস্কারের সাথে। সেই সময় ভারত তো বটেই বিশ্বক্রিকেটেরও অন্যতম সফল জুটি ছিলেন চেতন ও সুনীল।
৬০ ইনিংসে ৫৪.৮৫ গড়ে এই জুটি থেকে এসেছিল ৩১২৭ রান। তাঁদের মধ্যে মোট ১১ টি শতরানের জুটিও ছিল। তবে তাঁদের সেরা জুটিটি আসে ১৯৭৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। দ্য ওভাল টেস্টে ২১৩ রানের জুটি গড়েন সুনীল ও চেতন। সেই জুটিতে চেতনের ব্যাট থেকে এসেছিল ৮০ রান। সেই ম্যাচে নিজের ২০০০ রানের কোটা পূরণ করেন এই ব্যাটসম্যান।
ঘরোয়া ক্রিকেটেও অসংখ্য রান করেছেন তিনি। ১৭৯ প্রথম শ্রেণির ম্যাচে তাঁর ঝুলিতে আছে ১১১৪৩ রান। সেখানে ২১ টি সেঞ্চুরিও আছে এই ব্যাটসম্যানের ঝুলিতে। তবে ভারতের জার্সিতে এই ব্যাটসম্যানের কোনো সেঞ্চুরি নেই।
অবাক হচ্ছেন? একটা দেশের হয়ে ৪০ টা টেস্ট খেলা কিংবা সুনীল গাভাস্কারের ওপেনিং পার্টনারের নামের পাশে কোনো সেঞ্চুরি না থাকা সত্যিই বিস্ময়কর। তবে এটাই সত্যি।
৪০ টেস্টের ৬৮ ইনিংসে ১৬ টি হাফ সেঞ্চুরি অবশ্য আছে। টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর ঝুলিতে আছে মোট ২০৮৪ রান। তিনিই ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান যিনি কোনো সেঞ্চুরি ছাড়াই ২০০০ রান করেছেন।
টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে এখনও এটিই সেঞ্চুরি বিহীন সর্বোচ্চ রান। তবে লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন কোনো সেঞ্চুরি ছাড়াই ১৪৫ টেস্টে করেছিলেন ৩১৫৪ রান। শেন ওয়ার্নের সর্বোচ্চ ৯৯ রানের ইনিংস রয়েছে। চেতন চৌহানের সর্বোচ্চ ইনিংস আছে ৯৭ রানের।
১৯৮১ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেই নিজের শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলেন তিনি। অথচ তাঁর শেষ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজল্যান্ড সফরে দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনি। ওই সফরে গড়ে ৪১.৫০ রান করেও পরের ইংল্যান্ড সিরিজের জন্য দলে সুযোগ পাননি এই ওপেনিং ব্যাটসম্যান।
হয়তো ভারতীয় দল এমন কোনো ব্যাটসম্যান চাচ্ছিলো যিনি সেঞ্চুরি কিংবা ডাবল সেঞ্চুরি এনে দিতে পারেন। তবে পরবর্তীকালে এই নিয়ে নিজের ক্ষোভের কথা জানিয়েছিলেন চেতন চৌহান।
১৯৮৫ সালে ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে বিদায় নেয়ার পর রাজনীতিতে নাম লেখান এই ক্রিকেটার। ভারতীয় জনতা পার্টির হয়ে দুইবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তিনি। এছাড়া দিল্লি ও ডিস্ট্রিক্ট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনেরও সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি।
এক সময় দিল্লী দলের কোচ হিবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে ২০২০ সালের জুলাইয়ে করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন এই ক্রিকেটার। এরপর থেকে শরীরের নানা জটিলতায় ভুগতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত সেই বছর ১৬ আগস্ট এই পৃথিবীকে বিদায় জানান চেতন চৌহান।