নেদারল্যান্ডসের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় গ্রোনিনজেন শহরের উপকণ্ঠে ছবির মতো সাজানো এক গ্রাম বেডহ্যাম। নেই শহরের মতো কোলাহল, নেই মানুষের কাজের তীব্র চাপ। স্কুল থেকে ফেরার পথে মাঠে ফুটবল খেলে রাস্তায় বল পায়ে কারিকুরি করতে করতে বাড়ি ফিরছে শিশুরা।
তাঁদের নেই ক্রুইফ হবার বাসনা, ফুটবলটা তাঁরা খেলে মনে আনন্দে। বল পায়ে কারিকুরি দেখাতেই তাদেরই যত প্রশান্তি। এই বেডহ্যামেই ১৯৮৪ সালের ২৩ জানুয়ারি জন্ম হয় এক শিশুর। বাবা তাঁর নাম রাখলেন আরিয়েন রোবেন। ছোটবেলা থেকেই অবাক হয়ে সবাই খেয়াল করল রোবেন ছেলেটা ছুটতে পারে খুব দ্রুত, ওর চেয়ে বেশি বয়সী ছেলেরাও দৌঁড়ে পেরে ওঠে না ওর সাথে। পাশাপাশি বাঁ পাটাও দারুণ চলে। একবার বল দাও রোবেনের বাঁ পায়ে, ওকে আর কেউ ধরতে পারবে না। চোখের পলকে মাঠের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাবে।
বেডহ্যাম ছোট এক গ্রাম। ফলে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলো না রোবেনের কথা। এক কান, দুকান হয়ে কথাটা পৌঁছলো স্থানীয় প্রদেশের দল গ্রোনিনজেনের স্কাউটদের কানেও। তারা কাউকে না জানিয়ে এক টুর্নামেন্টের ম্যাচে দেখে গেলেন তার খেলা। ফলাফল স্কুলে থাকতেই ক্লাবে ডাক পড়লো রোবেনের।
শুধু তাই নয়, দলের সাথে কোনো অনুশীলন ছাড়াই ঢুকে গেলেন দলের স্কোয়াডে। মাঠে নামারও সুযোগ পেয়ে গেলেন কয়েক ম্যাচ বাদেই, এফসি টোয়েন্টির বিপক্ষে লিওনার্দো ডস সান্তোসের ইনজুরির কারণে ৭৯ মিনিটেবদলি হিসেবে নামেন। সে ম্যাচের বাকি ১০ মিনিটে গোল করতে না পারলেও পরের ম্যাচে জায়গা পাকা করে নিলেন। ফলশ্রুতিতে রোবেন থাকাকালীন আর কখনোই প্রথম একাদশে সুযোগ পাননি ডস সান্তোস। গ্রোনিনজেনের হয়ে দুই মৌসুম খেলে ৮ গোল করেন এই উইংগার। এরপর পাড়ি জমান নেদারল্যান্ডসের বিখ্যাত ক্লাব পিএসভিতে।
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আয়াক্স আর ফ্রেইনুর্দের দাপটে পিএসভির তখন খারাপ অবস্থা। দলের শিরোপা না দেখে ক্ষুব্ধ ক্লাব সমর্থকরাও। রোবেন যেন ক্লাবে আসলেন পরশ পাথর নিয়ে। মাতেজা কেজম্যানকে সাথে নিয়ে অপ্রতিরোধ্য এক জুটি গড়ে তুললেন সমর্থকরা যাদেরকে ভালোবেসে নাম দেয় ‘ব্যাটম্যান অ্যান্ড রোবেন’। এই দুইয়ের কাঁধে ভর করে সেবার শিরোপার স্বাদ পায় পিএসভি। পিএসভির হয়ে দুই মৌসুমে ৫৬ ম্যাচে করেন ১৭ গোল। পরের মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, জুভেন্টাসের মতো দলকে টেক্কা দিয়ে তাকে দলে ভেড়ায় ইংলিশ জায়ান্ট চেলসি।
চেলসিতে এসে শুরুটা অবশ্য ভালো হয়নি রোবেনের। প্রাক মৌসুম ম্যাচে রোমার বিপক্ষে ম্যাচে এক বাজে চ্যালেঞ্জের ফলে ডান পা ভেঙে যায় তার। এই বাজে সময়ে তিনি পাশে পেয়েছিলেন চেলসি অধিনায়ক জন টেরিকে, ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় তিনি টেরির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে গেছেন।
ইনজুরি থেকে ফিরে সে মৌসুমে করেন সাত গোল। পরের মৌসুমও মিস করেন ব্ল্যাকবার্নের বিপক্ষে ম্যাচে ইনজুরিতে পড়ে। কিন্তু ফিরে এসে ছয় গোল করে চেলসিকে জেতান টানা দুই প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা। চেলসিকে যখন নিজেকে ফিরে পাচ্ছেন তখনি খেলার ধরণ পালটে ফেলেন ব্লুজদের কোচ হোসে মরিনহো। তার ৪-৪-২ ডায়মন্ড ফর্মেশনে রোবেনের কোনো জায়গা ছিল না। এমন সময় ডাক আসে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে। ক্যারিয়ারকে অন্য উচ্চতায় নেবার এই সুযোগ হারাতে চাইলেন না রোবেন, ২৪ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে যোগ দিলেন রিয়ালে।
মাদ্রিদের হয়ে প্রথম মৌসুমে ২৮ ম্যাচে ৫ গোল করার পাশাপাশি দলকে জেতান লা লিগার শিরোপা। রিয়াল সে সিজনে এতটাই অপ্রতিরোধ্য ছিল যে এল ক্ল্যাসিকোর আগেই নিশ্চিত করে ফেলেছিল শিরোপা। পরের মৌসুমেও বজায় রাখেন পারফরমেন্সের ধারাবাহিকতা, ৩৫ ম্যাচে করেন আট গোল। কিন্তু মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট বোর্ডে ঘটে পরিবর্তন, নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসেন ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ।
তারকার সমাবেশ ‘এল গ্যালাক্টিকোস’ বানানোর স্বপ্নে বিভোর পেরেজ একে একে দলে ভেড়ান ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, জাবি আলান্সো, করিম বেনজেমা, কাকাদের মতো ফুটবলারদের। ফলশ্রুতিতে কোচ ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনির অনিচ্ছাসত্ত্বে ক্লাব ছাড়তে হয় রোবেনকে, ২৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে যোগ দেন বায়ার্ন মিউনিখে। বায়ার্নে আসার সিদ্ধান্তটা হয়ে আছে তার ক্যারিয়ারের সেরা সিদ্ধান্ত হিসেবে।
বায়ার্নে এসে পান তারই স্বদেশী রয় ম্যাকয়ের রেখে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী দশ নাম্বার জার্সি। বাম প্রান্তে ফরাসি ফ্রাঙ্ক রিবেরিকে নিয়ে গড়ে তুলেন দুর্ধর্ষ এক জুটি। গতির ঝড় তুলে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে রীতিমতো নাজেহাল করে ছাড়তেন এই দুজন। ভক্তরা ভালোবেসে দুজনকে একত্রে ডাকতেন ‘রবারি’ বলে। নিয়মিত বিরতিতে বুন্দেসলিগা জিতলেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপাটা ধরা দিচ্ছিল না রোবেনের হাতে।
ফাইনালে হারেন দুবার, ২০১০ এবং ২০১২ মৌসুমে। দ্বিতীয় ফাইনাল হারটা ছিল ট্র্যাজিক, অতিরিক্ত সময়ে পেনাল্টি মিস করেন রোবেন। যদিও তার এই দুঃসময়ে পাশে ছিল ক্লাব এবং সমর্থকরা। সেই আস্থার প্রতিদানও রোবেন দেন পরের মৌসুমেই, সেবারের ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে বার্সাকে বিধ্বস্ত করেছিলেন ৮-০ গোলে। ফাইনালের অন্তিম মুহূর্তে জয়সূচক গোলটাও আসে তার পা থেকেই। বায়ার্নের হয়ে দশ বছরে ২০১ ম্যাচ খেলে করেছেন ৯৯ গোল।
বয়সভিত্তিক সব দলে খেলার পর ২০০৩ সালে জাতীয় দলের কমলা জার্সিতে অভিষেক ঘটে রোবেনের। জাতীয় দলে সতীর্থ হিসেবে পেয়েছিলেন দারুণ সব ফুটবলারদের; রবিন ভন পার্সি, ওয়েসলি স্নাইডার, ফন বোমেল, ডির্ক কুইট, ইয়ান ক্লাস হান্টেলারদের। নেদারল্যান্ডসের এই সোনালি প্রজন্ম উঠেছিল ২০১০ বিশ্বকাপের ফাইনালেও, কিন্তু জোহানসবার্গের সেই ফাইনালে হেরে যায় ১-০ গোলে।
সেই ম্যাচে গোলরক্ষককে একা পেয়েও গোল করতে পারেননি রোবেন, ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় তিনি আক্ষেপে পুড়েছেন এই এক মিসের কারণে। ২০১৪ সালে ক্ষয়িষ্ণু এক ডাচ দলকে তুলেছিলেন বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে, কিন্তু আর্জেন্টিনার কাছে টাইব্রেকারে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় সেবারও। কমলা জার্সিতে ৯৬ ম্যাচ খেলে করেছেন ৩৭ গোল।
২০১৯ সালেই দিয়েছিলেন অবসরের ঘোষণা। কিন্তু গতবছর শৈশবের ক্লাব গ্রোনিনজেনের দুরবস্থা দেখে বসে থাকতে পারেননি রোবেন, সমর্থকদের ডাকে অবসর ভেঙে ফিরেছিলেন। মাঠেও নেমেছেন ছয় ম্যাচে। কিন্তু বুঝতে পারছিলেন শরীর সায় দিচ্ছে না, আগের সেই গতিটাও ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাই সরে দাঁড়ালেন আবারো, চিরতরে বুটজোড়া তুলে রাখার ঘোষণা দিয়েছেন মৌসুম শেষেই। ভীষণ নি:সঙ্গ আর স্বার্থপর এক লড়াইয়ের অবসান হল!