বাঁচতে শেখায়, বাঁচাতেও শেখায়

চরিত্রাভিনেতা এবং নায়কের স্টারডমের মধ্যে যে একটা ফারাক থেকেই যায়, তা সর্বজনবিদিত। কাজের সামান্যতম পলেস্তরা খসে পড়ামাত্র যে অনর্গল শ্যূল নিক্ষেপিত হয় চরিত্রাভিনেতার বক্ষে, সেটাকে সহন করে পরের ধাপে নিজেকে যোগ্য প্রতিপন্ন করার মধ্যে থাকে অলিখিত জেদ।

সাহসও বটে। মাঠে একজনের শোল্ডার পুশে অপরজন পড়ে গেল, তথাকথিত ফাউল না হলেও চোখ জ্বলে উঠল পাল্টা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। এই প্রতিশোধ-পাল্টা প্রতিশোধ আর আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের মাঝে যে অদৃশ্য লড়াই লুকিয়ে থাকে, সময় সময় তা বেরিয়ে আসে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো।

মেহনতি মানুষের কথা বলার এই ফুটবল খেলার মধ্যে সে বার্তার দ্যোতনা নিহিত থাকে অতি সন্তর্পণে। কাঠিন্যের রূপ ভয়াবহ। আগুনে পোড়া লোহাকে ছুঁতে নেই। হাত পুড়ে যায়। আর ঐ পুড়ে যাওয়ার হাতের বেদনার চেয়ে মনের বেদনা অনেক বেশি কষ্টদায়ক।

ঠিক এইখানেই ফুটবল। অনেক জেতা-হারাকে পিছিয়ে রেখে মানসিক তৃপ্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া যার এক এবং একমাত্র কর্তব্য। একারণেই কলকাতা শহরে বহু মানুষ জার্মান সমর্থক। যাদের একনিষ্ঠ লড়াইকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। শেষ বাঁশি বাজা না পর্যন্ত তারা অপর্যাপ্ত লড়াই চালিয়ে যায়। শতাব্দী প্রাচীন খেলাটার দুটো দিক উন্মোচিত।

এক, অসম লড়াই। যার পরতে পরতে লেগে আছে অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার কথা। দুই, শৈল্পিক ভাবনা। যারা ঠিক ‘ছিনিয়ে নেব’ টাইপ ভাবে না। তাদের ফুটবল খেলার মধ্যে রোম্যান্টিকতার স্পর্শ অনুভব করা যায়, কিছু মূহূর্তে মনে হয় না যে তারা সত্যিই খেলছে। কারো কারোর পায়ের ছন্দ আমাদের মোহাবিষ্ট করে রাখে।

তার মধ্যেও লড়াই রয়েছে, অস্বীকার্য নয় তবে সেই লড়াইয়ে একটা গান আছে, সুর-তাল-লয়ের মিশেল আছে। এভাবে একটার পর একটা প্রজন্ম শুরু হচ্ছে, পূর্ব প্রজন্মের শেষে পরের প্রজন্মের আগমন ঘটছে তবু ফুটবলের মোহময়তা ধ্রুবক। তার শেষ নেই, অনন্তকালেও।

আসাদুল্লাহ্ খাঁ গালিবের একটি লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে। ‘দিল-এ-নাদান, তুঝে হুয়া ক্যায়া হ্যায়, আখির ইস দার্দ কা দাওয়া ক্যায়া হ্যায়’ – আসলে আমাদের অন্তরে বেঁচে থাকা চির তারুণ্যের রক্তে যে যাতনার নদী ক্ষণে ক্ষণে বয়ে চলে, ফুটবল সেখানে এসে সাময়িকভাবে গোলাপের সুবাস ডেকে আনে।

আমাদের মধ্যে যাদের নিয়মিত খেলা দেখার অভ্যেস আছে, চর্চার সমুদ্দুরে ডুব দেওয়ার মধ্যে যারা খুঁজে পান নিরস জীবনে কিছু আশার আলো, তাদের কাছে ফুটবল অনেকটাই প্রেরণামূলক। প্রেমের বিচ্ছেদকেও যে খেলা ম্লান করে দিতে পারে তার নাম ফুটবল। এই যেমন কিছুদিন আগেই দৈনন্দিন বদ্ধ জীবনের মুহ্যমানতার মাঝে এক পশলা ভালবাসার বাতাস এনে দিল ইউরো কাপ এবং কোপা আমেরিকা।

এক মাসে কেটে যাওয়া রাতগুলো জেনে নিল কত হতাশা, উত্তেজনার বশে ঠায় বসে থাকা, উৎসুক হয়ে আপেক্ষিকভাবে নিম্নমানের ম্যাচেও খুঁজে পাওয়া কিছু মূহূর্ত এবং জয়-পরাজয়ের মাঝে লুকিয়ে থাকা আনন্দের গল্প। এ সবই ফুটবলের দান, আমাদের গড়পড়তা জীবনটাকে একটু আনন্দে ভরিয়ে দেওয়া।

চোখের সামনে একটা প্রজন্ম শেষ হচ্ছে। ধরিত্রীতে সদ্য জন্ম নেওয়া একটা প্রজন্ম কেমন সময়ের চাকার দোলে বড় হয়ে গেছে। যে ছোট খোকাটি একদিন রোনালদিনহোকে দেখে মস্ত বড় ফুটবলার হতে চেয়েছিল সে আজ হন্যে হয়ে চাকরি খোঁজার ফাঁকে দু’চোখে অসহায়তাকে সঙ্গী করে দেখে নেয় মেসির বাঁ পায়ের ফ্রিকিকে গোল। কানাঘুষো শোনা যায়, মেসিদের বয়স বেড়েছে আমাদের মতোই।

নায়কদের বয়স বাড়ে? বরং রবেন, ইনিয়েস্তার মতো চরিত্রাভিনেতার প্রস্থানে বুকটা খানিক হু হু করে ওঠে। নায়ক তো নায়কই হন, স্টারডমের একচুল নড়বড়ে হয় না তাদের। এই নায়ক-চরিত্রাভিনেতাদের ভীড়ে ফুটবল নিত্যদিন যুগিয়ে চলেছে বেঁচে থাকার রসদ। একটা স্বপ্ন, যা কখনওই পূরণ হবে না। তবু, গভীর রাতে নিজেকে আয়তকার মাঠে ষাট-সত্তর হাজার দর্শকের সামনে খেলতে দেখার স্বপ্নের অপর নাম কিন্তু জেদ।

গ্র্যাণ্ড ভাইভাকে মাঠ ধরে নিলেই স্বপ্নটা রাতারাতি বাস্তব। সাহস সঞ্চয় করে নেমে পড়লেই হয়। একটা ফাইনালে হার হবে, দুটো হবে, তিনটে হবে – মেসি কিন্তু পারলেন – হাজারও খোয়াইসে অ্যায়সি, কে হার খোয়াইস পে দাম নিকলে!

প্রতিটি স্বপ্নপূরণের পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর দীর্ঘশ্বাস। জেদ, সাহসকে বুকের খাঁচায় যত্নে লালন করে সে স্বপ্নের দিকে ধাওয়া করে যেতে হয় আর প্রতিটা বাঁকে নতুন চরিত্রদের এনে সে স্বপ্নকে বাস্তবায়নের আশ্বাস দেয় ফুটবল। এমবাপে, কাকার মতো ভাগ্য সবার হয় না। আবার সবাই রিকেলমেও হন না। কেউ কেউ রোনালদো লিমা হন, তবে মধ্যবিত্তের দীর্ঘশ্বাসকে প্রেরণায় পরিণত করার জন্য মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানোর উদাহরণই যথেষ্ট।

ফুটবল বাঁচতে শেখায়, ফুটবল বাঁচাতেও শেখায়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link