১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০। অতিমারির ধাক্কা খানিক সামলে প্রিমিয়ার লিগ সবে শুরু হয়েছে। সাইডলাইনের ধারে অ্যানফিল্ডের টানেলের সামনে অপেক্ষারত গত মৌসুমের লিগ বিজয়ী লিভারপুলের কোচ যুর্গেন ক্লপ এগিয়ে এলেন ১৬ বছর পরে প্রিমিয়ার লিগে উঠে আসা লিডস ইউনাইটেডের কোচ মার্সেলো বিয়েলসাকে স্বাগত জানাতে।
ধারাভাষ্যে পিটার ড্রুরির গলায় ধরা পড়ল এক উচ্ছল আনন্দের সুর। খেলা যত গড়াল আশা-আশঙ্কার দোলাচলে ভুগলেন দুই দলের সমর্থকেরাই (যদিও গ্যালারি দর্শকশূন্য ছিল)। খেলা শেষে লিভারপুলের পক্ষে ম্যাচের ফল হল ৪-৩! ট্যাক্টিক্যাল ইম্পোজিশনের তীব্র লড়াইয়ের শেষে বিয়েলসাকে আলিঙ্গন করে অভিনন্দন জানালেন জয়ী ক্লপ। ম্যাচ শেষে প্রেস কনফারেন্সেও বিপক্ষের জন্য ঝরে পড়ল গভীর শ্রদ্ধা।
ঘটনার ঘনঘটায় ভরা মরসুমের সুরটা এখানেই যেন বাঁধা হয়ে গেছিল। ফুটবলের যে কোনও মঞ্চে মার্সেলো বিয়েলসার পদার্পণ তো এমন ছবিই বারবার উপহার দিয়ে এসেছে। সাইডলাইনের ধারের অস্থির পদচারণা, বাকেটে বসে কফির মগে চুমুক কিংবা হাঁটু গেড়ে বসে ম্যাচের তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণ – খ্যাপা লোকেদের হাতে দুনিয়ার স্থিতিশীলতা বারবার আক্রান্ত হয়। স্বেচ্ছায় অসম্ভবের পায়ে মাথা কূটতে চাওয়ার আইডিয়ালিজমকে ভর করে আর কজনই বা এগোয়?
প্রথম ম্যাচের পরেই হইচই পড়ে গেল ব্রিটিশ মিডিয়ায়। লিডস নিশ্চয় অঘটন ঘটাবে অনেক। কিন্তু মরসুম গড়াতে না গড়াতে একগাদা সংশয় এসে উপস্থিত হতে লাগল। ধারাবাহিকতার অভাব, খারাপ ডিফেন্স লিডসের দৃষ্টিনন্দন খেলার থেকেও বেশি আলোচ্য বিষয় হল। অনেকেই ভুলে গেল যে ১৬ বছর পরে নতুন উঠে আসা দলের কিছু সীমাবদ্ধতাও থাকে।
ফল? ফুটবল পন্ডিত থেকে মিডিয়ার একই চর্বিতচর্বণ। অর্থাৎ, এরকম আক্রমণাত্মক খেলা খেলতে থাকলে লিডস আবার অবনমনে যাবে। ডিফেন্সে জোর দিয়ে পয়েন্ট আদায় করে নেওয়ার লক্ষ্যে খেলা উচিত। এত আক্রমণাত্মক খেলা একেবারেই উচিত না। খেলার স্টাইল পাল্টাতেই হবে ইত্যাদি। গত বছরের শেষের দিকে বিয়েলসার গুণমুগ্ধ প্রখ্যাত ফুটবল লেখক জোনাথন উইলসনও লিখলেন, যেহেতু বিয়েলসা স্টাইল পাল্টাবেন না তাই লিডস নিচের দিক থেকে মিডটেবিলে (২০ দলের খেলায় ১৪-১৫তম স্থানে) শেষ করলেও তাই হবে প্রাপ্তি।
মরসুমের শুরুতেই গত মরসুমের অন্যতম ভরসার ডিফেন্ডার বেন হোয়াইট ফিরে যান নিজের ক্লাব ব্রাইটনে। এক মরসুমের জন্য লোনে নিয়ে আসা হোয়াইটের বদলি খোঁজার ভার পরে বিয়েলসার হাতেই। ট্রান্সফার উইন্ডোয় জার্মানির তরুণ প্রতিশ্রুতিমান ডিফেন্ডার রবিন কক এবং স্পেনের অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার দিয়েগো লোরেন্তেকে সই করায় লিডস।
কিন্তু, অতিমারির কারণে অপেক্ষাকৃত কম প্রাক-মরসুম প্রস্তুতির জন্যই হয়তো ককের মানিয়ে নিতে সময় লাগছিল। আর একটু চোটপ্রবণ লোরেন্তেও ম্যাচ ফিট হচ্ছিলেন না। এর কিছুদিন বাদে ককও ছিটকে গেলেন মাসতিনেকের জন্য। ফলে, ডিফেন্সে সেন্টার ব্যাকদের জুটি তৈরি হল না। অধিকাংশ কোচই এই সময়ে অন্য ধরনের খেলা খেলতে চাইবেন, কিন্তু বিয়েলসা যেহেতু অন্য ধাতুতে গড়া, তাই তিনি মূলত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ২১ বছরের পাসকাল স্ট্রুইককে নিয়ে এলেন রক্ষণে।
প্রথমে অগোছালো হলেও ধীরে ধীরে ভরসাযোগ্য হয়ে উঠলেন এই তরুণ। সেন্টার ব্যাকে কখনও খেললেন দলের ক্যাপ্টেন লিয়াম কুপার (চোট সারা মরসুম ভোগাল তাঁকেও) কিংবা রাইট ব্যাক লিউক আইলিং। অন্যদিকে আক্রমণভাগে দারুণ খেললেন নতুন যোগ দেওয়া ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার রাফিনহা। প্রথম মরসুমেই ৯টা গোলে সহায়তার পাশাপাশি ৬টা গোল করলেন তিনি। আর এক ফরোয়ার্ড রদ্রিগোও দলের মূল স্ট্রাইকার বামফোর্ডকে যোগ্য সহায়তা করলেন।
যে বামফোর্ডকে আগে প্রিমিয়ার লিগে কখনও ১ গোলের বেশি করতে দেখা যায়নি তিনি এবার করলেন ১৭ গোল! খেলার ধরনে একফোঁটাও আপোষ করলেন না বিয়েলসা। কালভিন ফিলিপস দুরন্ত খেললেন মাঝমাঠে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ালেন ডালাস, হ্যারিসন, ক্লিকরা। গোলে ২১ বছরের ফরাসি তরুণ মেলিয়ের মাঝেমাঝে অনভিজ্ঞতার দরুন ভুল করলেও ভবিষ্যতের তারকা হয়ে ওঠার প্রতিশ্রুতিও রেখে গেলেন।
মরসুম শেষে সব পন্ডিত ও ফুটবল বোদ্ধাদের ভুল প্রমাণ করে বিয়েলসার লিডস ইউনাইটেড লিগ অভিযান শেষ করল ৯ম স্থানে। সংগ্রহে ৫৯ পয়েন্ট! এবং তাদের গোলসংখ্যা ৬২! ২০০০-২০০১ মরসুমের পরে প্রিমিয়ার লিগে উঠে আসা নতুন দলগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ গোলসংখ্যা। এবং গোলের সুযোগ তৈরিতে (সংখ্যায় এবং সুযোগ তৈরির সূচক xGF অনুযায়ী) তারা রীতিমত পাল্লা দিল বড় বড় দলগুলোর সঙ্গে।
সৌজন্যে বিয়েলসার ৪-১-৪-১ এর দৃশ্যমান ছক এবং তার আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন ট্রানজিশনাল শেপ। সর্বক্ষণ মুভ করতে থাকা একটা দলের জ্যামিতিক পদ্ধতিতে ভার্টিক্যাল অক্ষ বরাবর আক্রমণের মডেলকে আর একবার প্রত্যক্ষ করল ফুটবল বিশ্ব। তবে যেখানেই মনঃসংযোগ ব্যাহত হল কিংবা খেলোয়াড়দের গুণগত মান বিপক্ষের তুলনায় কম হল সেরকম অনেক ক্ষেত্রে লিডস নিজেদের সিস্টেমকে ইম্পোজ করতে ব্যর্থ হল।
পরাজয়ও এল এই পথ বেয়ে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে প্রথম পর্বে ৬-২ গোলে হার কিংবা রক্ষণ নির্ভর হয়ে গুটিয়ে খেলা দারুণ প্রতিআক্রমণাত্মক খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া টিমের কাছে হার এল এভাবেই। কিন্তু সারা মৌসুমে তাদের গতিশীল ফুটবল, শারীরিক সক্ষমতার চূড়ায় গিয়ে খেলা বিস্মিত করল বিশেষজ্ঞদের আবারও।
যে ‘বিয়েলসা বার্নআউট’-এর মুখরোচক তত্ত্ব ঘুরে বেড়ায় লোকের মুখে মুখে তাও এবার খানিক দমে গেল। মৌসুম শেষে ক্লান্তি তো দূর, বরং শেষ এগারো ম্যাচে মাত্র একটা ম্যাচে হারতে হল লিডসকে। এবং সেই এগারো ম্যাচের মধ্যে ৬টা বড় দলের সঙ্গে ম্যাচ খেলল লিডস যার একটাতেও তাদের হারানো গেল না! লিগ চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটি, রানার্স আপ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, তৃতীয় লিভারপুল, চতুর্থ চেলসি, আর্সেনাল এবং টটেনহ্যাম সবার বিরুদ্ধেই এই পর্বে অপরাজিত রইল লিডস।
‘ফুটবল খেলার জনপ্রিয়তার একটা বড় কারণ হল, দুর্বল দলও শক্তিশালী দলকে হারিয়ে দিতে পারে’- বিয়েলসার এই উক্তিটি ফুটবলবিশ্বে খুবই জনপ্রিয়। লিগ চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটি দুই পর্ব মিলে লিডসকে একবারও হারাতে তো পারলই না, উল্টে নিজেদের ঘরের মাঠে ১০ জন হয়ে যাওয়া লিডসের কাছে হারতে হল তাদের। যে দলের কোচ পেপ গার্দিওলা মৌসুমের শুরুতে বিয়েলসা সম্বন্ধে বলেছিলেন, ‘বিশ্বের সেরা কোচ এবার প্রিমিয়ার লিগে আসছেন।’
বিয়েলসার ওই বিশেষ উক্তিটি এই মরসুমে আরও একবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল যখন ইউরোপের মুষ্টিমেয় ধনী ও শক্তিশালী ফুটবল দলের মালিকেরা একত্রিত হয়ে আলাদা ইউরোপিয়ান সুপার লিগ গঠন করতে চাইল। ইংল্যান্ডের বিগ সিক্স অর্থাৎ (দুই ম্যানচেস্টার, লিভারপুল, চেলসি, আর্সেনাল ও টটেনহ্যাম), স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা, ইতালির জুভেন্টাস, এসি মিলান, ইন্টার মিলানের মালিকদের মস্তিষ্কপ্রসূত এই ফুটবল মডেলের সার বক্তব্য, আমরা নিজেদের লিগ করব। ছোট, দুর্বল দলেদের ‘বিরক্তিকর’ খেলা কেউ দেখতে চায় না। তাই তাদের দরকার নেই। ভাল মুনাফা লাভের জন্য এই মডেল আমাদের অনুসরণ করতেই হবে।
বেঁকে বসল সারা ফুটবল বিশ্ব। সমর্থকদের বিক্ষোভ আছড়ে পড়ল স্টেডিয়ামের বাইরে। এই কটা ক্লাবের মালিকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হল তারা। মডেলের প্রস্তাবকারী ক্লাবেদের সমর্থক এমনকি প্রশিক্ষক এবং খেলোয়াড়েরাও কার্যত বিদ্রোহ করলেন। মিডিয়ায় আসতে লাগল তাঁদের বক্তব্য। এমনই এক প্রেস কনফারেন্সে বিয়েলসা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যুগসত্যকে।
তাঁর মতে, এটা হওয়ারই ছিল। শুধুমাত্র ফুটবল কেন, সারা বিশ্বে সমাজজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই আমরা কি এই ছবি দেখতে পাই না? ফুটবল কি তার বাইরে কিছু? ধনী ও শক্তিশালী বরাবরই মুনাফা লাভের আশায় আরও ধনী, আরও শক্তিশালী হতে চায়। আর সেই রাস্তায় গরীব কিংবা দুর্বলকে মাড়িয়ে যেতে তার বাধে না। সারা বিশ্বের যে অর্থনৈতিক কাঠামো তার থেকে এটাই প্রত্যাশিত। একদিন না একদিন এটা হতই।
তবে বিয়েলসা একই সঙ্গে মনে করিয়ে দিলেন, ফুটবল কিন্তু শুধুমাত্র ব্যবসা নয়। ফুটবল সবার জন্য। যারা নিজেদের মালিক ও সর্বশক্তিমান বলে মনে করছেন তারাই একমাত্র নন এটা মনে রাখতে হবে। বরং ফুটবলের আসল মালিকানা রয়েছে সেই সমস্ত অগণিত সমর্থকদের হাতে যাঁরা নিজের দলের স্মারকচিহ্নকে হৃদয়ে নিয়ে সমর্থন জানান।
বিয়েলসার স্বদেশীয়, আন্তর্জাতিক মহলে খ্যাতনামা সাহিত্যিক হর্হে লুই বর্হেস একবার বলেছিলেন, ‘ফুটবল খেলা জনপ্রিয় কারণ পৃথিবীতে নির্বুদ্ধিতার সমাদর বেশি।’ বর্হেস প্রয়াত হওয়ার ঠিক পনেরো দিন বাদে শুধুমাত্র ফুটবলকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বে আর্জেন্টিনার নামকে আলাদা ভাবে জনসংস্কৃতির অংশ করে তোলেন যে মানুষটি তাঁর নাম দিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনা।
এহেন ‘নির্বুদ্ধিতা’র প্রসারে তাঁর একমাত্র পন্থা ছিল পায়ের সঙ্গে বলের জাদুকরী সহাবস্থান। ২০২০তে যখন মারাদোনা মারা গেলেন, তাঁর স্মৃতিচারণায় বিয়েলসা টেনে আনলেন সেই শৈল্পিক আখ্যানকে। যেখানে একজন শিল্পীর শিল্পকে প্রত্যক্ষ করে জনতা অনুভব করে নিজেদের বাঁধনছেঁড়ার হাতছানি, প্রতিটি মানুষ শিল্পের সেই অপার মুক্তির পথে পৌঁছে যেতে চায় নিজের সীমাবদ্ধতা ভুলে।
বিয়েলসার সিস্টেম-নির্ভর ফুটবলও সেই কথাই বলে। অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা অথচ প্রতিভাবান কিংবা প্রতিভাবান নয় এমন খেলোয়াড় বা তাদের নিয়ে গড়ে ওঠা দলকে পথ দেখিয়েই তিনি পাড়ি দিতে চান সেই অদ্ভুত অচেনা মুক্তির পথে। যেখানে দর্শকের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ তৈরি হয় সৌন্দর্যকে পাথেয় করে। এ পথেই পিছিয়ে থাকা দুনিয়ার উত্তরণের স্বীকৃতি।
বরাবরের মতই বন্ধুর বিয়েলসার এই আইডিয়ালিজমের রাস্তা। লিডসের জীবন ভাল লাগায় চতুর্থ মরসুমের জন্য লিডসে থেকে যাচ্ছেন তিনি। আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের দায়িত্ব ছাড়ার পরে জীবনে প্রথমবার টানা চার মরসুম কোথাও দায়িত্বে থাকছেন তিনি। সামনের মরসুমে আবার এক নতুন চ্যালেঞ্জ। আবার নতুন করে শুরু।
কিন্তু, ফুটবলের বাইরে, এই ‘নির্বুদ্ধিতা’র বেড়াজাল ভেঙে তাঁর কি নিষ্কৃতি আছে? গতবারের সঙ্গে এবারের পার্থক্য, এবার হয়তো দর্শকাসন ভরে উঠবে এল্যান্ড রোডে। বিয়েলসা আরও একবার অনুভব করবেন আত্মিক সংযোগ। ইংল্যান্ডের এক শহরে জনসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠা এই আর্জেন্টাইনের নামাঙ্কিত রাস্তায় হয়তো উচ্ছ্বাসে মাতবেন সমর্থকেরা।