বৈভব, মুনাফা আর গ্ল্যামার-এই ত্রয়ী কি ভারতীয় ক্রিকেট কে পুরোপুরি গ্রাস করলো? কেন এই প্রশ্ন টা করছি? অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণেই।
তার আগে একটু ভূমিকা দেয়া যাক।
আমরা জানি, এই অতিমারীর কবলে পরে মার্চ থেকে মে, এই ক’মাস শুধু ক্রিকেট কেন, পৃথিবীর প্রায় সব খেলাই অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু জুন থেকে আবার একটু একটু করে প্রায় সব খেলাই শুরু হয়েছে। ক্রিকেটও ব্যতিক্রম নয়। ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট সিরিজ দিয়ে শুরু হয়েছে এ মৌসুমের ক্রিকেটযজ্ঞ।
হলোই বা ফাঁকা মাঠ, দূরদর্শনের কল্যানে তো আমরা সকলেই দেখতে পাচ্ছি। ইংল্যান্ড এরপর কাউন্টি ক্রিকেট ও শুরু করেছে, যা এই লেখা লেখার সময় শেষ পর্যায়। এসেক্স এবং সামারসেট লর্ডসের ফাইনালে নব্য নামাঙ্কিত বব উইলিস ট্রফি পাওয়ার জন্যে লড়াই করছে। এরপর পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ড সফর করেছে, মাঝে হয়ে গেছে ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (সিপিএল)। মোদ্দা কথা, গোটা পৃথিবীতেই আবার ক্রিকেট খেলা চালু হয়েছে, যা আমরা এপ্রিলের শুরুতে হয়তো ভাবতেও পারিনি।
এবার আসা যাক ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) প্রসঙ্গে। ভারতের বহু তথাকথিত ক্রিকেটপ্রেমীকে হতাশার অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখাচ্ছে ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই টুর্নামেন্ট। গোটা সমাজমাধ্যমে তোলপাড় চলছে কেন কেকেআর প্যাট কামিন্সকে ১৫ কোটি দিয়ে কিনলো, বা ধোনির সাত নম্বরে নামা আদৌ যুক্তিযুক্ত কিনা তা নিয়ে।
অথচ, এই হাজার ওয়াটের আলোর উদ্দাম নৃত্যের নিচে লুকিয়ে রয়েছে গাঢ় অন্ধকার, যা আদৌ কাটবে কিনা, বা কাটলেও কিভাবে তার কোনো দিকনির্দেশ নেই বিসিসিআই সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলি বা বোর্ড সচিব জয় শাহর কাছে। অভিনব মুকুন্দ কদিন আগে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটার দের মতো চুক্তি ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটার রা পান না।
বহু এমন ক্রিকেটার আছেন, যাঁদের সংসার চলে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে। ভারত যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা নিউজিলান্ডের মতো গরিব বোর্ড হতো, তাহলে কিছু বলার বা করার থাকতো না। কিন্তু ভারতীয় বোর্ডের যে পরিমান আয়, তা হয়তো অন্য কোনো বোর্ডের নেই। তা সত্ত্বেও ঘরোয়া ক্রিকেটার দের এই অবস্থা সত্যি ভাবায়। আই.পি.এল. আয়োজন করা হচ্ছে, তাতে কারোর কোনো আপত্তি থাকার কারণ নেই।
শুধু নীতি ও আদর্শের কচকচি, তাও পয়সা কে অবহেলা করে আজকের দিনে ততটাই অচল যতটা কম্পিউটারের যুগে টাইপরাইটার। কিন্তু আদৌ ঘরোয়া ক্রিকেট হবে কিনা, কিভাবে হবে, কোথায় হবে, তা নিয়ে যেন কারোর মাথাব্যথা নেই। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেট আয়োজনের দিকে যথেষ্ট জোর দিচ্ছে। এর ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, ঠিক যে কারণে আমরা প্রাক্তন খেলোয়াড় দের ক্রিকেট প্রশাসনে চাইতাম ব্যবসায়ীদের বদলে, সে উদ্দেশ্য কি সফল হলো? কায়েমী স্বার্থের যাঁতাকল থেকে আজো কি ভারতীয় ক্রিকেট মুক্ত হয়নি?
মিতালি রাজ বলেছেন, আমরা ট্রেনিং করছি, কিন্তু কি উদ্দেশ্যে করছি তা জানিনা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইংল্যান্ডের নারীদের সিরিজ চলছে। নিউজিল্যান্ড যাবে অস্ট্রেলিয়া সফরে সামনের মাসে। অথচ যে মেয়েদের ক্রিকেটে আমরা প্রথম সারির দল, তাদের আগামী খেলা কোথায় বা কবে আমরা জানিনা। ভারত ছাড়া বিশ্বের আর কোনো নারী ক্রিকেট দল দর্শক পরিপূর্ণ লর্ডস বা মেলবোর্নে খেলেনি। কিন্তু তাঁদের দশা আজ এরকম।
ভারতীয় বোর্ডের সাথে আমিরাতের ক্রিকেট চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। সেখানেও তো ছোট করে নকআউট নিয়মে রঞ্জি আয়োজন করা সম্ভব, একই ভাবে বিজয় হাজারে বা মুশতাক আলীও আয়োজন করা যায়। হ্যাঁ, আর্থিক ভাবে হয়তো কিছু ক্ষতির সম্মুখীন হবে বোর্ড, কিন্তু আগামী দিনে সেটা কি পুষিয়ে দেয়া যাবে না? মনে রাখতে হবে, আজও টেস্টে সুযোগ পেতে রঞ্জিতে ভালো করা ছাড়া অন্য রাস্তা নেই, কাজেই ঘরোয়া ক্রিকেট কে এটুকু গুরুত্ব দেয়াই যায়। কিন্তু আদৌ দিচ্ছে কি বিসিসিআই?