জেফ থমসন, দ্য স্লিংশট
তাঁর বলে গতির বাড়াবাড়ি দেখেই কিনা ঘরোয়া ক্রিকেটে মাত্র পাঁচ ম্যাচ খেলার পর তড়িঘড়ি করে তাকে জাতীয় দলে ডেকে নেন নির্বাচকরা। কিন্তু ম্যাচের দুইদিন আগে পায়ের হাড় ভেঙে ফেলেন। যদিও ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ পড়ার স্বপ্নে বিভোর থমসন কাউকে জানাননি সে কথা। ভাঙা পা নিয়েই খেলেন পুরো টেস্ট। তীব্র ব্যথা নিয়ে খেলে যাওয়ার ফলাফলস্বরূপ অভিষেক ম্যাচে ১১০ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকেন তিনি। সেবারই বোধহয় প্রথম ও শেষবারের মতো কোনো দল তাঁর গোলার আঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
১৯৭৮ সালে ক্যারি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ বদলে দিয়েছিল ক্রিকেটের গতিপথ। মাঠের খেলার পাশাপাশি দারুণ সব উদ্ভাবনী আইডিয়া দিয়ে দর্শকদের বিমোহিত করেছিলেন অজি এই মিডিয়া টাইকুন। তারই অংশ ছিল বিশ্বের বাঘা বাঘা সব পেসারদের গতির প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেয়া।
আমাদের আজকের ঘটনার নায়ক অবশ্য তখন খেলার মাঝে নেই। এক বছরের নিষেধাজ্ঞা পেয়ে অখন্ড অবসর কাটাচ্ছেন পরিবারের সাথে। নিষেধাজ্ঞার থোড়াই কেয়ার, স্লেজিং-আগ্রাসন আর গতি দিয়ে ব্যাটসম্যানকে ঘায়েল করতে না পারলে সে আবার কিসের পেসার! হুট করেই ফোন পেলেন ক্যারি প্যাকারের, চলে এসো গ্যাবায়। মাঠে পৌঁছে তো থ মেরে গেলেন; ইমরান খান, অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, কোর্টনি ওয়ালশ, ডেনিস লিলি, মাইকেল হোল্ডিংরা তখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন বল ছোঁড়ার।
এদিকে তিনি আবার জুতা নিয়ে আসেননি, কি আর করার বন্ধুর জুতা ধার করেই বল করলেন। বল করেই ক্ষান্ত দিলেন না, ১৬০.৩ কিমি/ঘন্টায় গতিতে বল করে গড়লেন বিশ্বরেকর্ড। তাতে অবশ্য তার কোনো হেলদোল নেই কারণ সবাই জানে ম্যাচে এর চেয়েও জোরে বল করেন তিনি। অজি এই পেসারটি ছিলেন জেফ থমসন, সমর্থকদের কাছে যিনি ‘থম্মো’ নামেই বেশি পরিচিত।
নিউ সাউথ ওয়েলশের গ্রিনার্কে নামক ছোট্ট এক শহরে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা জেফরি রবার্ট থমসনের। ডন ব্র্যাডম্যান, আর্থার মরিস, ভিক্টর ট্রাম্পারের মতো ব্যাটসম্যানরা তার রাজ্য থেকে উঠে এলেও ছোটবেলা থেকেই থমসনের ভালোবাসা ছিল বলে গতির ঝড় তোলা।
বাবার কাছে থেকে আয়ত্ব করেছিলেন স্লিঙ্গিং অ্যাকশনের শিল্প আর তা দিয়েই ঘায়েল করে গিয়েছেন পুরো বিশ্বের ব্যাটসম্যানদের। তাঁর বলে গতির বাড়াবাড়ি দেখেই কিনা ঘরোয়া ক্রিকেটে মাত্র পাঁচ ম্যাচ খেলার পর তড়িঘড়ি করে তাকে জাতীয় দলে ডেকে নেন নির্বাচকরা। কিন্তু ম্যাচের দুইদিন আগে পায়ের হাড় ভেঙে ফেলেন।
যদিও ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ পড়ার স্বপ্নে বিভোর থমসন কাউকে জানাননি সে কথা। ভাঙা পা নিয়েই খেলেন পুরো টেস্ট। তীব্র ব্যথা নিয়ে খেলে যাওয়ার ফলাফলস্বরূপ অভিষেক ম্যাচে ১১০ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকেন তিনি। সেবারই বোধহয় প্রথম ও শেষবারের মতো কোনো দল তাঁর গোলার আঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
পরের বছর অ্যাশেজে সুযোগ পেয়েই তুলে নেন ছয় উইকেট। তৃতীয় টেস্টে পাঁচ উইকেট নেবার পাশাপাশি ইনজুরিতে ফেলেন তিন ইংরেজ ব্যাটসম্যানকে। সিম কিংবা সুইং নয় কেবল গতি দিয়েই তিনি ত্রাসের সঞ্চার করেছিলেন বিশ্বের ব্যাটসমানদের মাঝে। বাঘা বাঘা সব ক্রিকেটারের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি।
সেবারের অ্যাশেজে ৩৩ উইকেট নেন তিনি যেটা ছিল কিনা অ্যাশেজের ইতিহাসে এক সিরিজে নেয়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটসংখ্যা। শুধু বল হাতে নয় মাঝে মাঝে ব্যাট হাতে আলো ছড়াতেন তিনি। এজবাস্টনে একবার ইংরেজ বোলারদের সামলে করেছিলেন ৪৯ রান। ব্রিজটাউনে ক্লাইভ লয়েড, রোহান কাহ্নাই, ভিভ রিচার্ডসদের বিপক্ষে ১৮ রানে নিয়েছিলেন ছয় উইকেট। একবার তো ফেলে দিয়েছিলেন ভিভ রিচার্ডসের মাথার ক্যাপও!
এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ব্যাটসমানদের আউট করে নয় বরং ক্রিজে রক্ত দেখতেই বেশি পছন্দ করেন তিনি। ডেনিস লিলিকে সাথে নিয়ে গড়েছিলেন ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা জুটির একটি। দু প্রান্ত থেকে তুলতেন গতির ঝড়, ব্যাটসমানদের তখন অবস্থা হতো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।
থমসনের ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় অজিদের হয়ে উইকেটের পেছনটা সামলেছেন রড মার্শ। তাঁর ভাষ্যমতে থমসন কম করে হলেও ১৮০ কিমি গতিতে বল করে গিয়েছেন ক্যারিয়ারের সেরা সময়টাতে। একই অভিমত তাঁর দুই সতীর্থ ইয়ান চ্যাপেল এবং অ্যাশলে ম্যালেটের।
১৯৮৫ সালে অবসর নেবার আগে খেলেছেন ৫১ টি টেস্ট এবং ৫০ টি একদিনের ম্যাচ। টেস্টে ইনিংসে আটবার পাঁচ উইকেট নেবার পাশাপাশি শিকার করেছেন ২০০ উইকেট। সাদা বলের ক্রিকেটেও কম যান না, শিকার করেছেন ৫৫ উইকেট।
৪২ বছর বয়সেও ঘরোয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলার ছিলেন তিনি। জাতীয় দলেও ফিরতে চেয়েছিলেন কিন্তু নির্বাচকরা তরুণ ক্রিকেটারদের প্রাধান্য দেওয়াতে আর প্রত্যাবর্তন করা হয়নি তার। ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার হল অব ফেমে যুক্ত করা হয় তাঁকে।
ওই সময় ডেনিস লিলির সাথে তাঁর জুটি বেশ জমে উঠেছিল – দু’জন মিলে কত ব্যাটসম্যানের রাতের ঘুম যে হারাম করেছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। তবে, দু’জনের প্রথম দেখাটা সুখকর ছিল না। ঘরোয়া এক ম্যাচে লিলি তখন ব্যাটিংয়ে। থমসন একটা বাউন্সার দিয়েই কি একটা বললেন কাছে গিয়ে। সতীর্থ ডগ ওয়াল্টার এসে সাবধান করলেন। তাতে, থমসন থোড়াই কেয়ার করলেন। কে জানতো, একদিন এই ভয় দেখানোর কাজটা লিলি-থমসন এক যোগে করবেন!