অভিষেক সবসময় স্মরণীয়। আর জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক ম্যাচটা হয় রাজকীয় ফরম্যাট টেস্ট, তবে তো সোনায় সোহাগা। বহু বছরের একাগ্রতা আর পরিশ্রমের পরেই কেবল সৌভাগ্য হয় জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানোর। সব ক্রিকেটারই চান অভিষেকটা স্মরণীয় করে রাখতে, সবাইকে ছাপিয়ে যেতে।
অভিষেকে একটা সেঞ্চুরি কিংবা পাঁচ উইকেটই পারে রেকর্ডবুকে নাম খোদাই করতে। সেখানে অভিষেক টেস্টেই দুই সেঞ্চুরি! সে তো কেবল স্বপ্নেই সম্ভব। এই কাজটাই প্রথম করেছিলেন ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যান লরেন্স রো, ১৯৭৩ সাথে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে।
সেই ঘটনার ত্রিশ বছর পর পুনরাবৃত্তি ঘটান পাকিস্থানি ব্যাটসম্যান ইয়াসির হামিদ। বাংলাদেশের বিপক্ষে করাচি টেস্টে অভিষেকেই দুই ইনিংসে হাঁকান সেঞ্চুরি। তবে, ইয়াসির হামিদ যে সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিলেন, সেটা আদৌ ধরে রাখতে পারেননি।
২০০৩ বিশ্বকাপে বাজে ফলাফলের দরুণ বড় ধরনের পরিবর্তন আসে পাকিস্থান দলে। মোহাম্মদ হাফিজ, উমর গুল, শোয়েব মালিক, ইয়াসির হামিদদের মতো তরুণ প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানরা ডাক পান জাতীয় দলে। কপিবুক স্টাইলে ব্যাটিং, মাঠের চারপাশে শট খেলার সক্ষমতা সবমিলিয়ে ইয়াসির হামিদে পাকিস্থান খুঁজে পেয়েছিল নির্ভরতা।
সেবার করাচিতে পাকিস্থানের মুখোমুখি হয়েছিল টেস্ট ক্রিকেটের নবীনতম সদস্য বাংলাদেশ। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের পরাজয়টা অনুমেয়ই ছিল। যদিও ম্যাচেই পাকিস্থানকে ভালোই পরীক্ষার মুখে ফেলেছিল হাবিবুল বাশারের দল।
পাকিস্থানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সে ম্যাচে ইয়াসিরের পাশাপাশি অভিষেক ঘটে মোহাম্মদ হাফিজ, উমর গুল, শাব্বির আহমেদেরও। টসে জিতে শুরুতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন পাকিস্থান দলপতি রশিদ লতিফ। হাবিবুল বাশারের ৭১ এবং রাজিন সালেহর ৪৮ রানে ভর করে ২৮৮ রানের লড়াকু সংগ্রহ পায় বাংলাদেশ।
জবাব দিতে নেমে মাত্র পাঁচ রানেই অভিষিক্ত হাফিজ ফিরে গেলে উইকেটে আসেন ইয়াসির। শুরু থেকেই সাবলীল ব্যাটিং করতে থাকেন ইয়াসির। বলতে গেলে ১৭০ রানের ইনিংসে একবারো সুযোগ দেননি বাংলাদেশি বোলারদের।
প্রথমে তৌফিক উমর এবং পরে দুই অভিজ্ঞ ইনজামাম উল হক ও ইউসুফ ইয়োহানার (মোহাম্মদ ইউসুফ) সাথে জুটি বেঁধে রানের চাকা সচল রাখেন তিনি। সবাই ভেবেছিল তিনি ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলবেন। কিন্ত ব্যক্তিগত ১৭০ রানের মাথায় মোহাম্মদ রফিকের বলে মাশরাফি বিন মর্তুজার হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরেন তিনি। পাকিস্থান অলআউট হয় ৩৪৬ রানে, লিড পায় ৫৮ রানের।
দ্বিতীয় ইনিংসে হাবিবুল বাশারের ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি এবং রাজিন সালেহর ফিফটিতে সত্ত্বেও শাব্বির আহমেদের বোলিং তোপে পড়ে ২৭৪ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ। পাকিস্থানের সামনে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ২১৭ রানের। এবারও শুরুতেই তৌফিক উমরের উইকেট হারিয়ে পাকিস্থান চাপে পড়লেও দ্রুতই তা কাটিয়ে উঠে ইয়াসিরের ব্যাটে ভর করে।
দারুণ ব্যাটিং করে মাত্র ৭১ বলে তুলে নেন ফিফটি। মোহাম্মদ রফিকের বলটা মিড অনে ঠেলে দিয়ে দুই রান নিয়ে পৌঁছে যান তিন অংকের ঘরে। স্পর্শ করেন লরেন্স রো’র ত্রিশ বছর আগের রেকর্ড। যদিও রফিকের বলে ১০৫ রানের বেশি করতে পারেননি দ্বিতীয় ইনিংসে। পরে ইনজামাম উল হক এবং ইউসুফ ইউহানার ব্যাটে ভর করে সহজেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় পাকিস্থান।
এমন ঝলমলে শুরুর পর সবাই ভেবেছিল পরবর্তী দশকজুড়ে পাকিস্থানের ব্যাটিং লাইনআপকে নেতৃত্ব দেবেন ইয়াসির। কিন্তু সেরকমটা হয়নি, নিজের ক্যারিয়ারের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি তিনি। ফলে তার ক্যারিয়ার থেমে গেছে ২৫ টেস্টেই, এমনকি আর কোনো সেঞ্চুরির দেখা পাননি তিনি।
অভিষেক টেস্টের পর সর্বোচ্চ ৯১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন ভারতের বিপক্ষে মুলতান টেস্টে। ফলে ২০০৭ সালে জাতীয় দলে জায়গা হারান তিনি। আর কখনোই সেভাবে প্রচারের আলোয় আসতে পারেননি।
ওয়ানডেতেই বরং তার পারফরম্যান্স ছিল তুলনামূলক ভাল। ৫৬ টি ম্যাচে ৩৬-এর ওপর গড় নিয়ে করেন ২০৪৮ রান। তিনটি সেঞ্চুরির সাথে হাফ সেঞ্চুরি আছে ১২ টি।
২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডস টেস্টই হয়ে আছে তার ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট হিসেবে। পাকিস্তানের হয়ে ২৫ টেস্টে ৩২.২৬ গড়ে ১,৪৯১ রান করেন তিনি। সেঞ্চুরি ওই দু’টোই!
ওহ, সেই লর্ডস টেস্টটার কথা মনে আছে তো? স্পট ফিক্সিংয়ের বিতর্ক মাখা সেই টেস্ট। নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডের স্টিং অপারেশনে তাঁর নামও আসে। সরাসরি তিনি স্পট ফিক্সিংয়ে অবশ্য জড়িত ছিলেন না। তবুও পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) তাঁকে নিষিদ্ধ করে। তিনি ব্রিটিশ গণমাধ্যমটির বিরুদ্ধে আইনী লড়াইয়ে আংশিক বিজয় পেয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরেও আসেন। তবে, আর কখনোই জাতীয় দলে ফিরতে পারেননি।