পাওয়ারফুল এক রমেশের গল্প

আধুনিক ক্রিকেটে যেকোনো দলে সুযোপ পাবার সবচেয়ে প্রথম শর্ত হলো ফিট থাকা। বিপ টেস্টের যুগ পেরিয়ে ক্রিকেট প্রবেশ করেছে ইয়ো ইয়ো টেস্টের যুগে। ফলে আগের যুগের সেই বিশালদেহী খেলোয়াড়দের দেখা খুব একটা মেলে না। তারপরও দু চারজন এই যুগেও নজর কেড়ে নেন।

ডোয়াইন লেভেরক, ইনজামাম উল হক থেকে শুরু করে হালের রাকিম কর্নওয়ালরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বাইশ গজ। এই শতাব্দীর শুরুর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতীয় দলেও খেলেছেন এক বিশালদেহী। বলা হচ্ছে রমেশ পাওয়ারের কথা, অফস্পিনের পাশাপাশি নিচের দিকে নেমে ব্যাটে ঝড় তুলতে বিখ্যাত ছিলেন তিনি।

ভারতীয় জাতীয় ক্রিকেট একাডেমির প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথম আগমন ঘটে ১৯৯৯ মৌসুমেই। যদিও তার প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠা আরো বছর তিনেক পরে। ২০০২-০৩ মৌসুমে মুম্বাইয়ের হয়ে ৪৬ উইকেট নেন তিনি। পাশাপাশি সাত নাম্বারে ব্যাট করতে নেমে প্রায় ৪৭ গড়ে করেন ৪১৮ রান।

যদিও, তার সেরাটা দেখানো ছিল তখনো বাকি। তারকা খচিত মুম্বাই দল যখনই বিপদে পড়েছে দাঁড়িয়ে গেছেন রমেশ পাওয়ার। ২০০৩ মৌসুমে ইরানি ট্রফির ম্যাচে শক্তিশালি রেস্ট অফ ইন্ডিয়ার বিপক্ষে খেলেন ৫৭ রানের ইনিংস। অথচ সেদিন হরভজন সিং এবং অনিল কুম্বলের ঘূর্ণির সামনে দাঁড়াতেই পারেনি মুম্বাইয়ের টপ অর্ডার।

নিচের সারির ব্যাটসম্যানদের সাথে নিয়ে দলকে লড়াই করবার মতো সংগ্রহ এনে দেন পাওয়ার। এছাড়া বল হাতে সেদিন সাজঘরে ফিরিয়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলি, যুবরাজ সিংদের মতো ব্যাটসম্যানদের। সেই ম্যাচ দিয়েই মূলত জাতীয় দলে নিজের আগমনের পূর্বাভাস দিয়ে রাখেন পাওয়ার।

রমেশ পাওয়ারের বোলিংয়ের মূল শক্তি ছিল তার ফ্লাইট। বলকে হাওয়ায় ভাসিয়ে ব্যাটসম্যানদের শট খেলতে প্রলুব্ধ করতেন তিনি। বলা যায় একদম ক্ল্যাসিকাল অফস্পিনার ছিলেন রমেশ পাওয়ার যিনি নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝে মাথা খাটিয়ে বল করতেন। পাশাপাশি নিচের দিকে নেমে ঝড়ো সব ইনিংস খেলতে তার জুড়ি মেলা ভার। পরের বছর রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে একদিনের ম্যাচে অভিষেক হয় পাওয়ারের।

যদিও অভিষেকে বল হাতে ব্যর্থ ছিলেন তিনি, ইনজামাম উল হক বেশ কয়েকবার মাঠছাড়া করেন তাকে। তবে ৩৩০ রানের টার্গেটে ব্যাট করা ভারতকে প্রায় অবিশ্বাস্য এক জয় এনে দিতে যাচ্ছিলেন তিনি। শোয়েব আখতার এবং মোহাম্মদ সামির মতো বোলারকে সামলে অপরাজিত থাকেন ১১ বলে ১৮ রান করে। অন্য প্রান্তের ব্যাটসম্যানদের সহায়তা না পাওয়ায় সেদিন তাকে থেমে যেতে হয় জয় থেকে ১১ রান দূরে থাকতেই।

তবে প্রথম সেই সফর অনেক কিছু শিখিয়েছিল তাকে, করেছিল অনেক বেশি পরিপক্ব। দু’বছর পরের পাকিস্থান সফরে তাই দেখা মিলেছিল অন্য এক পাওয়ারের, প্রথম ম্যাচেই ইনজামামকে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে ফেলে নিয়েছিলেন প্রতিশোধ।

সে বছরের ইংল্যান্ড সফরে হরভজন সিংয়ের সাথে মিলে ভারতের স্পিন বোলিং ডিপার্টমেন্ট সামলান তিনি। তার ৫০ কি.মি. গতির স্পিন খেলতে সেবার হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল ইংরেজ ব্যাটসম্যানরা। গ্রেগ চ্যাপেল ভারতের কোচ থাকাকালীন প্রায় সব ম্যাচেই মাঠে নেমেছেন রমেশ পাওয়ার। অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়েরও পছন্দের একজন ছিলেন তিনি।

২০০৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যাবার আগে এক সাক্ষাৎকারে পাওয়ার বলেন তিনি ইনজুরির কারণে কোনো ম্যাচ কখনো মিস করেননি। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, সফর শুরুর আগেই অ্যাংকেলের চোটে পড়ে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ মিস করেন তিনি। সে সিরিজে ক্রিস গেইল এবং ব্রায়ান লারার মতো ব্যাটসম্যানের উইকেট নেন তিনি। পরের বছর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ২৪ রানে নেন তিনি। সীমিত ওভারে ক্রিকেটে রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছিলেন তিনি।

মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে দারুণ ফ্যাশন সচেতন ছিলেন পাওয়ার। তার লাল চশমা এবং মোটাসোটা গড়ন ছিল দর্শকের আলোচনার উৎস। কিন্তু নিজের অফফর্ম, অনিল কুম্বলের ফেরা এবং পিযুষ চাওলা, হরভজন সিং এর উত্থান সব মিলিয়ে ক্রমশই দল থেকে ব্রাত্য হয়ে পড়েন তিনি।

ফলশ্রুতিতে ২০০৭ বিশ্বকাপে বাজে ফলাফলের জন্য প্রথমেই বাদ পড়েন তিনি। এরপর আর জাতীয় দলে ডাক পাননি তিনি। তবে ঘরোয়া ক্রিকেট কিংবা আইপিএল সব খানেই নিয়মিত খেলেছেন তিনি। ২০১৫ মৌসুম শেষে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন তিনি। জাতীয় দলে হয়ে ৩১ টি একদিনের ম্যাচে তিনি নিয়েছেন ৩৪ উইকেট, পাশাপাশি ব্যাট হাতে করেছেন ১৬৪ রান। এছাড়া দুইটি টেস্ট খেলে নিয়েছেন ছয় উইকেট।

খেলা ছাড়ার পর পাওয়ার জড়িয়ে পড়েন ক্রিকেট কোচিংয়ের সাথে। তার কোচিংয়েই টানা ১৪ ম্যাচ জিতে ২০১৮ প্রমীলা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠেছিল ভারত নারী দল। যদিও অধিনায়ক মিতালি রাজের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে বিশ্বকাপ শেষেই বরখাস্ত হন তিনি।

তবে, বিসিসিআই তাদের ভুল বুঝতে পেরে এ বছর পুনরায় মহিলা দলের কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয় রমেশ পাওয়ারকে। বলা হয়ে থাকে বড্ড ভুল সময়ে ভারতীয় ক্রিকেটে আগমন ঘটেছিল তার, নইলে দীর্ঘায়িত হতে পারতো তার ক্যারিয়ার। এখন দেখার বিষয় খেলোয়াড়ি জীবনের আক্ষেপ কোচ হিসেবে মেটাতে পারেন কিনা তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link