ক্রিস রজার্স ও দ্য এন্ড গেম

২০০০ এর পরবর্তী সময়ে অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলে ওপেনিংয়ে নিয়মিত মুখই ছিলেন ম্যাথু হেইডেন। সেই সাথে জাস্টিন ল্যাঙ্গার এবং এরপর শেন ওয়াটসন-সাইমন ক্যাটিচরাও ছিলেন ওপেনিংয়ে আরেক প্রান্তের প্রতিযোগিতায়। সে সময়ের অস্ট্রেলিয়া দলটাই ছিলো বিশ্ব ক্রিকেটের পরাশক্তি। তারকায় ঠাঁসা দলটায় সুযোগ পাওয়াটাই ছিলো দুষ্কর। ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের ফোয়ারা ছুঁটিয়েও ৩০ বছর বয়সে অভিষিক্ত হয়েছিলেন মি. ক্রিকেট খ্যাত মাইক হাসি! তেমনি ৩০ বছর বয়সে এসে অভিষিক্ত হয়েছিলেন আরেকজন - হ্যাঁ, ক্রিস রজার্স।

২০০০ এর পরবর্তী সময়ে অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলে ওপেনিংয়ে নিয়মিত মুখই ছিলেন ম্যাথু হেইডেন। সেই সাথে জাস্টিন ল্যাঙ্গার এবং এরপর শেন ওয়াটসন-সাইমন ক্যাটিচরাও ছিলেন ওপেনিংয়ে আরেক প্রান্তের প্রতিযোগিতায়। সে সময়ের অস্ট্রেলিয়া দলটাই ছিলো বিশ্ব ক্রিকেটের পরাশক্তি। তারকায় ঠাঁসা দলটায় সুযোগ পাওয়াটাই ছিলো দুষ্কর। ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের ফোয়ারা ছুঁটিয়েও ৩০ বছর বয়সে অভিষিক্ত হয়েছিলেন মি. ক্রিকেট খ্যাত মাইক হাসি!

তেমনি ৩০ বছর বয়সে এসে অভিষিক্ত হয়েছিলেন আরেকজন – হ্যাঁ, ক্রিস রজার্স। যিনি মূলত ছিলেন একজন বাঁ-হাতি ওপেনার।

ওপেনিংয়ে ম্যাথু হেইডেন, জাস্টিন ল্যাঙ্গারদের পর ওয়াটসন-ক্যাটিচরা ওপেনিংয়ে থাকায় জাতীয় দলে সুযোগ করতে পারেননি রজার্স। ঘরোয়া ক্রিকেটে অজস্র রান করলেও অপেক্ষায় ছিলেন জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার। সে সময়ে অস্ট্রেলিয়া দলে ডাক পাওয়াটা ছিলো সোনার হরিণের মতো। আর এই সোনার হরিণ কাছে পেয়েও যদি লুফে নিতে না পারেন; সেই ব্যর্থতাটাও নিশ্চয়ই আপনার। এমনটাই ঘটেছিলো ক্রিস রজার্সের ক্ষেত্রেও।

৩০ বছর বয়সে ২০০৮ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্টে অভিষিক্ত হন ওপেনার ক্রিস রজার্স। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে জায়গা পেলেও এক ম্যাচেই সব ধূলিসাৎ হয়ে যায় রজার্সের ব্যাটিং ব্যর্থতায়। দুই ইনিংস মিলিয়ে মোটে ১৯ রান করার পরের ম্যাচেই বাদ পড়েন তিনি।

এক ম্যাচে কি কারো সামর্থ্য কিংবা প্রতিভার মূল্যায়ন হয়? – নিশ্চয়ই না।

তবে, তারকায় ঠাঁসা অজি দলটায় তখন এক ম্যাচই যেনো অনেক বড় কিছু। এই এক ম্যাচেই দেখাতে হবে সামর্থ্যের সবটা। মাইক হাসি ৩০ বছর বয়সে অভিষিক্ত হলেও সাত বছরের ছোট্ট ক্যারিয়ারে তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন সেরাদের তালিকায়। তবে, একই পথে হাঁটতে পারেননি রজার্স। অবশ্য ভাগ্যটাও সাথে ছিলো না। নয়তো ঘরোয়া ক্রিকেটে ভুঁড়ি ভুঁড়ি রানের পরও জাতীয় দলে এসেই কিনা সব ম্লান হয়ে গেলো!

রজার্স এসেছিলেন পুরোদস্তর খেলাধূলার পরিবার থেকেই। তাঁর বাবা জন রজার্স খেলেছেন নিউ সাউথ ওয়ালসের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। তাঁর কাজিন ভাই ছিলেন একজন দাবাড়ু। ১৯৯৬ সালে ১৯ বছর বয়সে ইয়্যুথ টেস্টে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন তিনি। ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময়ই ছিলেন ইংল্যান্ডের ঘরোয়া লিগ কাউন্টিতে। ১৯৯৬ সাল থেকেই ইংল্যান্ডে ডিভিশন লিগে খেলতেন তিনি। ১৯৯৮ সালে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক।

পরবর্তীতে পাড়ি জমান কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে। ২০০৪ সাল থেকেই তিনি কাউন্টিতে নিয়মিত মুখ। ডার্বিশায়ারের হয়ে ২০০৪ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন তিনি। এরপর ২০০৫ সালে যোগ দেন লিস্টারশায়ারে। সেখানে নিজ জন্মভূমি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরিও করেন তিনি! পরবর্তীতে ২০০৬ সালেই আবার তিনি যোগ দেন আরেক কাউন্টি ক্লাব নর্দাম্পটনশায়ারে। সেখানে গ্লস্টারশায়ারের বিপক্ষে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেন তিনি! ৫০ চার ও ২ ছক্কায় ৩১৯ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন তিনি।

একই বছর নিজ দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে এক ম্যাচে তৃতীয় উইকেটে মার্কাস নর্থের সাথে রেকর্ড ৪৫৯ রানের জুটি গড়েন! যেখানে রজার্স করেছিলেন ২৭৯ রান! পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে রজার্স ‘স্টেট ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার’ – এর পুরস্কার জেতেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে তার ধারাবাহিক পারফরম্যান্স তাঁকে টেনে নেয় জাতীয় দলে। ওই বছরই তিনি ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে চুক্তিবদ্ধ হন।

পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ১৩ জানুয়ারি ম্যাথু হেইডেনের হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ডাক পান তিনি। পার্থে তৃতীয় টেস্টে একাদশেও সুযোগ পান রজার্স। ৩০ বছর বয়সে এসে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন তিনি। ওই টেস্ট জিতলে টানা ১৭ টেস্ট জয়ের ওয়ার্ল্ড রেকর্ড গড়তো অজিরা। তবে, ইরফান পাঠানের দুর্দান্ত বোলিংয়ে ওই টেস্ট হেরে যায় অজিরা। দুই ইনিংসে ৪ ও ১৫ – মোটে ১৯ রান করেন রজার্স। পরের টেস্টে হেইডেন ফিট হওয়ায় দল থেকে বাদ পড়েন রজার্স। এরপর ওই বছর ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার চুক্তি থেকেও বাদ যান তিনি।

প্রায় পাঁচ বছর আর জাতীয় দলে ফিরতে পারেননি তিনি। তবে, ঘরোয়া ক্রিকেটে করে যাচ্ছিলেন ধারাবাহিক পারফরম্যান্স। দল থেকে বাদ পড়ার পর রজার্স বলেছিলেন তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। আর তাঁর সেই চেষ্টা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ২০১৩ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যাশেজ সিরিজে দলে ডাক পান রজার্স। ৩৫ বছর বয়সে দলে ফিরে পুরো সিরিজেই ওপেন করেছিলেন তিনি। ৪০.৭৭ গড়ে ৩৬৭ রান করে ওই সিরিজে অজিদের হয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন রজার্স। চতুর্থ টেস্টেই দেখা পান ক্যারিয়ারের মেইডেন সেঞ্চুরির!

ওই অ্যাশেজের অনবদ্য পারফরম্যান্সে পরের দুই বছরের জন্য দলে থিতু হয়ে যান রজার্স। পরের অ্যাশেজেও খেলেন দুর্দান্ত। প্রায় ৪৬ গড়ে ৪৬৩ রান করেন তিনি। যা ছিলো অজিদের পক্ষে তৃতীয় সর্বোচ্চ। ওই সিরিজে টেস্ট ক্রিকেটে দ্বিতীয় ও অজিদের মাটিতে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। এরপর জাতীয় দলেও ধারাবাহিক পারফরম্যান্স করেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর টানা ৬ ইনিংসে ফিফটিও করেন তিনি! এরপর কনকাশন ইনজুরিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ মিস করেন।

ইনজুরি কাটিয়ে ফেরেন ২০১৫ অ্যাশেজ সিরিজে। আর সিরিজের আগেই জানিয়ে দেন এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নেবেন। প্রথম ইনিংসেই ফিফটি করে পঞ্চম ক্রিকেটার হিসেবে টানা সাত ইনিংসে ফিফটির রেকর্ড গড়েন রজার্স। পরের লর্ডস টেস্টে ক্যারিয়ার সেরা ১৭৩ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। পুরো সিরিজে ৬০ গড়ে ৪৮০ রান করেন রজার্স। এবং ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক সিরিজে জেতেন সিরিজ সেরার পুরষ্কার।

২৫ টেস্টের সংক্ষিপ্ত আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ২০১৩ সালে রাজকীয় প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই রজার্স ছিলেন ধারাবাহিক পারফর্মার। ডেভিড ওয়ার্নারের সাথে ওপেনিংয়ে ৪১ ইনিংস খেলার পথে ৯ বার সেঞ্চুরির জুটি গড়েন রজার্স। জাতীয় দলে খেলা ২৫ টেস্টে ৪৩ গড়ে করেছেন ২ হাজারের বেশি রান। ৫ সেঞ্চুরির সাথে আছে ১৪ ফিফটি।

রজার্সকে ‘বাকি’ নামেই ডাকতেন সতীর্থরা। রজার্স ছিলেন ‘কালার ব্লাইন্ড’। ২০১৫ সালে গোলাপি বলের ট্রায়ালের সময় জানা যায় তিনি কালার ব্লাইন্ড। রজার্স মোট চারটি ক্লাবের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেটে খেলেছেন। কাউন্টিতে খেলা চারটি দলের হয়েই তিনি ডাবল সেঞ্চুরিও করেছেন।

জাতীয় দলে ক্যারিয়ার বড় করতে না পারলে ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের পাহাড় গড়েছেন এই বাঁ-হাতি ওপেনার। ৩১৩ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে প্রায় ৫০ গড়ে ২৫৪৭০ রান করেছেন রজার্স। ৭৬ সেঞ্চুরির সাথে করেছেন ১২২টি ফিফটি। এছাড়া লিস্ট এ ক্রিকেটে প্রায় ৩৭ গড়ে ৫ হাজারের বেশি রান। ৫ সেঞ্চুরির পাশাপাশি করেছেন ৩৬ ফিফটি।

ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রায় ৩১ হাজার রানের মালিক রজার্স জাতীয় দলে ছিলেন অনিয়মিত এক মুখ। ক্যারিয়ারের শুরুটা ভালো না হলেও ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দিয়ে শেষটা করেছেন স্মরণীয়। ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের পাহাড় গড়া রজার্সের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারে হয়তো আক্ষেপের কারণ থাকতে পারে। তবে, শেষ ভাগটায় নিজের সামর্থ্যের সবটা দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করে যেতে পেরেছেন তাতে আক্ষেপের মাত্রা কিছুটা কম হলেও হতে পারে।

কথায় আছে – ‘শেষ ভাল যার, সব ভাল তার’। কথাটার যথার্থতা প্রমাণ করেছেন ক্রিস রজার্স।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...