আপনার বিয়ের দিন। হবু স্ত্রী-সহ বাকিদের নিয়ে চার্চে আছেন। কী চিন্তা মাথায় আসতে পারে বা কী করতে পারেন।রস গেলার হলে হয়তো বউয়ের নাম এমিলির বদলে র্যাচেল বলবেন এই আর কি। আর আপনি যদি হ্যাভিয়ের জানেত্তি হন তাইলে বউয়ের কাছে অনুমতি চাইবেন কিছুক্ষণ দৌড়ে আসার।
না নিজের বিয়ের দিন এমন কিছু করেনি জানেত্তি। করেছিলেন রিসেপশনের দিন। অতিথিদের আগমনের কিঞ্চিৎ আগে বউকে জিজ্ঞেস করলেন একটু দৌড়ে আসবো না’কি। নিজের ফিটনেসের প্রতি এতটাই সচেতন ছিলেন এই ডিফেন্ডার-মিডফিল্ডার। নিজের রিসেপশনের দিনও যাকে সেটি থেকে দূরে রাখতে পারেনি।
এক পত্রিকার সাংবাদিক রবার্তো ব্যাজ্জিওকে একবার বলেছিল জানেত্তির আইডল আপনি, সে আপনার মত হতে চায়।ব্যাজ্জিও বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন সাংবাদিকের দিকে এবং উত্তর দিলেন, ‘he wants to be Baggio? I want to be him, he is fantastic, indestructible.’
আরেকবার রায়ান গিগসকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তার সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় কে ছিলেন।গিগসের সরল স্বীকারোক্তি ‘হ্যাভিয়ের জানেত্তি’। জানেত্তি গিগসের নাক ফাঁটিয়ে দিয়েছিল এক ম্যাচে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে ১৯৯৯ সালে। গিগস এবং তাঁর দলের ট্রেবলজয়ী বছরে।
জানেত্তি সম্পর্কে গিগস আরো বলেন, ‘মিডফিল্ডার হিসেবে জানেত্তি অসাধারণ বল প্লেয়ার, নিখুঁত পাস দিতে পারে আর ডিফেন্ডার হিসেবে তো দুর্দান্ত। একেবারে ট্রায়ারলেস। মাঠের ডানপাশ তাঁর দখলে তো ছিলই, পুরো মাঠ জুড়েই থাকতো তাঁর পদচিহ্ন।
২২ বছরের ক্যারিয়ারে জানেত্তি প্রশংসা-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পেয়েছেন ভক্ত-প্লেয়ার-কোচ-ম্যানেজমেন্ট সবার। ১৯৭৮ সালে নিজের দেশে মারিও কেম্পেস-প্যাসারেলাকে বিশ্বকাপ হাতে তুলতে দেখে ফুটবলের প্রেমে পড়েন জানেত্তি,বয়স তখন মাত্র পাঁচ। ১৯৯২ সালে আর্জেন্টিনার তৃতীয় বিভাগ ফুটবল দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু তাঁর।
১৯৯৫ সালে যোগ দেন ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানে। ২০১৪ পর্যন্ত খেলেছেন নেরাজ্জুরিদের হয়ে। একটানা উনিশ বছর। ২০০০ এর শুরুর দিকে ব্যক্তিগতভাবে দুর্দান্ত খেলা জানেত্তির জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল রিয়াল মাদ্রিদ।ইন্টারের অবস্থাও বেশ খারাপ। তখন রিয়ালে গেলে বেশ ট্রফি-সাফল্য পেতেন নি:সন্দেহে কিন্তু ইন্টারের প্রতি লয়াল থেকে গেলেন তিনি।
১৯৯৯ সালে ক্লাবের অধিনায়কত্বও পান। ৮৫৮ ম্যাচ খেলেছেন ক্লাবের হয়ে, যেটি আবার ক্লাব রেকর্ড। ইন্টারের হয়ে ১৯ বছরে জানেত্তি খেলেছেন ১৭ জন কোচের অধীনে। রয় হজসনে শুরু। একে একে মার্সেলো লিপ্পি,হেক্টর কুপার, রবার্তো মানচিনি এবং হোসে মরিনহোসহ আরো অনেক নামীদামী কোচ। সবার দলেই ছিলেন অতীব গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে। আর লিজেন্ডারি ডিফেন্ডার জিউসেপ্পে বারগোমির অবসরের পরে অধিনায়ক ছিলেন প্রায় সবার অধীনেই।
ডি-বক্সের কিঞ্চিৎ সামনে ফ্রি-কিক পেল আর্জেন্টিনা। কিক নিতে দাঁড়িয়ে আছেন বাতিগোল আর ভেরন। বাতিগোল শুট না করে চলে গেলেন সামনে ভেরন আস্তে করে বলটি বাড়িয়ে দিলেন জানেত্তির দিকে। জানেত্তি দারুণ কন্ট্রোলে বল রিসিভ করলেন, বাঁ-পায়ের শট নিলেন, বল জালে এবং আর্জেন্টিনা ম্যাচে ফিরলো, ২-২ এ সমতা।
শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ১৯৯৮ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে আলবিসেলিস্তিরা। আর্জেন্টিনার হয়ে চার গোলের একটি ছিল ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এই গোল। সিমিওনে-বেকহ্যাম জুটির এর জন্য এই ম্যাচ বিশেষভাবে খ্যাত। সেই গল্প আজ নয়।
১৪৩ বার আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে জড়িয়েছেন জানেত্তি। মাশ্চেরানো ভাঙেন সেই রেকর্ড। এল হেফেসিতো খেলেছেন মোট ১৪৭ ম্যাচ। মেসি ছাড়িয়ে যাবেন হয়তো দুজনকেই। ২০০৬ এবং ২০১০ বিশ্বকাপে তাঁর না থাকাটা ভীষণভাবে পীড়া দিয়েছে আর্জেন্টিনাকে। বিশেষ করে ২০১০ বিশ্বকাপে। পাগলাটে ম্যারাডোনার পাগলাটে সিদ্ধান্ত। হাড়েহাড়ে জার্মানি বুঝিয়েছে ফুটবল কী।
ক্লাবের হয়ে দুর্দান্ত মৌসুম শেষ করা জানেত্তি আর ক্যাম্বিয়াসোকে না রাখাটা ছিল বোকামি। জানেত্তির জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছিল ২১ বছর বয়সে, প্যাসারেলার অধীনে। প্যাসারেলার অধীনে অভিষেক হওয়া মানে আর যাই হোক, প্লেয়ার হিসেবে এই ছেলে দারুণ পরিশ্রমী এবং দৃঢ়প্রত্যায়ী।
জানেত্তির ট্রেডমার্ক ছিল তার সুন্দর করে আচরানো চুল। অগোছালো চুল তার কনফিডেন্স নষ্ট করে দেয়। প্রিসাইজ মানুষজন বলে কথা। ৪৭ এ পা দেয়া জানেত্তিকে এখনো তরুণ লাগে। সুন্দর করে রাখা চুলও হয়তো এখানে ভূমিকা রাখে। জানেত্তির আরেকটি দিক উল্লেখ করতেই হবে। সেটি হলো দৃঢ় মনোবল। শেষ করেই ছাড়বেন এমন প্রতিজ্ঞা।
ছোটবেলায় কাজিনের সাথে দুধ ডেলিভারির কাজ করেছেন। বাবার সাথে রাজমিস্ত্রীর কাজও করেছেন সানন্দে। জানেত্তির বিশ্বাস ছিল ছোট থেকেই শুরু করা এবং আস্তে আস্তে উপরে যাওয়া। ফুটবলেও একই নিয়ম মেনে এগিয়েছিলেন। আর্জেন্টাইন তৃতীয় বিভাগে শুরু আর শেষ করেছেন একদম কিংবদন্তি হিসেবে।