কেন রমিজ রাজা!

প্রশ্নটা মনে মধ্যে কয়েক দিন ধরেই ঘুরছে।

এটা জানা কথা যে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার পছন্দেই রমিজ রাজাকে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) প্রধান হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু রমিজই কেন?

ইমরান খানের দলে তো দাপুটে ভাবমূর্তির লোকের অভাব ছিল না। সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক ইমরানের দলে ওয়াসিম আকরাম খেলেছেন, ইনজামাম উল হক খেলেছেন, ওয়াকার ইউনুস খেলেছেন; মুশতাক আহমেদ বা সাকলায়েন মুশতাকও তো ছিলেন। এদের বাদ দিয়ে ইমরান খান কেন রমিজকে বেছে নিলেন?

বিশেষ করে সাদা চোখে রমিজের ভাবমূর্তি ঠিক পিসিবি চেয়ারম্যানসূলভ না। তিনি অবসরের আগে এমন কোনো বিরাট ক্রিকেটার ছিলেন না। আবার অবসরের পরও তিনি খুব ‘সর্বজন শ্রদ্ধেয়’ হয়ে উঠতে পারেননি। বরং ধারাভাষ্য কক্ষে তাকে কখনো কখনো চপল, চটুল বলেও মনে হয়েছে। তাহলে কিংবদন্তি, রাশভারী ইমরান খান কেন রমিজকে বেছে নিলেন!

এই প্রশ্নের উত্তর খোজাখুজির পর মূলত দুটো ব্যাপার সামনে এল – ১. রমিজের নিষ্কলুষ ও আপোষহীন ক্যারিয়ার এবং ২. রমিজের অসাধারণ কূটনৈতিক দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনার যোগ্যতা।

১.

৫৭ টেস্ট ও ১৯৮ ওয়ানডে খেলা রমিজ রাজা কখনোই সেরা ক্রিকেটারদের একজন ছিলেন না। কিন্তু ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে তিনি একটা জায়গায় সেরা হয়ে ওঠেন।

১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর পাকিস্তানের ক্রিকেট ছেড়ে দেন ইমরান খান। কিন্তু তার বিদায়ের পর তার শিষ্যরা তার মতো স্বচ্ছতা ও সততার পথে থাকতে পারেনি। তারা ঝাকে ঝাকে জড়িয়ে পড়ে ফিক্সিং কাণ্ডে।

একসাথে ৭ পাকিস্তানী ক্রিকেটার ফিক্সিং করেছিলেন বলে পিসিবির পরবর্তীকালের এক তদন্তে জানা যায়। সেই সাত জনের মধ্যে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, মুশতাক আহমেদদের নাম ছিল। সংবাদ মাধ্যমের দাবি ছিলো, কেবল এই ৭ জন নন; কার্যত দলটির প্রায় সবাই তখন অন্ধকার জগতের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

একজন ছাড়া।

একজন মানুষকে নিয়ে কখনোই প্রশ্ন ওঠেনি। সংবাদ মাধ্যম বলুন আর তদন্তকারীরা; কেউ কখনো এই একজন মানুষের বিপক্ষে কোনো আঙুল তোলার সুযোগ পায়নি। আর সেই মানুষটিই রমিজ রাজা।

আর রমিজ রাজা তাঁর অনেক আক্ষেপের ক্যারিয়ারের মধ্যেও সেরাটা দিতে পেরেছিলেন ১৯৯২ বিশ্বকাপে। ওই বিশ্বকাপ আসরে ৫৮ গড়ে ৩৪৯ রান করেন তিনি! সেটা ছিল ওেই টুর্নামেন্টের পঞ্চম সর্বোচ্চ ও পাকিস্তানের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ওই টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত দুটি সেঞ্চুরি করেন রমিজ। ডেভিড বুনের পর দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে সেবার দুই সেঞ্চুরি করেন তিনি। তার মধ্যে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করার মধ্য দিয়ে স্যার ভিভ রিচার্ডসের পর দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপে তিন সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েছিলেন তিনি। এর মধ্যে প্রথম সেঞ্চুরিটা আসে ১৯৮৭ সালে।

ফলে ইমরান খানের প্রিয়পাত্র তিনি ১৯৯২ বিশ্বকাপ থেকেই। এর সাথে যোগ করুন রমিজ রাজার এই নিষ্কলুষ ভাবমূর্তি। এই দুইয়ের ‘কম্বিনেশন’ তাঁকে ইমরান খানের কাছে করে তুলেছে অনন্য এক সম্পদে।

ইমরান খান এখন রাজনীতিবিদ। রাজনীতির স্বার্থে তাকে অনেকের সাথে হাত মেলাতে হয়, অনেক অপছন্দের কাজও করতে হয়। কিন্তু একটা কাজ তিনি কখনোই জীবনে মেনে নিতে পারেননি-ক্রিকেটের সাথে অসততা। তিনি সবসময়ই ক্রিকেটের সাথে সত থাকা লোকেদের আলাদা গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন।

হ্যাঁ, প্রাণপ্রিয় শিষ্য হিসেবে ওয়াসিম, ওয়াকার নিশ্চয়ই কিছু চাইলে ইমরান ফেরাবেন না। কিন্তু তাদেরকে ক্রিকেটের কোনো বড় পদে, অন্তত পিসিবি চেয়ারম্যানের পদে এই ইমরান কখনোই বসতে দেবেন না। কারণ, তাঁদের ক্রিকেট সততা প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। আর এই প্রশ্নটাই ইমরানের কাছে বড় ব্যাপার।

২.

স্রেফ সততা, আপোষহীনতা দিয়ে তো বিশ্বের শীর্ষ একটা বোর্ডের প্রধান হওয়া যায় না। সে জন্য চাই শিক্ষা, দক্ষতা। আর এই জায়গাটায় আরও কয়েক জনকে পেছনে ফেলে দিয়েছেন রমিজ রাজা।

রমিজ সম্ভবত নব্বই প্রজন্মের পাকিস্তানী ক্রিকেটারদের মধ্যে শিক্ষার পেছনে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেছেন। লাহোরের আইতসিসন কলেজে পড়াশোনা করেছেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেছেন।

রমিজ পারিবারিকভাবে উচ্চশিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত এক উত্তরাধিকার বহন করছেন। তার দুই ভাই ওয়াসিম রাজা ও জাইম রাজা ক্রিকেটার ছিলেন। এর মধ্যে ওয়াসিম রাজা নিজেও কিংবদন্তি। তিনি পাকিস্তানের হয়ে ৫৭টি টেস্ট ও ৫৪টি ওয়ানডে খেলেছেন।

ওয়াসিম রাজা ইংল্যান্ডে শিক্ষকতাও করেছেন। সারেতে ক্রিকেট খেলতে খেলতেই মাঠে হার্ট এটাক করে মারা গিয়েছিলেন।

রমিজ রাজার বাবা সালিম আক্তার অভিভক্ত ভারতে ক্রিকেট খেলতেন। অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। মুলতানের হয়ে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট খেলেছেন। রমিজের স্ত্রী নিজে উঠে এসেছেন ভারতের এক সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে। রমিজের দাদা শ্বশুরবাড়ি হরিয়ানাতে এবং নানা শ্বশুরবাড়ি দিল্লীতে।

এই পারিবারিক ধারাবাহিকতা ধরে রেখে রমিজ মাঠের ক্রিকেটের পাশাপাশি অনেকটা সময় ‍দিয়েছেন পড়াশোনার পেছনে। রমিজকে তাঁর সময়ের অন্যতম শিক্ষামুখী মানুষ বলে মনে করা হয়। একাধিক ভাষায় কথা বলতে ও যোগাযোগ রক্ষা করতে তার জুড়ি মেলা ভার।

৩.

কিন্তু আরও কিছু গুন দরকার। স্রেফ শিক্ষিত একজন সত মানুষকেই তো পিসিবি চেয়ারম্যান করা যায় না। তার দরকার ব্যবস্থাপনার ও কূটনৈতিক যোগাযোগের দক্ষতা। আর এই দু জায়গাতেও রমিজ যে কারো চেয়ে এগিয়ে।

অবসরের পর রমিজ ছিলেন মূলত ব্যাংকার। অ্যামেরিকান এক্সপ্রেসের পাকিস্তান কেন্দ্রে উচ্চ পদে চাকরি করতেন তিনি। ধারাভাষ্যে আসার আগে নিজেকে এখানে প্রমাণ করে এসেছেন। ফলে করপোরেট ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে তার বোঝাপড়া অনেকের চেয়ে ভালো।

তবে রমিজ তার প্রশাসনিক দক্ষতার সেরা রূপটা দেখান এই পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডেই।

২০০৩ সালে তাকে পিসিবির প্রধাণ নির্বাহী করা হয়। আর এই সময়ই পিসিবি এমন কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যার ফল আজও ভোগ করে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি। পিসিবির যে বিখ্যাত ক্রিকেট অ্যাকাডেমি, সেটা মূলত রমিজের সময়েই প্রতিষ্ঠিত এবং তার ব্রেনচাইল্ড বলা যায় এই বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানটিকে।

রমিজ সিইও থাকা সময়ই পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের বেতন কাঠামোর ব্যাপক সংষ্কার করা হয়। এ ছাড়া নারী ও বয়সভিত্তিক ক্রিকেটারদের চুক্তির অধীনে আনার মত কিছু কাজও সে সময় শুরু হয়। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট নিয়ে রমিজ সে সময় অনেক আধুনিক কাজ করেছেন।

তবে সমালোচকরা মনে করেন সিইও রমিজের সেরা কীর্তি ছিলো ভারতকে পাকিস্তান সফরে আনা।

১৯৮৯ সালে সর্বশেষ পাকিস্তানে টেস্ট সফর করেছিলো ভারত। এরপর রাজনৈতিক অস্থিরতায় দুই দেশের মুখ দেখাদেখিই বন্ধ হয়ে যায়। ভেতরে পাকিস্তান কয়েকটি ভারত সফর করলেও ভারত কখনো আর পাকিস্তানে আসেনি।

নতুন শতাব্দীর শুরুতে দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক একটু হলেও স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিলো। আর এই সুযোগটাই দারুণভাবে নেন রমিজ রাজা। তিনি ভারতকে পূর্নাঙ্গ পাকিস্তান সফরে আসতে রাজী করিয়ে ফেলেন। আর সেটা ছিলো অসাধারণ এক রোমান্টিক সময়।

যদিও ২০০৪ সালেই শেষ দিকে এসে রমিজ পিসিবির এই চাকরি ছেড়ে দেন। কারণ, তাকে ধারাভাষ্য ও প্রধাণ নির্বাহী পদের যে কোনো একটা বেছে নিতে বলা হয়েছিলো। সম্ভবত আর্থিক কারণেই রমিজ ধারাভাষ্য বেছে নিয়েছিলেন।

এবার নিশ্চয়ই সেই সংকট নেই।

ইমরান খান নিশ্চয়ই সব দিক ভেবেই তার পছন্দের লোক হিসেবে রমিজ রাজাকে নির্বাচন করেছেন। রমিজ রাজার এই দফায় সবচেয়ে বড় কাজ হবে, পাকিস্তানে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট নিয়মিত করা।

যেহেতু রমিজের সঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসকদের দারুণ একটা সম্পর্ক আছে, তাই পিসিবি এই সময়ে পাকিস্তানে কোনো একটা আইসিসি ইভেন্টও আশা করছে। একটা ভারতের সফর এবং একটা আইসিসি ইভেন্ট আয়োজন করতে পারলে নিশ্চয়ই রমিজ আরও একবার ইমরান খানের কাছে নিজেকে সেরা বলে প্রমাণ করে ফেলতে পারবেন।

এহসান মানির ওপর এই প্রত্যাশাটা ছিলো। কিন্তু তিনি কিছু আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট পাকিস্তানে ফেরাতে পারলেও বড় কিছু করতে পারেননি। রমিজ হয়তো এখানে হতাশ করবেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link