অন্তহীন প্রেমের বর্ণময় উপাখ্যান

ইংল্যান্ড ক্রিকেটের এক রঙিন চরিত্র তিনি। অবস্মরণীয় এক চরিত্রও বটে। তাঁর হয়তো কার্টলি অ্যামব্রোসের মত উচ্চতা ছিল না, শোয়েব আখতারের গতি কিংবা ওয়াসিম আকরামের স্যুইংও ছিল না। তবে ক্রিকেট ইতিহাসে ড্যারেন গফ বিশেষ কিছু ছিলেন। সবকিছু মিলিয়েই তিনি ছিলেন অনন্য। পেস আক্রমণের নেতা, মিশুক কিংবা প্রতিপক্ষকে তোয়াক্কা না করা ড্যারেন গফ।

ইংল্যান্ড ক্রিকেটের এক রঙিন চরিত্র তিনি। অবস্মরণীয় এক চরিত্রও বটে। তাঁর হয়তো কার্টলি অ্যামব্রোসের মত উচ্চতা ছিল না, শোয়েব আখতারের গতি কিংবা ওয়াসিম আকরামের স্যুইংও ছিল না। তবে ক্রিকেট ইতিহাসে ড্যারেন গফ বিশেষ কিছু ছিলেন। সবকিছু মিলিয়েই তিনি ছিলেন অনন্য। পেস আক্রমণের নেতা, মিশুক কিংবা প্রতিপক্ষকে তোয়াক্কা না করা ড্যারেন গফ।

দুঃখজনক ভাবে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন ইংল্যান্ডের অন্যতম বাজে সময়ে। ১৯৭০ সালে জন্মগ্রহণ করা এই পেসার নব্বই দশকের অন্যতম সেরা পেসারদের একজন ছিলেন। তাঁকে ইংল্যান্ড ক্রিকেটে অন্যন্য এক প্রতিভা না বলে চরিত্র বলাটাই ভালো হবে। ইংল্যান্ড ক্রিকেটের এক বর্ণিল চরিত্র ছিলেন ড্যারেন গফ।

ইংল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার  ডেভিড লয়েড একেবারে নিখুঁত ভাবেই বলেছিলেন। তিনি বলতেন ড্যারেন গফ হলেন ইংল্যান্ড দলের হ্রদস্পন্দন। এটা নিয়ে বোধহয় খুব বেশি আপত্তিরও সুযোগ নেই। মোদ্দা কথা তিনি ক্রিকেটাকে ভালবাসতেন, উপভোগ করতেন এবং দলের বাকিরাও যেন উপভোগ করতে পারে সেটা নিশ্চিত করতেন। আক্রমণাত্মক ক্রিকেটের এক ফুয়ারা খুলে বসেছিলেন তিনি।

তাঁর মধ্যে কখনও হারার ভয় ছিল না। গফের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তিনি প্রতিপক্ষকে নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। প্রতিপক্ষ নিয়ে পড়াশোনাও করতেন না। তাঁর মতে, বিপরীত প্রান্তে যেই থাকুক না কেন, বল হাতে নিজের সেরাটা দেও। তারমানে এটাও না যে, তিনি ক্রিকেট নিয়ে সিরিয়াস ছিলেন না। মাঠে নামলে নিজের পুরোটা নিঙরে দিতেন ঠিকই।

অন্তত পরিসংখ্যান সেই কথাই বলে।। ইংল্যান্ডের প্রথম বোলার হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে ২০০ উইকেট নেয়ার কীর্তি গড়েছিলেন তিনি। গতি, স্যুইং, ইয়োর্কার সবই ছিল তাঁর ঝুলিতে। পরিচিত ছিলেন স্কিডি পেস বোলার হিসেবে। সবমিলিয়ে সেই সময় এক পেস বোলিং প্যাকেজ ছিলেন গফ।

ইয়ান বোথামের অবসরের পর একটা বাজে সময় কাটাচ্ছিল ইংল্যান্ড। সেই সময় দলটার হাল ধরেছিলেন তিনি। শুধু মাঠেই না, মাঠের বাইরেও দলটাকের আগলে রাখতেন তিনি। নাসির হুসাইন তাঁর অটোবায়োগ্রাফিতে লিখেছিলেন, ‘ড্যারেন গফ ছিলে আমার ট্রাম্প কার্ড। তিনি আমাদের সময়ের ইয়ান বোথাম ছিলেন।’

ড্যারেন গফ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৭০ সালে ১৮ সেপ্টেম্বর। সেটি ছিল ইংল্যান্ড ক্রিকেটে এক শোকাবহ দিন। সেদিনই  আমেরিকান গিটারিস্ট জিমি হেনড্রিক্সকে তাঁর লন্ডনের বাড়িতে মৃত পাওয়া যায়। তবে গফ পরিবারে সেদিন আনন্দের জোয়ার এসেছিল নিশ্চয়ই। ছোট বেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রেমে বুদ হয়ে ছিলেন তিনি।

একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি ক্রিকেটটা আজীবন খেলে যেতে চাই। আমার বয়স যখন ৫০ হবে তখনও নিশ্চয়ই কোন গ্রামের একটা দল আমাকে দলে নিতে চাইবে। আমি তাঁদের হয়েও খেলতে চাই। অনেক ক্রিকেটার অবসরের পর বলেন তাঁরা আর ব্যাট ধরতে চান না। আমি এটা ঠিক বুঝি না।’ এটুকুতেও বোঝা যায় ক্রিকেটের সাথে তাঁর প্রেম কত গভীর, কী এক অন্তহীন সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি।

১৯৯৩ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দারুণ এক মৌসুম কাটিয়েছিলেন তিনি। সেবার এক মৌসুমেই নিয়েছিলেন ৫৫ উইকেট। এর পুরষ্কার হিসেবে পরের বছর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে ও টেস্ট অভিষেক হয় তাঁর। অভিষেক ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আগে ব্যাট করে ২২৪ করেছিল ইংল্যান্ড। সেই ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ হয়নি তাঁর। তবে বল হাতে পেয়েছিলেন। সেদিনের স্মৃতি মনে করে বলেছিলেন, ‘আমি পুরো মাঠটার দিকে একবার তাকিয়েছিলাম। সুয়েটারে আঁকা সিংহে একটা চুমু খেয়ে নিজেকে সাহস দিয়েছিলাম।’

নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক বলটা গফ করেছিলেন মার্টিন ক্রো কে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর প্রথম উইকেটও এই কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান। নিজের অভিষেক ম্যাচে পেয়েছিলেন আরো একটি উইকেট। ৩৬ রান খরচ করে নিয়েছিলেন ২ উইকেট। একটা ক্যাচ মিস না হলে সংখ্যাটা তিনও হতে পারতো। সেই ম্যাচে ৪২ রানের জয় পেয়েছিল ইংল্যান্ড।

গফের টেস্ট অভিষেকটাও হয়েছিল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কিছুদিন পরেই। আগে ব্যাট করতে নামা ইংল্যান্ড ২৩৫ রানেই হারিয়ে ফেলে ৭ উইকেট। সেই সময় ব্যাট করতে নামেন ড্যারেন গফ। নিজের অভিষেক ইনিংসেই ৯ নম্বরে নেমে করেছিলেন ৬৫ রান। এরপর অবশ্য পুরো টেস্ট ক্যারিয়ারে আর মাত্র ১ বারই হাফ-সেঞ্চুরি করতে পেরেছিলেন তিনি।

বল হাতে নেমেও নিজের প্রথম ওভারেই নিয়েছিলেন মার্ক গ্রেটব্যাচের উইকেট। ওই ইনিংসে ৪৭ রান দিয়ে গফ তুলে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। তাঁর বোলিং তোপে পড়ে মাত্র ২৩১ রানের অল আউট হয়ে যায় কিউইরা। দ্বিতীয় ইনিংসেও নিয়েছিলেন আরও দুটি উইকেট। সেই সময়ই ২৩ বছরের ড্যারেন গফকে আখ্যা দেয়া হয় ইংল্যান্ডের ‘নয়া বোথাম’ হিসেবে।

এরপর ইংল্যান্ডের হয়ে আরও ৫৭ টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন তিনি। ৫৮ টেস্টে তাঁর ঝুলিতে আছে ২২৯ উইকেট। এর মধ্যে ৯ বার পাঁচ উইকেট নেয়ার কীর্তিও আছে। এছাড়া ১৫৯ ওয়ানডে ম্যাচেও আছে ২৩৫ উইকেট। এছাড়া শেষ দিকে ২ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ৩ টি উইকেট।

২০০৬ সালে শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেললেও ক্রিকেটাকে নিশ্চয়ই কখনও বিদায় জানাতে পারবেন না গফ। তিনি হয়তো ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা বোলার নন। তবে ইংল্যান্ড ক্রিকেটের স্পন্দন হয়ে তিনি থেকে যাবেন অনন্তকাল। ড্যারেন গফ ও ক্রিকেটের এক অন্তহীন প্রেমের গল্প ক্রিকেট বিশ্ব পড়ে যাবে আজীবন।

বর্ণময় জীবন কিন্তু ক্রিকেট ছাড়ার পরও অব্যাহত আছে ড্যারেন গফের। ‘স্ট্রিক্টলি কাম ড্যান্সিং’ নামের একটা রিয়েলিটি শো-তে নাম লিখিয়েছিলেন – সেখান থেকেও চ্যাম্পিয়ন হয়েই ফেরেন সদা হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটি।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link