সত্তর-আশির দশকে ক্রিকেট দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘চার’ বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের একজন তিনি। কপিল দেব, ইয়ান বোথাম আর রিচার্ড হ্যাডলির সাথে গর্বভরে উচ্চারিত হত তাঁর নামটাও। ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের ছোট্ট তালিকাতেও তাঁর অবস্থান ওপরের সারিতেই। এমনকি অধিনায়ক হিসেবেও তিনি একজন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব আর সহজাত নেতৃত্বগুণ দিয়ে যিনি মাঠে ও মাঠের বাইরে হয়ে উঠেছিলেন একজন সত্যিকারের লিডার। বলছিলাম ‘৯২ বিশ্বকাপজয়ী সফল অধিনায়ক, নিরপেক্ষ আম্পায়ার আন্দোলনের পথিকৃৎ ও পাকিস্তান সরকারের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কথা।
ইমরান খানকে মনে করা হয় পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার। এর পেছনে প্রধান কারণ অবশ্যই অধিনায়ক হিসেবে তাঁর অর্জিত সাফল্য। পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্জনটা এসেছে তাঁর হাত ধরেই। পাকিস্তানে ক্রিকেটের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ও উত্থানের পেছনেও ইমরানের অবদান অনস্বীকার্য।
আশির দশকে একটা কথা খুব প্রচলিত ছিল যে, সব দলেই তো একজন ‘ক্যাপ্টেন’ আছেন, কিন্তু তারা সবাই ‘লিডার’ নন। লিডার কেবল একজনই; তিনি হলেন পাকিস্তানের ইমরান খান।
তরুণ প্রতিভা চেনার বেলায় ইমরানের ছিল নাকি পাকা জহুরির চোখ। নেটে এক নজর দেখেই অসংখ্য প্রতিভাবান খেলোয়াড় তুলে এনেছেন তিনি। ইনজামাম-উল-হক, তৌসিফ আহমেদ, ওয়াকার ইউনুস – তারা সবাই ছিল ইমরানের আবিষ্কার।
বিরানব্বইয়ের বিশ্বকাপ যাঁরা দেখেছেন তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে, প্রায় সবকটা ম্যাচ হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়ার শংকায় থাকা পাকিস্তান খেলতে নামল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ইমরান টস করতে নামলেন বাঘের ছবি আঁকা সাদা টি-শার্ট পরে। ধারাভাষ্যকার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি ব্যাপার ইমরান, তোমার টি-শার্টে বাঘের ছবি দেখছি?’ ইমরান বললেন, ‘আমি আজ ছেলেদের বলেছি কোণঠাসা বাঘের মত খেলতে। ইউ নো কর্নার্ড টাইগার ইজ আ ডেঞ্জারাস থিং।’ তো পাকিস্তান সেদিন কর্নার্ড টাইগারের মতই খেলল এবং হারিয়ে দিল টুর্নামেন্টের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন মহাশক্তিধর অস্ট্রেলিয়াকে। এর পরের ইতিহাসটা তো সবারই জানা।
ইমরানের এই স্পিচটাই ক্রিকেট ইতিহাসে ‘কর্নার্ড টাইগার থিওরি’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে।
১৯৯২ সালে ইমরান যে ভাবে টুর্নামেন্ট থেকে প্রায় ছিটকে পড়া একটা দলকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন তা আজও আলোচনায় বারবার ফিরে আসে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ‘ছন্নছাড়া’ একটা দলের ভেতর টিম স্পিরিট জাগ্রত করা, খেলোয়াড়দের হারানো উদ্যম ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা, তাদের সাফল্যের তাড়নায় উদ্বুদ্ধ করা – এসবই ছিল ইমরানের কৃতিত্ব। এছাড়া দলের তরুণ খেলোয়াড়দের তিনি উজ্জীবিত করেছিলেন আগ্রাসী ও ভয়ডরহীন ক্রিকেটের মন্ত্রে।
উইজডেনের ভাষায়, ‘Imran Khan will always be first and foremost the enigmatic ‘Kaptaan’, who pulled off the impossible – transform an immensely talented but fractious bunch of cricketers into world beaters.’
অধিনায়ক হিসেবে ইমরান ছিলেন স্বাধীনচেতা। তাঁর প্রতিটি কথায়, প্রতিটি সিদ্ধান্তে, প্রতিটি পদক্ষেপে পাওয়া যেত দূরদর্শী নেতৃত্বের ছাপ। ’৯২ বিশ্বকাপের কথাই যদি ধরি। টানা ব্যর্থতার পরও শুধুমাত্র ম্যাচ জেতানোর সামর্থ্যের দোহাই দিয়ে ‘তরুণ’ ইনজামামকে খেলিয়ে যাওয়া, পাকিস্তানের ভঙ্গুর ব্যাটিং লাইনআপকে স্থিতিশীলতা এনে দিতে অধিনায়কের নিজেই তিন নম্বরে উঠে আসা, ‘ফিফথ’ বোলারের অভাব পূরণে ইজাজ আহমেদ, সেলিম মালিক, আমির সোহেলদের মত পার্টটাইমারদের ওপর ভরসা রাখা – এসবই ইমরানের অদম্য সাহসিকতা এবং দূরদর্শিতার প্রমাণস্বরূপ।
১৯৯২ বিশ্বকাপের ৮ ম্যাচে অংশ নিয়ে ইমরানের সংগ্রহ ছিল ৩০.৮৩ গড়ে ১৮৫ রান এবং ৮ উইকেট। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ফাইনালে দায়িত্বশীল ৭২ রানের ইনিংস খেলে শিরোপা জয়েও রেখেছিলেন বড় অবদান।
১৯৯২ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলেই মনে করা হয়। সন্ত্রাসবাদ আর সহিংসতার আগুনে জ্বলতে থাকা পাকিস্তানের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে এই বিজয় এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল যার পেছনে ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিলেন ইমরান খান। পরিসংখ্যানের সাধ্য কী তা বোঝানোর?
খেলোয়াড়ি জীবনে ব্যাটিং-বোলিং দুই বিভাগেই ইমরান ছিলেন আক্রমণাত্মক মেজাজের। বল হাতে ব্যাটসম্যানদের ওপর আর ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষ বোলারদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে চাইতেন সবসময়। নিজের সময়ের সেরা হার্ডহিটারদের একজন ইমরান প্রয়োজনের সময় শক্ত হাতে ইনিংসের হালটাও ধরতে জানতেন। টেইলএন্ডারদের নিয়ে ব্যাট করার ক্ষেত্রেও ছিলেন ভীষণ পারদর্শী।
নতুন বলে কনভেনশনাল আর পুরনো বলে রিভার্স – দুই ধরনের সুইংয়েই ইমরান ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। আর ছিল গতি, বাউন্স, ন্যাগিং লাইন অ্যান্ড লেন্থ। সত্তর-আশির দশকের সবচাইতে ভীতিকর ফাস্ট বোলারদের একজন মনে করা হত তাঁকে। ন্যাচারাল আউটসুইং বোলার হলেও তাঁর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ডেলিভারিটা ছিল লেট ইনডিপার/ইনসুইঙ্গিং ইয়র্কার।
ইমরানের বোলিং স্টাইল সম্পর্কে উইজডেন বলছে, ‘His run-up made a most exhilarating spectacle as he charged in, leaning forward from the waist, and leapt at the crease; so did the end-product of some extremely fast, in-dipping yorkers and virtually unplayable out-swingers.’
ফাস্ট বোলিংয়ে ইমরানের আদর্শ ছিলেন ডেনিস লিলি। ১৯৭২ সালে সর্বপ্রথম লিলিকে দেখেই তাঁর ভেতরে ফাস্ট বোলার হওয়ার সুপ্ত বাসনা জেগে ওঠে। ইমরানের ভাষায়, ‘It was the first time I’d seen a genuine, express fast bowler since we didn’t have any.’
১৯৫২ সালের ৫ অক্টোবর, পাঞ্জাবের লাহোরের একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। বাবা ইকরামুল্লাহ খান নিয়াজী পেশায় একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, মা শওকত খানম গৃহিনী। চার বোন আর এক ভাইয়ের মধ্যে ইমরান ছিলেন সবার ছোট।
ইমরানের খালাতো ভাই মাজিদ খানও ছিলেন বিখ্যাত ক্রিকেটার। টেস্টে পাকিস্তানের হয়ে নেতৃত্বও দিয়েছেন ৬৩ টেস্ট এবং ২৩ ওয়ানডে খেলা সাবেক এই ডানহাতি ওপেনার।
ছোটবেলা থেকেই ইমরানের ক্রিকেটের প্রতি ছিল প্রবল ঝোঁক। নয় বছর বয়স থেকেই তিনি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন যে বড় হয়ে টেস্ট খেলবেন। ১৯৬৮ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে লাহোরের হয়ে খেলেন ক্যারিয়ারের প্রথম ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ।
১৯৭১ সালে টেস্ট অভিষেক, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এজবাস্টনে। অভিষেক লগ্নটা অবশ্য ছিল ভুলে যাবার মতই। ৮ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে করেছিলেন মাত্র ৫ রান আর বল হাতে ছিলেন উইকেটশূন্য।
১৯৭১ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত উস্টারশায়ারের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেট খেলেছেন ইমরান। সেখানে জন স্নো, মাইক প্রক্টরের মত গ্রেটদের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। ইংলিশ কন্ডিশনে খেলেই সুইং বোলিংয়ের যাবতীয় কলাকৌশল রপ্ত করেছেন তিনি। পাশাপাশি সমানতালে চালিয়ে গেছেন পড়াশুনাটাও। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভারসিটি থেকে দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতি বিষয়ের ওপর স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৭৫ সালে।
টেস্ট অভিষেকের পর পড়াশোনার ব্যস্ততায় টানা তিন বছর তিনি কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন নি। ১৯৭৪ সালে ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ওয়ানডে অভিষেকটা হয়ে যায় একরকম হুট করেই। ট্রেন্টব্রিজে স্বাগতিকদের বিরুদ্ধে ১০ ওভার বোলিং করে কোন উইকেট না পেলেও রান দিয়েছিলেন মাত্র ৩৬। আর ব্যাটিংয়ে তো নামারই সুযোগ হয় নি।
ইমরানের টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথম বড় সাফল্যটা আসে ১৯৭৬-১৯৭৭ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরে। দুর্ধর্ষ গতি, বাউন্স, কন্ট্রোল আর সুইংয়ের অনুপম প্রদর্শনী দেখিয়ে টানা ৩ ইনিংসে শিকার করেন ৫ উইকেট; সিডনি টেস্টে একাই নেন ১২ উইকেট!
১৯৭৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে একটি ফাস্ট বোলিং কনটেস্ট হয়েছিল যেখানে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন ইমরান। তাঁর ওপরে ছিলেন যথাক্রমে জেফ থমসন এবং মাইকেল হোল্ডিং। ওই প্রতিযোগিতায় আরও অংশ নিয়েছিলেন ডেনিস লিলি, গার্থ লে রুক্স, অ্যান্ডি রবার্টসের মত খ্যাতিমান ফাস্ট বোলাররা।
১৯৮০ সালে লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ইমরান পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। ৮ নম্বরে নেমে ১১৯ বলে ১২৩ রানের ‘ঝড়ো’ ইনিংস খেলেন মার্শাল, গার্নার, হোল্ডিং, ক্রফটের মত ভয়ঙ্কর ফাস্ট বোলারদের পিটিয়ে!
১৯৮১ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ২-১ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ হারে পাকিস্তান। তবে ব্যাট হাতে ২০৪ রান এবং বল হাতে ১৬ উইকেট নিয়ে সিরিজসেরা নির্বাচিত হন ইমরান। ওই সিরিজে পাকিস্তানের ইতিহাসে ‘তৎকালীন’ সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ফজল মাহমুদের ১৩৯ উইকেটের রেকর্ড টপকে যান তিনি।
১৯৮২ সালে অধিনায়ক হিসেবে জাভেদ মিয়াঁদাদের স্থলাভিষিক্ত হন ইমরান। ১৯৯২ বিশ্বকাপ পর্যন্ত মোট দুই দফায় এ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সর্বমোট ৪৮টি টেস্ট ম্যাচে দেশকে নেতৃত্ব দেয়া ইমরান ১৪টি জয় এবং ২৬টি ড্রয়ের বিপরীতে হেরেছেন মাত্র ৮টিতে। এছাড়া ১৩৯ ওয়ানডেতে ক্যাপ্টেন্সির দায়িত্বে থাকা ইমরান জিতেছেন ৭৭ ম্যাচ, হেরেছেন ৫৭টি আর ১টি ম্যাচের ফলাফল ছিল ‘টাই’।
ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট সিরিজ বিজয়ের মত ঐতিহাসিক অর্জন ছাড়াও ভারতের মাটিতে সিরিজ জয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে সিরিজ ‘ড্র’ করার মধ্য দিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে নিজেদের একটা শক্ত অবস্থান গড়ে তোলেন ইমরান।
১৯৮২ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে লাহোর টেস্টে একাই ১৪ উইকেট শিকার করেন ইমরান। প্রথম ইনিংসে ৮ উইকেটের পর দ্বিতীয় ইনিংসে নেন ৬ উইকেট।
জানিয়ে রাখা ভাল, ইমরানের ১১৬ রানে ১৪ উইকেট (৮/৫৮ ও ৬/৫৮) এখনও পর্যন্ত কোন এশিয়ান পেসারের টেস্টে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড। ১৯১ রানে ১৪ উইকেট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছেন চামিন্ডা ভাস।
এজবাস্টন, ১৯৮২। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসে মাত্র ৫২ রান খরচায় ইমরান তুলে নেন ৭ উইকেট! শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ড ম্যাচ জিতলেও দুই ইনিংস মিলিয়ে ৯ উইকেট আর ১২৩ রান নিয়ে ম্যাচসেরার পুরস্কারটা উঠেছিল ইমরানের হাতেই।
লর্ডসে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে পাকিস্তান জিতেছিল ১০ উইকেটের ব্যবধানে, ইমরান নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। উল্লেখ্য, এটি ছিল সুদীর্ঘ ২৮ বছর পর ইংল্যান্ডের মাটিতে পাকিস্তানের প্রথম টেস্ট জয় এবং সেটি এসেছিল ইমরানের অধিনায়কত্বে।
হেডিংলিতে সিরিজের শেষ টেস্টেও দুর্দান্ত অলরাউন্ড নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন ইমরান। ইংল্যান্ড জিতলেও দুই ইনিংস মিলে ১১২ রান ও ৮ উইকেট নিয়ে যথারীতি ম্যাচসেরা হন তিনি। পাকিস্তান সেবার ১-২ ব্যবধানে সিরিজ হারলেও ৫৩.০ গড়ে ২৬৫ রান আর মাত্র ১৮.৫৭ গড়ে ২১ উইকেট নিয়ে সিরিজসেরার ট্রফি জিতেছিলেন ইমরান খান।
১৯৮২-৮৩ মৌসুমে ছয় টেস্টের লম্বা সিরিজ খেলতে পাকিস্তান সফরে আসে ভারত। ওই সিরিজেই মাত্র ১৩.৯৫ গড়ে ৪০ উইকেট নিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েন ইমরান। টেস্টে এক সিরিজে কোন ‘পেসারের’ ৪০ উইকেট লাভের সর্বশেষ ঘটনা এটি। সিডনি বার্নস, রডনি হগ এবং টেরি অল্ডারম্যানের পর ‘চতুর্থ’ পেসার হিসেবে এই কৃতিত্বের অংশীদার হন ইমরান।
শুধু তাই নয়, কোন নির্দিষ্ট টেস্ট সিরিজে এখনও পর্যন্ত এটাই কোন ‘এশিয়ান বোলারের’ সর্বোচ্চ উইকেট প্রাপ্তির রেকর্ড। ৩৫ উইকেট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছেন ভারতের সাবেক লেগ স্পিনার ভগবৎ চন্দ্রশেখর।
সিরিজ জুড়েই দুর্দান্ত বোলিং করা ইমরান ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন ৪ বার আর ম্যাচে ১০ উইকেট দুইবার। সেরা বোলিং ৮/৬০। এছাড়া ব্যাট হাতে ১ সেঞ্চুরিসহ ৬১.৭৫ গড়ে করেন ২৪৭ রান।
মূলত ইমরানের ‘একক’ নৈপুণ্যেই পাকিস্তান সিরিজ জিতেছিল ৩-০ ব্যবধানে। ফয়সালাবাদ টেস্টে ব্যাট হাতে ১২১ বলে ১১৭ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলার পর ইমরান বল হাতে নেন ১১ উইকেট! ফলে ইতিহাসের মাত্র ‘দ্বিতীয়’ ক্রিকেটার হিসেবে একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট লাভের বিরল কৃতিত্ব স্থাপন করেন তিনি। টেস্টে বিরলতম এই কীর্তি আছে আর মাত্র দুজন ক্রিকেটারের। তাঁরা হলেন স্যার ইয়ান বোথাম এবং সাকিব আল হাসান।
১৯৮২ সালে ফর্মের তুঙ্গে থাকা ইমরান ৯ টেস্ট খেলে নিয়েছিলেন ৬২ উইকেট, মাত্র ১৩.২৯ গড়ে! যার ফলশ্রুতিতে ১৯৮৩ সালে জিতে নেন উইজডেন বর্ষসেরার পুরস্কার। টেস্টে এক পঞ্জিকাবর্ষে কমপক্ষে ৫০ উইকেট নিয়েছেন এমন বোলারদের মধ্যে এটাই (১৩.২৯) ইতিহাসে সর্বনিম্ন গড়।
ভারতের বিপক্ষে ব্যাটে-বলে স্বপ্নের মত এক সিরিজ কাটানোর পরই মারাত্মক ইনজুরিতে পড়েন তিনি। শিন বোনে স্ট্রেস ফ্র্যাকচারের আঘাতটা তাঁকে এতটাই ভুগিয়েছিল যে প্রায় আড়াই বছর বোলিং করা থেকে বিরত রাখেন নিজেকে।
অন্য কোন খেলোয়াড় হলে হয়তো খেলাই বন্ধ করে দিতেন, কিন্তু ইমরান মোটেই হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নন। বোলিং করতে পারবেন না তো কী হয়েছে? তিনি মনোযোগ দিলেন ব্যাটিংয়ে! নেটে ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করলেন ব্যাটিং নিয়ে। পরিশ্রমের ফলটাও পেলেন হাতেনাতেই।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পরের সিরিজটা তিনি খেললেন স্পেশালিষ্ট ‘নাম্বার সিক্স’ ব্যাটসম্যান হিসেবে। মেলবোর্ন টেস্টে ৮৩ আর ৭২ রানের দুটি ‘লড়াকু’ ইনিংস খেলে ম্যাচ বাঁচানোয় রাখলেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। মেলবোর্ন টেস্টের আগপর্যন্ত ৪৯ টেস্টে ইমরানের ব্যাটিং গড় ছিল ২৯.৮৯! আর পরের ৩৯ টেস্টের গড়টা একবার দেখুন, ৫০.১০!
প্রথম ৪৯ টেস্টে ইমরানের সেঞ্চুরি ছিল মাত্র ২টি, হাফ সেঞ্চুরি ৫টি! আর শেষ ৩৯ টেস্টে ৪টি সেঞ্চুরির পাশে ফিফটি ১৩টি! ক্রিকেটবোদ্ধাদের মতে, এমন অবিশ্বাস্য ‘রূপান্তর’ কেবল ইমরান খান বলেই সম্ভব হয়েছিল!
১৯৮৩ বিশ্বকাপটাও ইমরান খেলেছিলেন ‘শুধু’ ব্যাটসম্যান হিসেবেই। ৭ ম্যাচ খেলে ৭০.৭৫ গড়ে করেছিলেন ২৮৩ রান। হেডিংলিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হাঁকিয়েছিলেন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম ও একমাত্র সেঞ্চুরি (১০২*)।
বিশ্বকাপের পর ইংলিশ কাউন্টির দল সাসেক্সের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন ইমরান। ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সেখানেই খেলেছেন। কাউন্টিতে এর আগে তিনি খেলেছেন উস্টারশায়ারের হয়ে।
দীর্ঘ আড়াই বছর বিরতির পর ইমরান আবারও বল হাতে নেন ১৯৮৫ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে। ১৭ উইকেট নিয়ে পাকিস্তানের সিরিজ জয়ের অন্যতম নায়কও ছিলেন এই বিশ্বনন্দিত অলরাউন্ডার। শিয়ালকোট টেস্টে ইনিংসে ৫ উইকেটসহ একাই নিয়েছিলেন ৯ উইকেট।
একই বছর শারজায় অনুষ্ঠিত চারজাতি ওয়ানডে সিরিজের এক ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে মাত্র ১৪ রানের বিনিময়ে তুলে নেন ৬ উইকেট। ভারতীয় ব্যাটিং অর্ডারের প্রথম ৬ ব্যাটসম্যানের ৫ জনকেই আউট করেছিলেন বিধ্বংসী এক স্পেলে। উল্লেখ্য, এখনও পর্যন্ত ওয়ানডেতে এটাই ‘পরাজিত’ দলের পক্ষে ‘সেরা’ বোলিং ফিগার।
১৯৮৬-৮৭ সালের ভারত সফরটা ছিল ইমরানের ক্যাপ্টেন্সি ক্যারিয়ারের স্মরণীয়তম অধ্যায়। সিরিজ জুড়ে ব্যাটে-বলে পারফর্ম করার পাশাপাশি মাঠে এবং মাঠের বাইরে তাঁর বেশ কিছু সিদ্ধান্ত রীতিমতো টনিকের মত কাজ করেছিল। যেমন- ভারতীয় লেফট আর্ম স্পিনারদের বিপক্ষে ‘কাউন্টার’ হিসেবে তিনি দলে অন্তর্ভুক্ত করেন ২০ বছর আগে সবশেষ টেস্ট খেলা চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ইউনুস আহমেদ এবং বাঁহাতি স্পিন অলরাউন্ডার ইজাজ ফাকিহ — এই দুজনকে।
আহমেদাবাদ টেস্ট ড্রয়ের পেছনে নেপথ্য কারিগর ছিলেন এই দুজনই। ৮ নম্বরে নেমে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি (১০৫) হাঁকিয়েছিলেন ফাকিহ আর ‘ধৈর্যের প্রতিমূর্তি’ বেশে ইউনুস খেলেছিলেন ১৪০ বলে ৫৬ এবং ২২৬ বলে ৩৪ রানের দুটি মূল্যবান, সংযমী ইনিংস।
বেঙ্গালুরুতে ‘ঐতিহাসিক’ সিরিজ নির্ধারণী শেষ টেস্টে কিংবদন্তী লেগ স্পিনার আব্দুল কাদিরকে কোন কারণ ছাড়াই বসিয়ে রাখেন ইমরান। তাঁর জায়গায় খেলান অভিজ্ঞ বাঁহাতি স্পিনার ইকবাল কাশিমকে। ইমরানের যুক্তি ছিল, ভারতের মাটিতে কাদিরের লেগস্পিন তেমন কার্যকর নয়। শেষ পর্যন্ত ‘তরুণ’ ডানহাতি অফ স্পিনার তৌসিফ আহমেদের (৫/৫৪ এবং ৪/৮৫) সাথে মিলে এই ইকবাল কাশিমই (৫/৪৮ এবং ৪/৭৩) ঘূর্ণিবলে বাজিমাত করেছিলেন!
টার্নিং উইকেটে শক্তিশালী স্পিন আক্রমণের বিপক্ষে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস (২৬৪ বলে ৯৬) উপহার দিয়েও দলের হার এড়াতে পারেন নি ‘লিটল মাস্টার’ সুনীল গাভাস্কার। শেষদিনে ২২১ রানের জয়ের লক্ষ্যে খেলতে নেমে ভারত থেমেছিল ২০৪ রানে।
ভারতের মাটিতে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ে বল হাতে সেভাবে জ্বলে না উঠলেও (মাত্র ৮ উইকেট) ইমরান অবদান রেখেছিলেন ব্যাট হাতে; ১ সেঞ্চুরি ও ২ ফিফটিতে করেছিলেন ৩২৪ রান।
টেস্ট সিরিজের পরে অনুষ্ঠিত ৬ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজটাও জিতেছিল পাকিস্তান। নাগপুরে সিরিজ নির্ধারণী পঞ্চম ওয়ানডেতে বল হাতে ৩ উইকেট লাভের পাশাপাশি ব্যাট হাতে ৬৫ বলে ৭৩ রানের একটি ঝড়োগতির ‘ম্যাচ উইনিং’ নক উপহার দেন ইমরান।
হেডিংলি, ১৯৮৭। নিখুঁত-নিয়ন্ত্রিত সুইং বোলিং যে কতটা বিষাক্ত, কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তারই বাস্তব প্রয়োগ দেখালেন ইমরান৷ দ্বিতীয় ইনিংসে ৪০ রানে ৭ উইকেটের বিধ্বংসী এক স্পেলে গুঁড়িয়ে দিলেন ইংরেজ ব্যাটিং লাইনআপ! এর আগে প্রথম ইনিংসে নিয়েছিলেন ৩৭ রানে ৩ উইকেট! পাকিস্তান জিতল এক ইনিংস ও ১৮ রানের ব্যবধানে।
উল্লেখ্য, ইতিহাসে সেবারই ‘প্রথম’ ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জয়ের আনন্দে ভেসেছিল পাকিস্তান। আর ‘ঐতিহাসিক’ সেই সিরিজ জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইমরান। বল হাতে ২১ উইকেট লাভের পাশাপাশি ব্যাট হাতে করেছিলেন ১৯১ রান (১ সেঞ্চুরি, ১ ফিফটি)।
একই বছর শারজায় ভারতের বিপক্ষে একটি ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে মাত্র ২৭ রানে ৪ উইকেট নিয়ে দলকে দারুণ এক জয় উপহার দেন ইমরান। এরপর ১৯৮৭ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ‘দুটি’ জয়ে ম্যাচসেরা হন তিনি। কাকতালীয় ব্যাপার হল, দুই ম্যাচেই ইমরানের বোলিং ফিগার ছিল আইডেন্টিক্যাল, ৩৭ রানে ৪ উইকেট!
১৯৮৭ বিশ্বকাপের পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন ইমরান। কিন্তু পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়া-উল-হকের অনুরোধে এক বছর না ঘুরতেই আবার ফিরে আসেন। এসেই বুঝে নেন অধিনায়কত্বের দায়িত্ব। ক্রিকইনফোর বিশিষ্ট সাংবাদিক ওসমান সামিউদ্দীনের ভাষায়, ‘দ্য বেস্ট থিং এভার হ্যাপেন্ড টু পাকিস্তান ক্রিকেট।’
১৯৮৭-৮৮ মৌসুমে ইমরানের নেতৃত্বে ইতিহাসে প্রথমবারের মত উইন্ডিজের মাটিতে টেস্ট সিরিজ ‘ড্র’ (১-১) করতে সমর্থ হয় পাকিস্তান। যেখানে ইমরানের অবদান ছিল ১৮.০৯ গড়ে ২৩ উইকেট (দুইবার ইনিংসে ৫ উইকেটসহ) এবং ব্যাট হাতে ১১৫ রান।
যথারীতি সিরিজ সেরার পুরস্কারও উঠেছিল তাঁর হাতেই। ইমরানের চোখে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ট্যুরে নিজের পারফরম্যান্স সম্পর্কে মূল্যায়ন ছিল, ‘The last time I really bowled well.’
১৯৮৮-৮৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড সিরিজে অংশ নিয়ে ইমরান করেছিলেন ২৩৫ রান; পেয়েছিলেন ৭ উইকেট। তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অলরাউন্ড নৈপুণ্যটি এসেছিল ব্রিসবেনে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ব্যাট হাতে মাত্র ৪১ বলে ৬৭ রানের ‘টর্নেডো’ ইনিংস খেলার পর বল হাতে নিয়েছিলেন ৩ উইকেট।
একই বছর শারজায় অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের ফাইনালে আরও একবার অলরাউন্ডার হিসেবে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দেন ইমরান। স্যার ভিভ রিচার্ডসের উইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৬ বলে ৬০ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলার পর বল হাতে নেন ২ উইকেট।
১৯৯০ সালের ওয়ার্ল্ড সিরিজেও ইমরান ছিলেন দারুণ ধারাবাহিক। ব্যাট হাতে ২৮৩ রানের পাশাপাশি বল হাতে নেন ৮ উইকেট।
একই বছর শিয়ালকোটে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলেন বিদায়ী টেস্ট ম্যাচ। বল হাতে কোন উইকেট না পেলেও ব্যাট হাতে করেন অপরাজিত ৯৩ রান। আর ’৯২ বিশ্বকাপের ফাইনালটা ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ব্যাট হাতে জয়সূচক ৭২ রান, ম্যাচের শেষ বলে উইকেট এবং সবার মধ্যমণি হয়ে বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরার মধ্য দিয়ে বিদায়ের ক্ষণটাকে ‘নায়কোচিত’ করে রাখেন তিনি। টেস্ট ইতিহাসে মাত্র ৮ জন ক্রিকেটারের রয়েছে ৩০০ উইকেট ও ৩০০০ রানের ‘অলরাউন্ডারস ট্রিপল’। ইমরান তাঁদেরই একজন।
ক্যারিয়ারে মোট পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলেছেন ইমরান। বিশ্বকাপে তাঁর সংগ্রহ ৬৯৬ রান এবং ৩৫ উইকেট। তবে টুর্নামেন্টভেদে তাঁর ‘প্লেয়িং রোল’ ছিল আলাদা। প্রথম দুটি বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছেন ‘শুধুই বোলার’ হিসেবে, ১৯৮৩ বিশ্বকাপে ‘স্পেশালিষ্ট ব্যাটসম্যান’ আর শেষ দুটি বিশ্বকাপ খেলেছেন ব্যাটিং অলরাউন্ডারের ভূমিকায়।
পাকিস্তানের জনমানসে ইমরান এক কিংবদন্তির নাম। তাঁর একুশ বছরের বর্ণাঢ্য ক্রিকেট জীবনে অর্জনের কথা বলে শেষ করা যাবে না। সময়ের সেরাদের একজন তো বটেই, নিঃসন্দেহে তিনি সর্বকালেরও অন্যতম সেরা ক্রিকেটার। স্যার রিচার্ড হ্যাডলির ভাষায়, ‘আমার যুগের সেরা অলরাউন্ডার ইমরান খান।’
শেষ করব বিশিষ্ট কলামিস্ট ও ক্রীড়ালেখক ওসমান সামিউদ্দীনের একটি উক্তি দিয়ে, ‘Just imagine cricket’s landscape in Pakistan without Imran. Might not hockey be the national sport in name and spirit? For sure the country would have been one of spinners and medium-pacers, no Wasim, Waqar, Zahid, Shoaib and Amir in sight.’