বয়স মাত্র ৩৩ বছর। ক্রিকেটের মাঠে এই বয়সী একজনকে আর যাই হোক ‘বুড়ো’ বলা যায় না। ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটাতেও ২৩ বলে করলেন ৩১ রান। এর আগে খোদ অধিনায়ক মোহাম্মদ নবীও কয়েক দফা বুঝিয়েছেন তাঁকে। কাজ হয়নি। অবসরের সিদ্ধান্ত থেকে এক পাও সরেননি তিনি। কোনো এক অজানা কারণে, গোপন এক কষ্ট বুকে নিয়ে সব রকমের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ফেললেন আসগর আফগান। কি সেই কারণ?
নাম তাঁর মূলত আসগর স্ট্যানিকজাই। তবে, দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ প্রমাণ দেখাতে নামের সাথে যোগ করেন ‘আফগান’। কোনো সন্দেহ ছাড়াই তিনি আফগানদের ইতিহাসের সেরা অধিনায়ক। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জয় তাঁর (৪২)। ৪১ টি জয় নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছেন ভারতের মহেন্দ্র সিং ধোনি।
আফগানদের ইতিহাসে তিনি কিংবদন্তি। এমন একজন ক্রিকেটার কেন অবসর নেবেন বিশ্বকাপের মাঝপথে, তাও এমন একটা সময়ে যখন আফগানদের এখনও সেমিফাইনালে খেলে ফেলার বেশ দারুণ সম্ভাবনা আছে।
প্রশ্ন থাকছেই। নামিবিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ শেষে আসগর আফগান আবেগ ও চোখের জলে ভেসেছেন। তবে, এর মধ্যেও এমন ছোট্ট একটা কথা বলেছেন, যার অনেক রকম অর্থ চাইলে বের করা যায়।
তিনি বলেন, ‘আমি তরুণদের সুযোগ দিতে চাই। সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না, তবে আমার মনে হয়েছে এটাই সেরা সময়। অনেকেই আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে, এই সময় কেন অবসর নিলাম! কিন্তু সেটা এমন একটা কারণ, যা আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না। আসলে শেষ ম্যাচে আমরা খুবই আশাহত হয়েছিলাম। তার পরেই অবসরের চিন্তা মাথায় আসে। তবে, আমি প্রচুর স্মৃতি নিয়ে শেষ করছি।’
শুধু পাকিস্তানের বিপক্ষে হার নাকি আরো কিছু বিষয় জড়িত এখানে? তাহলে কি আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (এসিবি) সাথে কোনো দ্বন্দ্ব? সিনিয়র ক্রিকেটারদের মধ্যে কোনো কোন্দল? দলের মধ্যে গ্রুপিং? না কি অন্য কিছু? – এর কোনো সম্ভাবনাই ঠিক উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আর আসগর আফগান ইস্যুতে কেন যেন এসিবি বরাবরই খুব অদ্ভুত আচরণ করে এসেছে। কখনোই কেন যেন আফগান আপন হতে পারেননি আফগান বোর্ডের।
আর, আফগানিস্তানের অধিনায়কত্বটা অনেকটা মিউজিক্যাল চেয়ারের মত। প্রায়ই অহেতুক সব কারণে অধিনায়ক পাল্টানোকে দেশটির ক্রিকেট বোর্ড প্রায় নিয়মে পরিণত করেছে।
২০১৯ বিশ্বকাপের আগেও সব ফরম্যাটের অধিনায়ক ছিলেন আসগর আফগান। তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ওয়ানডে দলের অধিনায়ক করা হয় গুলবাদিন নাঈবকে। তিনি বিশ্বকাপে গিয়ে দল নিয়ে সবগুলো ম্যাচ হেরে আসেন।
বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর স্বাভাবিক ভাবেই নড়েচড়ে বসে আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (এসিবি)। আর এর আগে থেকেই শীর্ষস্থানীয় আফগানিস্তান ক্রিকেটারা বোর্ডের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছিলেন। বিশেষ করে মোহাম্মদ নবী ও রশিদ খানের মত সিনিয়র ক্রিকেটাররা প্রকাশ্যে বোর্ডের সমালোচনাও করেছিলেন।
এসিবি তখন আগে থেকেই টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক থাকা রশিদ খান ওয়ানডে ও টেস্ট দলের দায়িত্বও দিয়ে দিল। এখানেই থেমে গেলে চলতো। কিন্তু তা হল না। বোর্ডের পট পরিবর্তনের সাথে সাথে আসগর আফগান আবারো সব ফরম্যাটের অধিনায়কের দায়িত্বে ফিরলেন ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। মানে এক বছরের মধ্যেই অধিনায়কত্ব হারিয়ে আবার ফিরেও পান আফগান। এই সময় তাঁর অবর্তমানে অধিনায়কত্ব করেন আরো দু’জন।
শেষবার যখন অধিনায়কত্ব করেন, তখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাটিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১-১ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ ড্র করে আফগানিস্তান। প্রথম টেস্ট খুব বাজেভাবে হারে আফগানিস্তান। সেই ম্যাচের পুরস্কার বিতরণীতে ‘ভিসা বিষয়ক জটিলতা’র কথা বলেন। যদিও ৩৩ বছর বয়সী এই অধিনায়ক পরের ম্যাচেই ১৬৪ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন, যার সুবাদে আফগানিস্তানের জয়ের পথ সহজ হয়। যদিও, বোর্ডের কাছে এই পারফরম্যান্স যথেষ্ট বলে মনে হয়নি।
এবারে বিশ্বকাপের আগে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মাঝেই দল ঘোষণা করে আফগানিস্তান। অধিনায়ক করা হয় রশিদ খানকে। তবে, রশিদ খান অধিনায়কের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে দাবি করেন, দল গঠনে তাঁর কোনো রকম মতের গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
শোনা যায়, হামিদ হাসান, মোহাম্মদ শাহজাদদের মত সিনিয়র ক্রিকেটারদের তিনি চাননি দলে। এমনও হতে পারে, রশিদের অপছন্দের তালিকায় আসগরও ছিলেন। এখন বিশ্বকাপের মাঝপথে আসগরের অবসরের ঘোষণা অনেক আশঙ্কা ও সন্দেহের ডালপালা গজানোর সুযোগ করে দিচ্ছে।
তবে, বিদায়টা স্মরণীয় হল আফগানের। জয় পেলেন। সতীর্থরা গার্ড অব অনার দিয়ে তাঁকে মাঠ থেকে বের করলেন। ম্যাচ শেষে রীতিমত সতীর্থদের কাঁধে চড়ে সম্মান পেলেন। পুরো মাঠ ‘আসগর! আসগর! আসগর!’ ধ্বনিতে মুখরিত হল। আসগরের মন ও মগজে তখন কি চলছিল – কে জানে!