আদ্রতা ও শিশির: জয়-পরাজয়ের নিয়ামক

ক্রিকেটে মাঠে আবহাওয়া এবং পিচের উপর খেলার ফলাফল অনেকাংশেই নির্ভরশীল। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের পাশাপাশি কন্ডিশনের পর্যালোচনা করা যেন আধুনিক ক্রিকেটের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হচ্ছে দিনকে দিন। কন্ডিশনের হিসেবে হেরফের হলেই দেখা মিলবে পরাজয়ের। অন্তত এর প্রমাণ মিলেছে চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। পিচের আদ্রতা ও সন্ধ্যের পরে শিশির এই দুই মিলিয়ে গড়ে দিচ্ছে পার্থক্য দলের জয়-পরাজয়ের।

এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অধিকাংশ ফলাফলই গিয়েছে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করা দলের পক্ষে। এখন পর্যন্ত খেলা ১৫টি সুপার টুয়েলভ রাউন্ডের ম্যাচের ১২টিতেই জয় পেয়েছে দ্বিতীয় ইনিংস এ ব্যাট করা দল। মাত্র তিনটি ম্যাচের ফলাফল গিয়েছে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করাদের পক্ষ। এর মধ্যে আফগানিস্তান জিতেছে দুইটি স্কটল্যান্ড এবং নামিবিয়ার বিপক্ষে এবং অন্য ম্যাচটিতে জয় পেয়ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাংলাদেশের বিপক্ষে। এর পেছনে রয়েছে আরব আমিরাতের উইকেটের আদ্রতা ও রাতের শিশির।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সপ্তম আসর। বৈশ্বিক এই টুর্নামেন্টের আগেই বিশ্বকাপের ভ্যেনুগুলো আয়োজন করছিল ৩১ টি আইপিএল ম্যাচ এতেই হাপিয়ে উঠেছে আরব আমিরাতের তিন ভ্যেনুর পিচ। ক্লান্ত পিচকে সজীব রাখতে কিউরেটরে নির্দেশনায় চলছে অতিরিক্ত পানি দেওয়ার কাজ।

এই অতিরিক্ত পানির ফলে যা হচ্ছে পিচগুলোতে উপর থেকে একটু সজীব দেখাচ্ছে। কিন্তু এর পরের লেয়ারেই রয়েছে যাচ্ছে পানি। পিচের অতিরিক্ত পানিতে কাজ হচ্ছে দু’রকম। এক পিচ বেঁচে রইছে আরো কিছু খেলা চালিয়ে নেবার জন্য়ে, আর দুই বোলাররা পাচ্ছে একটু বাড়তি সুবিধা।

বাড়তি সুবিধাটা ঠিক দুই ইনিংসেই বোলাররা পাচ্ছে ব্যাপারটা ঠিক সেরকম না। তাঁর উদাহরণ হিসেবে টেনে নিয়ে আসা যেতে পারে ভারতের দুই ম্যাচ। তাঁদের দু’টো ম্যাচই হয়েছে সন্ধ্যের পর এবং কাকতালীয় কিংবা ভাগ্যের ভারত বিমুখি আচারণে তাঁরা দুই ম্যাচেই বল করার সুযোগ পেয়েছে দ্বিতীয় ইনিংসে। হেরেছেনও ঠিক বড় উইকেট ব্যবধানে। একটিতে দশ অন্যটিতে আট।

ঠিক এই দুই ক্ষেত্রে ভারতের ব্যাটারদের বিপক্ষে পিচের আদ্রতার বাড়তি সুবিধাটুকু লুফে নিয়েছিল পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের বোলাররা। বাড়তি সুবিধা ওই বল খানিক স্কিড করা। এই খানিক স্কিডিং করা বলে একটা ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণ হয়ে যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট। তাছাড়া বোলারদের বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংও প্রশংসা পাবার যোগ্য।

কিন্তু প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে তো উভয় দলের বোলারদেরই সমান সুবিধাটুকু পাবার কথা। ‘আজ্ঞে না জনাব’ বলে ঠিক সন্ধ্যের পরপরই হাজির হয়েছে রাতের শিশির। শিশির ঠিক কি ক্ষতি করে বোলারদের তা হয়ত অনেকের জানা। তবুও নতুন করে আবার একটু জানাই। একে তো ক্রিকেট বলের বাইরের দিকটা চামড়ার প্রলেপে থাকে ঢাকা। তার উপর খেলোয়াড়দের হাতের ঘাম এবং শিশিরের সংমিশ্রণে তা রীতিমত হাতে ধরা মুশকিল হয়ে পড়ে। মাশরাফি বিন মর্তুজা একবার বলেছিলেন শিশিরে ভেজানো বল ধরলে মনে হবে তাতে সাবান মেখে দেওয়া হয়েছে।

পিচের সেই আদ্রতার সুবিধাটা ছাপিয়ে তখন শিশির ভেজা বল ধরাটাই যেন দুষ্কর হয়ে পড়ে। তখন ঠিক জায়গায় বল করে যাওয়াই যেন পাহাড় চড়াসম কাজে রুপান্তরিত হয়। এর ফলে যা হয় তা হচ্ছে প্রচুর পরিমাণ বাজে বল। অনিচ্ছাকৃত বাজে বলে ব্যাটাররা যেন হাত খুলে খেলতে নেই কোন মানা। আর টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাজে বল করার সময় বা সুযোগ কম থাকে। তার থেকেও বড় বিষয় একটি বাজে ওভারের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া বেশ কষ্টসাধ্য এক কাজে পরিণত হয়।

প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে অতিরিক্ত সুবিধা যেন পিচ থেকে না পাওয়া যায় সে ব্যবস্থা করা যায় না? না আপাতত যাচ্ছে না। আরব আমিরাতের তপ্ত রোদে পিচ ফেটে চৌচির হয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। তখন ঘটনাটা হিতে-বিপরীত হয়ে যেতে পারে। সজীব পিচের আসায় এবং শেষমেশ এই বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের পরিসমাপ্তির আগ পর্যন্ত পিচকে তো অন্তত বাঁচিয়ে রাখার তাগিদেই পানির ব্যবহার কমানো সম্ভব নয়।

এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের একটি মাত্র উপায় রয়েছে। তা হলো দলের মাইন্ডসেট। আগামী প্রতিটি ম্যাচের পূর্বে প্রতিটি দলকে নিজেদের মানসিকভাবে এমন একটা অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে যেখান থেকে যে কোন পরিস্থিতিতে দল জয়ের জন্যে খেলবে। মাথায় থাকবে না শিশিরতত্ত্ব। শুধুই থাকবে ক্রিকেটীয় চিন্তাভাবনা। এর পাশাপাশি পর্যালোচনা হবে শুধুই প্রতিপক্ষকে নিয়ে। হয়ত তখন আগে ব্যাটিং করে পিচের আদ্রতা ও রাতে বোলিং করে শিশিরের অসযোগিতা ছাপিয়ে জয় ছিনিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link