মাঠে তাঁর ডাক নাম ছিল ম্যাড ম্যাক্স। সেট হয়ে যাওয়ার পরেও হুট হাট শট খেলে আউট হয়ে যাওয়ার জন্যই এই নাম ছিল। অরবিন্দ ডি সিলভা মানেই ছিল পাগলামি। ক্যারিয়ারের প্রথম ১০০ টি ওয়ানডে শেষে তাই নামের পাশে মাত্র ২৮.৪৩ গড়ে রান ২৫৩০। তবে একটা সময়ে পরিণত বোধটা ভেতরে জেগে উঠলো।
শ্রীলঙ্কা বিশ্ব ক্রিকেটে এক সময়ে শিশুই ছিল। সেই শিশুকে বড় করে তোলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন আরেক বর্ষীয়ান ক্রিকেটার অর্জুনা রানাতুঙ্গাকে নিয়ে। ১৯৯৫ সালে অষ্ট্রেলিয়াতে অনুষ্ঠেয় তিন জাতির টুর্নামেন্টে ওয়েষ্ট ইন্ডিজ আর অস্ট্রেলিয়ার সাথে শ্রীলঙ্কাকে কেউ হিসেবের মধ্যে রাখেনি।
শুধু মাত্র অংশ গ্রহণের জন্যই তাদের যাত্রা ছিল। কিন্তু ওয়েষ্ট ইন্ডিজকে টপকিয়ে তারা ফাইনালে উঠে সবাইকে চমকে দিল। ঘরের মাঠে অনুষ্ঠেয় ১৯৯৬ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা তাই ডার্ক হর্স হিসেবেই বিবেচিত হলো। কিন্তু, হুট করে এক টুর্নামেন্টে ভাল করা এক বিষয়, আর ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপে ভালো করা ভিন্ন বিষয়।
যে শ্রীলঙ্কা এর আগে কখনো সেমিফাইনালও খেলতে পারেনি, সেই দলটা বিশ্বকাপ জিতবে এটা সম্ভবত শ্রীলঙ্কানরাও ভাবতে পারেনি। এই ধরণের টুর্নামেন্ট জিততে হলে বড় দুই একটা ম্যাচে স্পেশাল কিছু খেলোয়াড়কে এগিয়ে আসতে হয়। কে জানতো যে সেই এগিয়ে আসার কাজটা এক সময়ের দায়িত্বজ্ঞানহীন ডি সিলভাকেই করতে হবে।
সেই টুর্নামেন্টে ডি সিলভা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৯১ আর কেনিয়ার বিপক্ষে ১৪৫ রানের ইনিংস খেললেও ফোকাসটা ছিল ঝরো গতিতে ব্যাটিং করা জয়াসুরিয়ার দিকে। সেমিফাইনালে ভারতের মাঠে তাদের বিপক্ষে ম্যাচটাতেও টার্গেট জয়াসুরিয়াই ছিল।
লিগ পর্যায়ে ভারতের ২৭২ রানের টার্গেটকেও মামুলি বানিয়ে ফেলাতে ভুমিকা ছিল ৭৬ বলে ৭৯ রানের একটা ইনিংস। এছাড়া কোয়ার্টারে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪৪ বলে ৮২ রানের ইনিংস খেলার পর জয়াসুরিয়াকে নিয়ে ভাবনাটা তাই অমূলক ছিল না।
ম্যাচের তৃতীয় বলেই উইকেটরক্ষ ব্যাটসম্যান রমেশ কালুভিতারানা ০ রানে আর চতুর্থ বলে জয়াসুরিয়াকে ১ রানে আউট করে পুরো স্টেডিয়াম বুঝিয়ে দিল যে দিনটা ভারতের। কিন্তু মাঠে নেমে প্রথম বলেই চার মেরে ডি সিলভা বুঝিয়ে দিলেন যে মাঠের দর্শকদের সাথে তিনি মোটেও একমত নন। দলীয় ৩৫ রানের মাথায় তাকে ছেড়ে চলে গেলেন গুরুসিনহা মাত্র ১ রান করে।
দলীয় ৮৫ রানে যখন আউট হলেন তখন তার নামের পাশে রান ৬৬, সেটাও মাত্র ৪৭ বলে ১৪ টি চারের সাহায্যে। এক মূহুর্তের জন্যও শ্রীলঙ্কার রান রেটকে কমতে দেননি। ফিল্ডিং এ নেমে ১ টা উইকেট নিলেন আর ১ টা ক্যাচ ধরলেন। ম্যান অব দি ম্যাচ ডি সিলভা।
ফাইনালেও একই অবস্থা। ফেভারিট অষ্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২৪২ রানের টার্গেটে নেমে ২৩ রানেই ২ উইকেট নেই। সেখান থেকে অপরাজিত থেকে শ্রীলঙ্কাকে জিতিয়েই ফিরলেন ডি সিলভা, নামের পাশে ১২৪ বলে ১০৭ রান। এর আগে বোলিংয়ে নিয়েছেন তিন উইকেট, ক্যাচ দু’টি। ফাইনালেও ম্যান অব দি ম্যাচ ডি সিলভা। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের ইতিহাসে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে সেঞ্চুরির পাশাপাশি তিন উইকেট লাভ করেছেন।
শ্রীলঙ্কার ইতিহাস গড়ার মূল কারিগরটা অরবিন্দ ডি সিলভাই। এই মূহুর্তে কুমার সাঙ্গাকারা কিংবা মাহেলা জয়াবর্ধানে রান সংখ্যায় তাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট আজও তাঁদের দেশের সেরা ব্যাটসম্যানের নাম বললে ডি সিলভাকেই বেছে নেয়।
ক্যারিয়ারের মত, নিজের ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন পাগলাটে। দামি রেসিং কার নিয়ে নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন। অথচ, শরীরে ছিল সামান্য একটা ট্র্যাকস্যুট।
যুগে যুগে প্রতিটি জাতিই তাদের ইতিহাস গড়ার জন্য একজন মহানায়কের জন্য অপেক্ষা করে। অরবিন্দা ডি সিলভা শ্রীলঙ্কার জন্য সেই মহানায়কই ছিলেন। শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা বা রিকি পন্টিংদের মত বড় বড় কিংবদন্তিদের পাশে ডি সিলভার রেকর্ড হয়তো কিছুই না। তবে, নব্বই দশকে যারা নিয়মিত টেলিভিশনে খেলা দেখেছেন, তাঁদের সবাই জানেন নিজের দিনে ডি সিলভা কি করার ক্ষমতা রাখতেন!