দ্য অরিজিনাল ক্যাপ্টেন কুল!

‘দিস ইজ আ লিটল ফেইরি টেল…’ – কিংবদন্তি টনি গ্রেগের শরীরে শিহরণ জাগানো ভঙ্গিতে বলা কথাগুলোতো নিখাদ সত্যি – রূপকথাই তো বটে।

১৯৯৬ সালের আইসিসি বিশ্বকাপের ঠিক আগের তিন বছরের পরিসংখ্যান দেখলে দলটা যেখানে প্রথম সারির সাতটি দেশের বিরুদ্ধে এক দিনের ক্রিকেটে ৩৮ টি ম্যাচ হেরেছে সেখানে জয়ের সংখ্যা মাত্র ২৪। প্রথম সারির দলগুলোর বিরুদ্ধে মাত্র সাত বার স্কোরবোর্ডে ২৫০ রান তুলতে ও জিততে সমর্থ হয়েছে।

ব্যাংকের পার্ট টাইম ক্লার্ক কিংবা বিমা কোম্পানির এজেন্ট কিংবা সেলসম্যানদের নিয়ে গড়া একটা জাতীয় দল সমগ্র ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দিয়ে বিশ্ব ক্রিকেট সাম্রাজ্যের মুকুট পরে নিলো এও কি সম্ভব? সম্ভব হল কি করে?

হল একটা মানুষের জন্য যিনি হয়তো তাঁর দলের কাউকে ক্রিকেট কিভাবে খেলতে হয় শেখাননি তবে তাঁদেরকে শিখিয়েছেন কিভাবে হীনমন্যতাকে দূর করে নিজের আত্মবিশ্বাসে ভর করে নিজের প্রতিভার জেরে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সংকল্পের জোরে বিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়াই করে নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়, জয় ছিনিয়ে নিতে হয় – তিনি অর্জুনা রানাতুঙ্গা।

নব্বইয়ের দশকে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডের এমনই দৈন্যদশা ছিল যে জাতীয় দলের তরুণ খেলোয়াড়রা যা পারিশ্রমিক পেতেন তাতে তাদের পক্ষে কলম্বোর বাইরে থেকে এসে রাজধানীতে মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগাড় করে ওঠা সাধ্যাতীত হয়ে দাঁড়াতো। আর, তখনই পরিত্রাতা হয়ে দাঁড়ালেন তৎকালীন সময়ে দ্বীপরাষ্ট্রটির ক্রিকেট ইতিহাসে কনিষ্ঠতম অধিনায়ক অর্জুনা।

প্রতিভাবান অলরাউন্ডার সনাথ জয়াসুরিয়া ও পেস বোলার প্রমদা বিক্রমাসিংহে-সহ একাধিক তরুণ ক্রিকেটারকে রাজধানীতে নিজের বাসভবনে এনে রাখলেন। এই প্রসঙ্গে অধিনায়ক একবার মজার ছলে বলেছিলেন – ‘যে একটা বিষয় সবার আগে বেশি মনে পড়ছে তা হল আমাকে ঘর পাল্টাতে হয়েছিল, কারণ সনাথ  (জয়াসুরিয়া) বেশ জোরে নাক ডাকে!’

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) আর্থিক সাহায্যে ক্রিকেট বোর্ড ডেভ হোয়াটমোরকে কোচ হিসেবে ও অ্যালেক্স কাউন্টোরিসকে ফিটনেস ট্রেনার হিসাবে নিয়োগের পরপরই শুরু হলো উপমহাদেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত হতে চলা প্রথম বিশ্বকাপের প্ল্যানিং ও প্রস্তুতি। এক্ষেত্রেও চাণক্য সেই অধিনায়কই। অধিনায়ক দলের প্রত্যেক সদস্যের সাথে ব্যক্তিগত স্তরে আলাপ আলোচনা করে প্রত্যেককে তার ভূমিকা বুঝিয়ে দিলেন।

দীর্ঘদেহী টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান আসাঙ্কা গুরুসিনহা এই বিষয়ে বলেন, ‘অর্জুনা জানে আমি ছক্কা হাঁকাতে পারি। কিন্তু আমার কাজটা এখানে সে পরিস্কার করে দিয়েছে। আমাকে পুরোটা ইনিংস ব্যাট করতে হবে।’

এমনকি বোলারদের জন্যও আলাদা আলাদা প্ল্যান ছিল। অধিনায়ক প্রত্যেক বোলারের ভূমিকা তাদেরকে একান্তে বুঝিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে পেস বোলার বিক্রমাসিংহে বলেছিলেন, ‘আমার দায়িত্ব ছিল নতুন বলটাকে পুরনো বানানো। উইকেট পেয়ে গেলে সেটা ছিল বোনাস। কিন্তু, মূল কাজ ছিল বলটাকে ভাল করে কচলে দেওয়া। সাধারণত লম্বা স্পেল করতাম, টানা আট ওভার। ভাস কম বোলিয় করতো, যাতে ডেথ ওভারের জন্য মজুদ রাখা যায়।’

বিচক্ষণভাবেই একমাত্র একজনকে অধিনায়ক কোনো নির্দিষ্ট ভূমিকায় বেঁধে রাখতে চাননি। তিনি হলেন ওই প্রজন্মের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান অরবিন্দ ডি সিলভা। সেসময়ে শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা, মার্ক ওয়াহ, ইনজামাম উল হকের মত বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানদের সাথে একই পংক্তিতে নাম উচ্চারিত হওয়া অরবিন্দ ডি সিলভাকে অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘তুমি শুধু একটা সেঞ্চুরি করো, সেটাই অনেক। তুমি আমাদের জন্য বিশ্বকাপ আনতে পারবে।

টুর্নামেন্ট শুরুর কয়েক সপ্তাহ আগে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে মুত্তিয়া মুরালিধরনকে চাকিংয়ের দায়ে ‘নো’ ডাকার প্রতিবাদে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া হোক বা দেশের এ প্রান্ত ও প্রান্ত ঢুঁড়ে ফেলে তরুণ প্রতিভা আবিস্কার করে নিচের বাড়িতে রেখে প্রতিভার পালিশ করা হোক বা দলের বিপদে যেকোনো পিচে যেকোনো পরিস্থিতিতে ফেদারলাইট প্যাড জোড়া গলিয়ে ব্যাট হাতে দলকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে নেমে পড়া হোক – সেকালে মিডিয়া আজকের মত সক্রিয় থাকলে বা এটা ভারতীয় মিডিয়া হলে বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে ‘ক্যাপ্টেন কুল’ তকমা সর্বপ্রথম তাঁর কপালেই জুটতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link