স্বপ্নের মতোই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিষিক্ত হয়েছিলেন পাকিস্তানি পেসার মোহাম্মদ সামি। শোয়েব আক্তারের পর সবচেয়ে দ্রুততম বোলার হিসেবেই ভাবা হচ্ছিলো সামিকে। গতি, স্যুইং আর দুর্দান্ত ইয়র্কারে পাকিস্তানি গ্রেট ইমরানের খানের কাছে আখ্যা পেয়েছিলেন আধুনিক ক্রিকেটের ম্যালকম মার্শাল।
তিন ফরম্যাটেই হ্যাটট্রিক করা একমাত্র পেসার তিনি। ১৪৫ কি.মি ঘন্টায় ধারাবাহিক বল ছুঁড়তে পারতেন সামি। যে সম্ভাবনা নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেছিলেন তাঁর অনেকটাই ডুবে গিয়েছে অনিয়মিত আর অধারাবাহিকতার সাগরে। প্রথমে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস আর পরবর্তীতে উমর গুল, আসিফ, আমিরদের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছে সামির সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার।
ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিসরাও বেশ সাপোর্ট করেছিলেন সামিকে। অতিরিক্ত গতিতে বল স্যুইং করানো আর উইকেট নেওয়ার সক্ষমতার কারণেই সামিকে নিয়ে আশাবাদী ছিলো ওয়াসিম, ওয়াকাররা। ধারাভাষ্যকাররা ‘করাচি এক্সপ্রেস’, ‘বুলেট’ সহ বিভিন্ন নাম জুড়ে দিয়েছিলেন সামির নামের সাথে। অবশ্য নিজের অ্যাবিলিটির সবটা দিতে পারেননি তিনি। গতির সাথে সাথে লাইন, লেন্থ ধরে রাখতে না পারাতে ক্যারিয়ারের পরবর্তী সময়টা বনে যান রান মেশিন।
১৯৮১ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি করাচিতে জন্ম সামির। ক্লাব ক্রিকেট থেকে উঠে এসে মাত্র ২০ বছর বয়সে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। অভিষেকেই দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেট সহ ম্যাচে ৮ উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি। এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্ট খেলতে নেমেই গড়েন হ্যাটট্রিক!
ওই বছরই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষিক্ত হন তিনি। এক বছরের মাথায় ২০০২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে হ্যাট্রিক করেন এই পেসার! ওয়াসিম আকরামের পর দ্বিতীয় বোলার হিসেবে টেস্ট ও ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই হ্যাটট্রিক গড়েন সামি।
পরের বছর ২০০৩ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেতে মাত্র ১০ রানে ক্যারিয়ার সেরা ৫ উইকেট শিকার করেন তিনি। বিধ্বংসী স্পেলে সেদিন নিউজিল্যান্ডকে ধসিয়ে দেন সামি। অবশ্য সামির ক্যারিয়ারের স্বর্ণালি সময়টা এখানেই শেষ। এরপরই পাল্টে যায় সামির সম্ভাবনাময়ী ক্যারিয়ার।
পরের বছরই এক লজ্জার রেকর্ডে নাম তোলেন এই পেসার। ২০০৪ সালের এশিয়া কাপে এক ওভারে ১৭ বল করেন তিনি! সাত ওয়াইড আর চার নো বলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে লম্বা ওভারের মালিকানা তাঁর দখলেই। তিনি টেস্ট ইতিহাসের একমাত্র বোলার যার ৫০ এর বেশি উইকেট আছে তবে বোলিং গড় ৫০ এর বেশি!
অধারাবাহিকতা আর বাজে পারফরম্যান্সে তরুন পেসার মোহাম্মদ আসিফের কাছে জায়গা হারান তিনি। তবে আবারো কামব্যাক করেন সামি। ২০০৭ বিশ্বকাপে ছিলেন রিজার্ভ খেলোয়াড় হিসেবে। তবে ভাগ্য সহায় শোয়েব মালিক ও মোহাম্মদ আসিফ আনফিট থাকায় পরবর্তীতে মূল দলে জায়গা পান তিনি। এরপর নিষিদ্ধ ক্রিকেট আসর ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে (আইসিএল) অংশ নেওয়ায় আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া ক্রিকেটে নিষেধাজ্ঞা পান তিনি।
প্রায় দেড় বছর পর নিষেধাজ্ঞা কাঁটিয়ে আবার সুযোগ পান সামি। বাংলাদেশের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি অভিষিক্ত হন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের পর ২০১০ আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও সুযোগ পান তিনি। অবশ্য এবারও ভাগ্যক্রমে জায়গা পান! উমর গুলের ইনজুরিতেই ভাগ্য খুলে যায় সামির।
এরপর ২০১২ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) দুরন্ত রাজশাহীর হয়ে সুযোগ পেয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেন এই পেসার। এক ম্যাচে হ্যাটট্রিকসহ পাঁচ উইকেট শিকার করেন তিনি। একমাত্র বোলার হিসেবে তিন ফরম্যাটেই হ্যাট্রিকের কীর্তি গড়েন এই পেসার। সেখান থেকে ডাক পান অস্ট্রেলিয়া সিরিজ ও ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে! তবে দুটো ওয়ার্ম আপ ম্যাচ ছাড়া পুরো টুর্নামেন্টে এক ম্যাচও খেলার সুযোগ পাননি তিনি।
এরপর দুরন্ত রাজশাহীর হয়ে আবারও খেলার প্রস্তাব পান তিনি। তবে পিসিবি ও বিসিবির সাময়িক ঝামেলায় সেবার পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের অনাপত্তিপত্র দেয়নি পিসিবি। যার দরুন বিপিএল খেলা হয়নি সামির। প্রথম মৌসুমে রাজশাহীর হয়ে দুর্দান্ত বল করা সামি হয়েছিলেন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি।
ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করে জাতীয় দলে এলেও ধারাবাহিক হতে পারেননি সামি। ২০১৫ সালে ফয়সাল ব্যাংক টি-টোয়েন্টি কাপে অসাধারণ পারফর্ম করে জায়গা পান জিম্বাবুয়ে সিরিজে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঘরের মাটিতে ম্যাচ দিয়ে প্রত্যাবর্তন হয় সামির। আর ওই ম্যাচে শিকার করেন ৩ উইকেট।
এরপর বিপিএল, পিএসএল ও এশিয়া কাপের পারফরম্যান্স ভিত্তি করে ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও জায়গা করে নেন তিনি। সেবার পিএসএলের প্রথম আসরে ইসলামাবাদ ইউনাইটেডের হয়ে পঞ্চম সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হন তিনি। ৬ ম্যাচে ৫.১৭ ইকোনমিতে ১১ উইকেট নেন সামি।
৩৬ টেস্টে শিকার করেছেন ৮৫ উইকেট, পাঁচ উইকেট নিয়েছে মাত্র ২ বার। ৮৭ ওয়ানডেতে ৪.৯৯ ইকোনোমিতে আছে ১২১ উইকেট, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যারিয়ার সেরা বোলিংয়ে শিকার করা ফাইফরই এই ফরম্যাটে একমাত্র। এছাড়া টি-টোয়েন্টিতে ১৩ ম্যাচে ৮ এর বেশি ইকোনমিতে নিয়েছেন ২১ উইকেট। ঘরোয়া ক্রিকেটে ৫৪২ ম্যাচে আছে ১০৫০ উইকেট! ৩৯ বার পাঁচ ও ৪ বার শিকার করেছেন ১০ উইকেট।
পাকিস্তান বরাবরই পেস বোলার তৈরিতে সেরা। ওয়াকার-ওয়াসিমদের উত্তরসূরি ভাবা মোহাম্মদ সামি ক্যারিয়ার শেষ করেছেন অধারাবাহিক ট্যাগ নিয়ে। গতির সাথে লাইন-লেন্থ, অ্যাকুরেসি ধরে না রাখতে পারাই সামির ক্যারিয়ার অল্পতেই থমকে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ।