মিনহাজুল আবেদীন নান্নু অনেকদিন হয় অবসর নিয়েছেন। প্রধাণ নির্বাচক হিসেবে তবু তিনি আলোচনায় আছেন। অন্য দিকে অবসর না নিলেও সেরকম আলোচনায় নেই মোহাম্মদ আশরাফুল। কিন্তু হঠাৎ করেই ক্রিকেট ছেড়ে বাংলাদেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নান্নু বনাম আশরাফুল দ্বন্ধে।
নিশ্চয়ই যা হচ্ছে, তা ক্রিকেটীয় ব্যাপার স্যাপার হচ্ছে না। এসব বিষয় নিয়ে খুব আলোচনা হওয়াটা কাঙ্খিত না। তারপরও চাইলেই আপনি সবকিছু এড়িয়ে থাকতে পারবেন না। সময়টা যেহেতু এই বিতর্কের, আসুন কয়েকটা ছোট ছোট পয়েন্ট একটু ঘুরে দেখা যাক।
এই বিতর্কে আমরা কী কিছু মিস করে যাচ্ছি?
- আশরাফুল কী সমালোচনাটা ঠিক করেছেন?
ঠিক, কী ভুল সেটা আলাদা আলোচনা। কথা হচ্ছে একজন সাবেক অধিনায়ক হিসেবে, একজন সমালোচক হিসেবে আশরাফুলের এই কথা বলার অধিকার আছে।
আশরাফুল বলেছেন, এতো লম্বা সময় ধরে কেউ প্রধান নির্বাচক থাকলে দল গঠনের প্রক্রিয়া নষ্ঠ হয়। হয়তো কোথাও কোথাও এর চেয়েও বেশি সময় ধরে কেউ নির্বাচক থাকেন। তাতে নান্নুর প্রধাণ নির্বাচক থাকাটা যৌক্তিক হয়ে যায় না। সমালোচক হিসেবে আশরাফুল দাবি করতেই পারেন যে, লম্বা সময় ধরে দায়িত্বে থাকার ফলে নান্নু তার কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। এমন দাবিকে আপনি অস্বীকার করতে পারেন। কিন্তু আশরাফুলের দাবি করার অধিকারকে অস্বীকার করতে পারেন না।
- নান্নু কী ঠিক বলেছেন?
না।
নান্নুর কথার দুটি অংশ আছে। প্রথমত নান্নু যুক্তি দিয়ে বলতে চেয়েছেন যে, লম্বা সময় ধরে প্রধাণ নির্বাচক থাকলে কোনো সমস্যা নেই। এটুকু নান্নু দাবি করতে পারেন। আশরাফুলের যেমন তাকে অভিযুক্ত করার অধিকার আছে, নান্নুরও অধিকার আছে এর পাল্টা যুক্তি দেওয়ার। কিন্তু নান্নু এরপরই কেলেঙ্কারিটা করলেন।
দ্বিতীয় অংশে নান্নু আশরাফুলকে ‘ফিক্সার’ ও ‘দেশদ্রোহী’ বলে বিশেষায়িত করলেন। এটা কেবল বিশেষণ নয়, রীতিমতো একটা গালি।
আশরাফুল অবশ্যই ফিক্সিং করেছিলেন। সে জন্য তিনি শাস্তিও পেয়েছেন। শাস্তি শেষ করে তিনি আবার মূল ধারায় ফিরে এসেছেন। ফলে তাকে ফিক্সার বলে গালি দেওয়াটা অবশ্যই অশোভন। আর বিসিবির একটা পদে চাকরি করা অবস্থায় এমন কথা বলাই অন্যায়। নান্নুর ক্ষেত্রে এটা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট।
আশরাফুল একজন চলমান খেলোয়াড়। তার কাগজে কলমে এখনও সব দলে খেলার পথ খোলা। এই অবস্থায় প্রধাণ নির্বাচক যদি তার সম্পর্কে এরকম কথা প্রকাশ্যে বলেন, তার অর্থ তিনি পরিষ্কার আশরাফুল বিদ্বেষী। একটা দেশের জাতীয় দলের প্রধাণ নির্বাচক কোনো খেলোয়াড় সম্পর্কে প্রকাশ্যে বিদ্বেষ প্রকাশ করতে পারেন না। এটা তার পদের সাথে সংঘাতমূলক আচরণ।
- নান্নুর ব্যাটিং নিয়ে আলোচনা
আশরাফুলকে গালি দেওয়ায় লোকেরা হাস্যকর ভাবে নান্নুর ব্যাটিং রেকর্ড সামনে আনতে শুরু করেছেন।
নান্নু তাঁর ক্যারিয়ারে ২৭ ম্যাচে ১৮.৮৭ গড়ে ৪৫৩ রান করেছেন। এই পরিসংখ্যান সামনে এনে আশরাফুল ভক্তরা দাবি করছেন যে, নান্নুর প্রধান নির্বাচক হওয়ার যোগ্যতা নেই। এখানে প্রথম কথা হলো, ব্যাটিং বা বোলিং রেকর্ডের সাথে প্রধাণ নির্বাচক হওয়ার যোগ্যতার কোনো সম্পর্ক নেই।
ভারতের প্রধান নির্বাচক চেতন শর্মা। তার জাতীয় দলের রেকর্ড দেখুন। ২৪ ব্যাটিং গড়ের একজন মানুষ রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিদের ভাগ্য নির্ধারণ করছেন। তার রেকর্ড এ ক্ষেত্রে বাধা হচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড কোনো দলেরই প্রধাণ নির্বাচক হওয়ার ক্ষেত্রে খেলোয়াড়ী রেকর্ড কোনো বড় ব্যাপার নয়। মূল ব্যাপার হলো, তিনি এই কাজটা বোঝেন কি না।
ব্যাটিং গড় নিয়ে কথা বলার আরও বিপদ আছে।
আশরাফুলের নিজের ব্যাটিং গড় কত? ২৪ আর ২২! এখন আপনি বলুন তো এই ব্যাটিং গড় দিয়ে কী আশরাফুলকে চেনা যায়? ২২ গড় দিয়ে আপনি কী কার্ডিফ, ম্যানচেস্টার বা কলম্বোর আশরাফুলকে চিনতে পারবেন? পারবেন না। আশরাফুলকে চিনতে হলে আপনাকে ওই ইনিংসগুলো দেখতে হবে। তেমনই ১৮ ব্যাটিং গড় দিয়ে আপনি নান্নুকে চিনতে পারবেন না। সেটা চিনতে হলে সর্বকালের অন্যতম সেরা বোলিং লাইন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপ ফিফটি দিয়ে আপনার সেটা বুঝতে হবে। যে ইনিংসের ওপর দাড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস।
নান্নুর ব্যাটিং নিয়ে আরও কথা আছে। তিনি তিন-চার বছর পর পর কিছু আর্ন্তজাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পেতেন। ফলে তার আর্ন্তজাতিক ব্যাটিং দিয়ে তাকে চেনা যাবে না।
এখন কথা হলো, প্রধাণ নির্বাচক নান্নুকে নিয়ে আলোচনায় তার ব্যাটিং নিয়ে কথা টানলে আসলে আপনি নান্নুর প্রতি সহানুভূতিটাই বাড়িয়ে দিচ্ছেন। যারা সেই সময়টা জানেন, তারা তখন নান্নুর পক্ষে চলে যাবেন। কিন্তু আমরা তো নান্নুকে সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে মানি; সেরা নির্বাচক হিসেবে নয়।
তাই নির্বাচক নান্নুর সমালোচনা করুন। দল গঠনে ধারাবাহিকতার অভাব, পাইপলাইন গড়তে না পারা, হুটহাট পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্ত নেওয়া; এসব কারণে নান্নুর বিপক্ষে হাজার পাতার সমালোচনা করা যায়। সেই সমালোচনায় পানি ঢেলে দেয় আপনাদের অতি উৎসাহ। তার ব্যাটিংকে আলোচনায় এনে আসলে আপনারা নান্নুকে একটা স্কেপ গেট তৈরি করে দিচ্ছেন। নান্নু সহানুভূতি নিয়ে এই বিতর্কে বেঁচে যাচ্ছেন।
তাই ব্যাটসম্যান নান্নুকে না টেনেই তাঁর কিংবা তাঁর নির্বাচক পরিচয়ের সমালোচনা করুন। আর বাংলাদেশ ক্রিকেটে দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রকে পরস্পরের মুখোমুখি যে পক্রিয়ায় করা হয়েছে সেই পক্রিয়ারও সমালোচনা হওয়া জরুরী।